মৈনাক মণ্ডল: ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের ছায়া ফের ভারত-পাক সীমান্তে। পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলার পর নজিরবিহীনভাবে পাকিস্তানের মাটিতে পালটা বিমান হামলা চালিয়েছে ভারতীয় বাযুসেনা। কারগিল যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের হামলায় ধ্বংস হয়েছিল মিগ-২৭ যুদ্ধবিমান। ধরা পড়েছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নচিকেতা। এবারও আকাশ যুদ্ধে ধ্বংস হয়েছে মিগ-২১। ধরা পড়েছেন উইং কমান্ডার অভিনন্দন। তাহলে কি কারগিলের মতো আরেকটা যুদ্ধ আসন্ন? কিন্তু কী লেখা আছে অভিনন্দনের ভাগ্যে?
নচিকেতার ঘটনা
কারগিল যুদ্ধের সময় একইভাবে নিয়ন্ত্রণরেখায় ধরা পড়েন বায়ুসেনা পাইলট ২৫ বছরের কমবমপতি নচিকেতা। ১৯৯৯ সালের ২৬ মে মিগ-২৭ যুদ্ধবিমান নিয়ে পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীদের উপর হামলা চালাতে গিয়েছিলেন তিনি। নির্দেশ ছিল বোমা মেরে পাক জঙ্গি ও হানাদারদের ছোট ছোট ঘাঁটিগুলি উড়িয়ে দেওয়ার। কিন্তু নচিকেতা বোমা ফেলতে ফেলতে খুব নিচু দিয়ে উড়ান শুরু করেছিলেন। তখন কারগিলের শিখর থেকে লাগাতার ছোট ছোট ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে পাক সেনারা। রেঞ্জের মধ্যে থাকায় পাকিস্তানে তৈরি ‘আনজা মার্ক ওয়ান’ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে আগুন ধরে যায় নচিকেতার মিগের ইঞ্জিনে। বিমানটি ভেঙে পড়লে জখম অবস্থায় ককপিট থেকে বেরিয়েছিলেন নচিকেতা। আগুনে পুড়ে যায় তাঁর ফ্লাইং কস্টিউম। কোনওক্রমে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি পিস্তল বের করে পালাতে থাকেন। পাক টহলদারবাহিনীও তাঁকে মরিয়া হয়ে খুঁজতে থাকে। কিন্তু দুর্গম পাহাড় পর্বত টপকে দ্রুত নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে পৌঁছানো ছিল অসম্ভব। ফলে দু’তিন ঘণ্টা লুকোচুরির পর তিনি পাক টহলদারবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান।
পাথরের আড়ালে পজিশন নেওয়ার আগেই তাঁকে ঘিরে ধরে একদল পাক সেনা। এরা সবাই পাক সেনার খাকি ইউনিফর্ম ছাড়াই জঙ্গিদের ছদ্মবেশে ছিল। এরপর রাওয়ালপিণ্ডিতে পাক সেনার সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁকে। একবারের জন্যও আত্মবিশ্বাস ও সাহস হারাননি পুণের ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমির এই প্রাক্তনী।
এদিকে, নচিকেতা ধরার পর তাঁকে মুক্ত করতে পাকিস্তানের উপর ভারতের প্রবল কূটনৈতিক চাপ চলছিল। আট দিন পরে রেডক্রসের মাধ্যমে ভারতের হাতে ফেরত দেওয়া হলেও অমানুষিক অত্যাচার করা হয়েছিল তাঁর উপর, এমনটাই অভিযোগ। কিন্তু তখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। ছিল না প্রচুর টিভি চ্যানেল বা সংবাদমাধ্যম। ফলে নিখুঁতভাবে জানা যায়নি তাঁর সঙ্গে ঠিক কী রকম ব্যবহার করেছিল পাক সেনা। যদিও প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ করমর্দন করে নচিকেতার সাহসের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। কারগিল যুদ্ধে অবদানের জন্য তাঁকে বায়ুসেনা মেডেলে সম্মানিত করেছিল ভারত সরকার। নচিকেতা জানিয়েছিলেন, প্রচণ্ড চাপ দেওয়া সত্ত্বেও লাগাতার জেরার সামনে তাঁকে দিয়ে কিছুই বলাতে পারেনি পাক সেনা। ভারতীয় বিমানবাহিনীর কৌশল ও ভিতরের খবর তিনি কিছুই জানাননি। আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে সুস্থ ও অক্ষত অবস্থায় তাঁকে আট দিন পরে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল পারভেজ মুশারফের পাকিস্তান। ভারতীয় মিডিয়া ব্যাখ্যা করেছিল, ক্ষুধার্ত হায়নার মুখ থেকে যেন খাবার (নচিকেতাকে) কেড়ে নিলেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্র এবং অটলবিহারী বাজপেয়ী। ওই বছরই ৩ জুন ওয়াঘা সীমান্তে ভারতের হাতে তাঁকে তুলে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার।
নচিকেতা এখন বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন। ৭৮ নম্বর স্কোয়াড্রনে যুদ্ধবিমান রিফুয়েলিং (জ্বালানি) বিভাগে কর্মরত। পোস্টিং আগ্রাতে। স্ত্রী পুত্র নিয়ে সুখে সংসার করছেন ৪৫ বছরের নচিকেতা। বিমানবাহিনীর আরেক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কিংবদন্তী শচীন তেণ্ডুলকর একবার বলেছিলেন, ‘নচিকেতা তাঁর হিরো। সত্যিকারের হিরো।’ বিমানবাহিনীতে ভরতি হতে ইচ্ছুক যুবক যুবতীদের বুদ্ধিমত্তা ও মানসিক সক্ষমতা বাড়ানোর প্রশিক্ষণ দেন নচিকেতা। এদিনের ঘটনার জেরে তিনি আশাপ্রকাশ করেছেন, উইং কমান্ডার অভিনন্দন সুস্থ অবস্থায় মুক্তি পাবেন এবং অভিনন্দনের উদ্বিগ্ন পরিবারের সঙ্গে তিনি আছেন। গোটা দেশকেও অভিনন্দনের পরিবারের পাশে থাকার আর্জি জানিয়েছেন এক সময় পাক সেনার হাতে ধরা পড়ে বেঁচে ফিরে আসা নচিকেতা।
[শত্রুর কবলেও অদম্য অভিনন্দন, দৃপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন পাকিস্তানিদের]
অজয় আহুজার ঘটনা
স্কোয়াড্রন লিডার ৩৬ বছরের অজয় আহুজা ছিলেন নচিকেতার সিনিয়র। তিনি কারগিল যুদ্ধের সময় নচিকেতার সঙ্গেই পাক জঙ্গি খতম অভিযানে নেমেছিলেন। কিন্তু স্টিংগার মিসাইল ছুড়ে তাঁর বিমান ধ্বংস করেছিল পাক সেনারা। তাঁর গুলিবিদ্ধ এবং ছুরি দিয়ে কোপানো ক্ষতবিক্ষত দেহ ভারতের হাতে তুলে দেয় পাকিস্তান সরকার। জেনেভা কনভেনশনের নীতি লঙ্ঘন করে তাঁকে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছিল পাক সেনা। পরে ভারতে নতুন করে পোস্টমর্টেম করা হলে জানা যায়, নিরাপদে প্যারাশুটে ঝাঁপ দিয়ে নেমেছিলেন অজয়। কিন্তু তিনি আত্মসমর্পণ করতে চাননি। পিস্তল বের করে গুলি চালাতে শুরু করেছিলেন। তাঁর গুলিতে জখম হন দু’জন পাক সেনা। এরপর তাঁকে কুড়ি জন পাক সেনা ঘিরে ফেলে বুকের ডান দিকে গুলি করেছিল। যখন অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন তখন কাপুরুষের মতো পাক সেনা তাঁকে ‘পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ’ থেকে ডান কানের ভিতরে গুলি করে। তার আগে পাথর দিয়ে ডান হাঁটুর মালাইচাকি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সবশেষে ভোজালি দিয়ে শতবার কোপানো হয়। জেহাদি মানসিকতা থেকেই ‘শত্রু সেনা’র প্রতি এটা করেছিল পাক সেনা। এভাবে মারা হয়েছিল কারগিলের যুদ্ধবন্দি ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা এবং সৌরভ কালিয়াকেও। অজয়ের মৃতদেহ বিকৃত করে ১৯৯৯ সালের ২৮ মে ফেরত দিয়েছিল পাকিস্তান। তাঁর বীরত্বকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ওই বছর কারগিল যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা দিবসের দিন অজয় আহুজাকে মরণোত্তর বীর চক্রে সম্মানিত করেছিল ভারত সরকার।
পরে গোয়েন্দা তথ্যে জানা গিয়েছিল, ধরা পড়ার পর চ্যালেঞ্জ না করে গুলি না ছুঁড়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন নচিকেতা। তাই তাঁকে জীবিত রেখেছিল পাক সেনা ও জেহাদিরা। উলটোটা করায় খুন করা হয়েছিল অজয় আহুজাকে। যুদ্ধবন্দিদের প্রতি আন্তর্জাতিক আইন মেনে ব্যবহার করার সুনাম নেই পাকিস্তানের। তবে ঘটনাক্রম বলছে, হিসেব ঠিক হলে উইং কমান্ডার অভিনন্দনকে সুস্থ অবস্থায় ফেরত পেতে পারে ভারত। তাঁকে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ ভারত সরকারের কাছে।
The post কারগিলে যুদ্ধবন্দি বায়ুসেনার দুই পাইলট নচিকেতা ও অজয় আহুজার কী পরিণতি হয়েছিল? appeared first on Sangbad Pratidin.