সম্প্রতি ভারতে বহু সাধারণ মানুষ তাঁদের ব্যাংকে রাখা বহুদিনের সঞ্চয় হারিয়েছেন। ব্যাংক ডাকাতির জন্য আজকাল আর কালো মুখোশ পরে পিস্তল বাগিয়ে আসার প্রয়োজন নেই। ঘরে বসে কম্পিউটারের সাহায্যেই আর্থিক সংস্থাদের দেউলিয়া করে দেওয়া যায়। লিখছেন দীপঙ্কর দাশগুপ্ত।
কোভিডের কৃপায় গৃহবন্দি অবস্থায় টেলিভিশন যন্ত্রটির সঙ্গে অনেকেরই সম্পর্ক গভীর হয়ে উঠেছে। স্ট্রিমিং করে সিনেমা দেখা এখন প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা। দু’দিন আগে সেরকমই একটি ছবি দেখে আতঙ্কিত হলাম। ছবিটির নাম ‘আইয়ারি’। ছবির শেষে জানলাম শব্দটির অর্থ: ‘চালাকি’ বা ‘জালিয়াতি’ বা ওই জাতীয় কিছু। ছবির কাহিনিও প্রথম থেকে শেষ অবধি প্রবঞ্চনা সমৃদ্ধ।
ছবির প্রায় গোড়ার দিকেই অবিশ্বাস্য এক দৃশ্যে একজন অতি দক্ষ প্রযুক্তিবিদ মেয়ের দেখা পাওয়া যায়। তার দক্ষতা প্রমাণ করার জন্য সে তার পুরুষসঙ্গীর ল্যাপটপটি চেয়ে নেয়। ছেলেটি জানায়, তার ল্যাপটপ পাসওয়ার্ড সুরক্ষিত, তাই সে ল্যাপটপ খোলা যাবে না। মেয়েটি মিষ্টি হেসে ল্যাপটপটি নিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, পাসওয়ার্ড প্রহরীকে সহজেই ঘায়েল করা যায়। কেবল তা-ই নয়, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সে ছেলেটির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলে এবং সেই অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে বৈদ্যুতিন পদ্ধতিতে কিছু জিনিসপত্রও কিনে ফেলে। সে চুরি করেনি অবশ্যই, কিন্তু ইচ্ছা হলে কী করতে পারত, তার প্রমাণ দিয়ে ফেলে।
[আরও পড়ুন: কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে খোলাখুলি অবজ্ঞা, রাজ্যে রাজ্যে বাড়ছে বিজেপির কোন্দল]
এটা গল্প ঠিকই। কিন্তু সত্যিই কি ব্যাপারটা কাল্পনিক? টেলিভিশন থেকে বেরিয়ে একবার আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ফিরে আসা যাক। গত একমাসের বেশি আয়ারল্যান্ডের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অবস্থা ভেঙে পড়ার মতো। সরকারি খরচে চালিত সেখানকার স্বাস্থ্যসংস্থা এক ধরনের মুক্তিপণের শিকার হয়েছে। আক্রমণকারীরা পৃথিবীর কোথায় বসে কারও জানা নেই। তাদের হুমকি, তৎক্ষণাৎ ২০ কোটি ডলার না দিলে হাসপাতালগুলোর বৈদ্যুতিন মাধ্যমে চালিত যন্ত্রপাতি বন্ধ হয়ে যাবে। রোগীদের সম্পর্কে তথ্যাবলিও যাবে উধাও হয়ে। এই অবস্থায় পড়ে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় কর্মীরা কম্পিউটার ছেড়ে কাগজ-পেনসিলে ফিরে যাবে। যতদূর জানা যায়, ১৪ জুন অবধি পরিষেবা স্বাভাবিক হয়নি।
ব্যাপার কেবল আয়ারল্যান্ডেই (Ireland) সীমাবদ্ধ নয়। এই ঘটনার কাছাকাছি সময়েই একই ধরনের ঘটনা ঘটে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ আমেরিকায়। ৭ মে, ‘কলোনিয়াল পাইপলাইন’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থা, এই বিপদে পড়ে। সংস্থার কাজ হল, আমেরিকার পূর্বাঞ্চলে পাইপের সাহায্যে তেল সরবরাহ করা। কাজটি করতে হয় আধুনিক বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির সাহায্যে। সাইবার আক্রমণের ফলে এই সংস্থাকে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিতে হয়। রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন জরুরি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে বাধ্য হন এবং কলোনিয়াল পাইপলাইন ৪০ লক্ষ ডলার দিয়ে মুক্তি পায়। টাকা দিয়েও তেলের জোগান স্বাভাবিক হতে বেশ কয়েক দিন সময় লাগে।
এই জাতীয় আক্রমণের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই শিকারের লক্ষ্য বড় সংস্থাগুলি। যেটা বিশ্বাস করা কঠিন, তা হল, এমনকী ‘অ্যাপেল’-ও এই ধরনের আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। এটা যে দুশ্চিন্তার বিষয়, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, অ্যাপেল ফোন ইত্যাদি ব্যবহারকারীরা মনে করেন যে, ফোনে রাখা তাঁদের তথ্যাদি সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। আর, কেবলমাত্র যে বৃহৎ সংস্থাগুলিই এর শিকার, এমনটাই বা কে বলতে পারে? সম্প্রতি ভারতে বহু সাধারণ মানুষ তাঁদের ব্যাংকে রাখা বহুদিনের সঞ্চয় হারিয়েছেন। ব্যাংক ডাকাতির জন্য আজকাল আর কালো মুখোশ পরে পিস্তল বাগিয়ে আসার প্রয়োজন নেই। ঘরে বসে কম্পিউটারের সাহায্যেই আর্থিক সংস্থাদের দেউলিয়া করে দেওয়া যায়। এখানেই শেষ নয়। বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির সাহায্যে আজকাল নতুন মডেলের কম্পিউটার নির্ভর গাড়ি তৈরি হচ্ছে। যিনি সেই গাড়ি চালাচ্ছেন, তিনি অকস্মাৎ কম্পিউটার মাধ্যমে খবর পেয়ে যেতে পারেন যে, বড় মাপের টাকা কোনও অজানা অ্যাকাউন্টে না পাঠালে তাঁর গাড়ির দরজা খুলবে না! এই ঘটনা ইশকুলযাত্রী বাস ভরতি শিশুদের জীবনে ঘটলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
উদাহরণগুলি তুলে ধরার অর্থ এই নয় যে, প্রযুক্তির অগ্রগতি মানবসভ্যতার পক্ষে অশুভ বলে মনে করা উচিত। গত ৩০ বছরে বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির উন্নতির ফলে সমস্ত পৃথিবী অশেষ উপকৃত হয়েছে। কেবল এই প্রযুক্তির চরিত্র এমনই যে, এর সাহায্যে অপরাধ জগতের আলো-আঁধারিকে ঘোর অন্ধকারে পরিণত করা যায়। এবং তার সুযোগ নিতে তৎপর দেশের অভাব নেই। অনেকেই মনে করেন যে, এখানে প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের সংঘাতের সম্পর্ক রয়েছে। চিন (China) বা রাশিয়া (Russia) এই ধরনের আক্রমণকারীদের মদত জোগায়, এমনটাই পাশ্চাত্যের অভিযোগ। তবে উলটো দিক থেকেও যে এমন কাজকর্ম হয় না- তারই বা কী প্রমাণ আছে?
মুক্তির উপায় কী? এই জাতীয় আক্রমণে কারও প্রাণহানির সম্ভাবনা কম, কারণ টাকা দিয়ে দিলেই মুক্তি পাওয়া যায়। না-দিলে অবশ্য জনমানবশূন্য কোথাও নিজের গাড়ির মধ্যেই দম বন্ধ হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হতে পারে। এখন প্রশ্ন হল, হারানো টাকার ক্ষতিপূরণ দেবে কে? বিমা সংস্থাগুলি কি সহজে এই জাতীয় বিমার দায় নিতে রাজি হবে? যে-সংস্থা বিমা চাইবে, সে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য কী ব্যবস্থা নিয়েছে- সেটাও তো বিমা কোম্পানি আগে যাচাই করে দেখবে। এবং যথেষ্ট সুরক্ষিত না থাকলে হয় বিমার খরচ আকাশছোঁয়া হবে, নয় বিমা থাকবেই না। এই অবস্থায় শেয়ার বাজারে এই সমস্ত সংস্থার শেয়ারের মূল্য কমতে থাকবে। আর, তাকে রুখতে অনেক সংস্থাই সত্য গোপন করতে প্রবৃত্ত হবে। ফলে ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে, বিশেষ করে আর্থিক সংস্থাগুলির।
এই মুহূর্তে হয়তো এটা অতিকায় দুশ্চিন্তার কারণ নয়। কিন্তু প্রযুক্তি যে-হারে এগচ্ছে, কিছুকালের মধ্যেই ক্ষয়ক্ষতি আর সামান্য থাকবে না। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে হয়তো বা অতি সাধারণ মানুষ। তেমন হলে ‘আইয়ারি’ জাতীয় ঘটনা হয়তো আমার আপনার প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতায় পরিণত হবে।