নির্মল ধর: সত্যজিৎ-তনয় সন্দীপ রায় বাবার ঝরঝরে কলম আর মগজের ঘিলু ঘুলিয়ে লেখা দু-দুটি গল্প নিয়ে বানিয়েছেন ‘ডবল ফেলুদা৷’ চরিত্রের স্রষ্টা ও লেখকের প্রতি এর চাইতে বড় ট্রিবিট্রট আর কীই বা হতে পারে! এটা শুধু পিতার প্রতি পুত্রের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন নয়, এই ‘ডবল ফেলুদা’ প্রদোষ চন্দ্র মিটারের প্রতিও বিনম্র ট্রিবিউট৷ আর সত্যজিৎকৃত থিম মিউজিক ব্যবহারটিও যথার্থ সম্মান প্রদর্শন বৈকি! লেখক সত্যজিৎ রায়ের প্রিয় দুটি গল্প সন্দীপ বেছে নিয়েছেন– ‘সমাদ্দারের চাবি’ আর ‘গোলোকধাম রহস্য’৷ ফেলুদার মগজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রথমটির চেয়ে দ্বিতীয়টি অনেক বেশি জটিল এটা মানতেই হবে৷ বোধহয় সেই কারণেই অপেক্ষাকৃত সহজ ও সরল সমাধানের গল্পটিকে সন্দীপ প্রথম ছবি হিসাবে পেশ করেছেন৷
‘সমাদ্দারের চাবি’ গল্পে ভাইপো মণিমোহন যে প্রকৃত অপরাধী সেটা প্রায় শুরু থেকেই বোঝা যাচ্ছিল অভিনেতা ব্রাত্য বসুর বিহেভিয়্যারিয়েল প্যার্টানের মধ্যেই৷ তাঁর চোখ-মুখের ব্যবহারই বলে দিয়েছে তিনিই আসল কালপ্রিট! ‘মেলোর্কড’ বা ইরানিয়ান ইনস্টস্ট্রুমেন্টের প্রসঙ্গ এনে ফেলাটা সত্যিই এক অসামান্য সংগীত রসিকের মস্তিষ্কপ্রসূত৷ সত্যজিৎ রায় নিজে ছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতের বিশেষজ্ঞ৷ একমাত্র তাঁর পক্ষেই সরগম নিয়ে এমন ধাঁধা তৈরি সম্ভব ছিল৷ শুদ্ধ কোমল-কড়ির জট ছাড়িয়ে ‘মেলোকর্ড’ নামের সিন্দুকটির ডালা খোলার ব্যাপারটি চমকপ্রদ তো বটেই, অভিনবও৷ সন্দীপ তাঁর লেখা চিত্রনাট্যে ঘটনা পরম্পরার উপস্থাপনায় ‘রহস্য’ জিইয়ে রেখেই এগিয়েছেন৷ যদিও দু-তিনটি-জায়গায় ভাইপো মণিমোহনের (ব্রাত্য বসু) চোখের ভাবে কিঞ্চিৎ আভাস মেলে প্রকৃত দোষীর! এই ‘লুক’টা এড়াতে পারলে ভাল হত৷ যেমনটি ঘটেছে সুরজিৎ দাশগুপ্তর বেলায়৷ অবশ্য বহুপঠিত জনপ্রিয় ফেলুদা-সিরিজের সব গল্পই দর্শকের জানা৷ পর্দায় দেখার হল- সেই সমাপ্তিপর্বে কীভাবে পৌঁছিয়েছে চিত্রনাট্য৷ একজন দক্ষ ক্র্যাফটসম্যান হিসাবে সন্দীপের কাজ প্রায় ত্রুটিহীন৷
ছবির শুরুই হয় সত্যজিৎ রায়ের আঁকা ইলাস্ট্রেশন দিয়েই৷ এই অংশে গ্রাফিক্সের কাজ সুন্দর৷ আবহে বেজে ওঠে সেই পুরনো ফেলুদা থিম সং৷ সত্যিই এ এক বিনম্র পিতৃতর্পণ! ‘সমাদ্দারের চাবি’ অংশে ব্রাত্য বসু, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, শুভ্রজিৎ মিত্র সকলেই অভিনয়ে যথেষ্ট সতর্ক ও যত্নবান৷
দ্বিতীয় গল্প ‘গোলোকধাম রহস্য’-এ রহস্য ব্যাপারটি তত দানাদার ও জমাটি নয়৷ গল্পের সেই ত্রুটি সন্দীপ ওয়াটারটাইট চিত্রনাট্যে পুষিয়ে দিয়েছেন৷ সংলাপ নির্ভর চিত্রনাট্যে শিল্পীদের অভিনয় এই অংশে অত্যন্ত জোরদার৷ ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের নীহার দত্ত, ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুবীর দত্ত, সেক্রেটারি রণজিতের চরিত্রে গৌরব চক্রবর্তী সত্যিই যাকে বলে চুটিয়ে অভিনয় করেছেন৷ গৌরব বাবা সব্যসাচীর মুখোমুখি হয়েও অত্যন্ত সাবলীল এবং শেষ পর্বে ভেঙে পরার দৃশ্যেও বেশ স্বাভাবিক৷ সবজান্তা সিধু জ্যাঠার চরিত্রে এবার পরান বন্দ্যোপাধ্যায় এক নতুন মাত্রা নিয়ে এলেন৷ কমেডির সঙ্গে সিরিয়াসনেস পাঞ্চ করে অসাধারণ পরানবাবু৷ ছোট্ট পরিসরে রাজেশ শর্মা এবং বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীকেও মনে রাখতে হয়৷ আসলে চিত্রনাট্যের বাঁধুনিতে নাটকীয় মুহূর্তগুলি এমনভাবে জড়ানো, ঘটনার বিস্তার ও বিশ্লেষণে পরিমিতি ও বুদ্ধির সুন্দর মিশ্রণ ‘গোলোকধাম রহস্য’কে সত্যিই রহস্যময় করে তোলে৷
অভিনয়ে যে দু’জনের নাম সবার শেষ করছি, অবশ্যই তাঁদের নাম সবার আগে করা উচিত ছিল৷ ফেলুদা ও তোপসের চরিত্রে সব্যসাচী চক্রবর্তী ও সাহেব ভট্টাচার্য পাঁচ বছর পরেও একই রসায়নে যুক্ত৷ সব্যসাচীকে আবার ফেলুদা চরিত্রে নেওয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনাও হয়েছে৷ ফেলুদা, নাকি ফেলুকাকা- এমন বাঁকা মন্তব্যও কানে এসেছে৷ কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি- এবারে সব্যসাচীর ‘ডবল ফেলুদা’য় অভিনয় সত্যিই তাঁর সেরা৷ শারীরিক ব্যাপারটা বাদ দিলে তাঁর অভিনয় নিয়ে কোনও কথা হবে না বস৷ তোপসের চরিত্রে সাহেব আগের তুলনায় সাবলীল নিশ্চয়ই, কিন্তু আরও শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্য প্রয়োজন৷
ছবি: ডবল ফেলুদা
পরিচালনা: সন্দীপ রায়
অভিনয়ে: সব্যসাচী চক্রবর্তী, সাহেব ভট্টাচার্য, ব্রাত্য বসু, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, পরান বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ
৩/৫
The post ফেলুদা-সিরিজের সেরা সম্পদ ডবল ফেলুদা appeared first on Sangbad Pratidin.