সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: ছোট ছোট টিলা, রুখা মাটি। আবার লম্বা টানা পাহাড়ে ঘন জঙ্গল, নীল জলরাশি। ঝুমুর, ছৌ-এর পদধ্বনি। ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো পুরুলিয়ার (Purulia) এই ল্যান্ডস্কেপ। এই নৈসর্গিক দৃশ্য এবং লোকচিত্রকে যিনি টলিউড-বলিউডের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন, তিনি প্রয়াত কবি- পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (Buddhadeb Dasgupta)। তাঁর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ পুরুলিয়া। তাঁর সঙ্গে যে গত সাত দশকেরও বেশি সময়ের নিবিড় যোগাযোগ এই জেলার। ১৯৪৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পাড়া থানার আনাড়ার রেল কোয়ার্টারে জন্ম বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর। বাবা তারাকান্ত দাশগুপ্ত সেইসময় আনাড়া রেল হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন। ফলে তাঁর শৈশবের একটা অংশ এখানেই কেটেছে। আজ, পরিচালকের বিদায়বেলায় তাই বিষণ্ণ পুরুলিয়া।
আশৈশবের নাড়ির টান। তাই বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত নিজের একাধিক ছবির শুটিং লোকেশন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন পুরুলিয়াকে। ‘উত্তরা’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘জানালা’, ‘টোপ’, হিন্দি ছবি ‘ও’ র শুটিং হয় এখানে। পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি ছাড়াও একাধিক স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিও এই জেলার মাটিতেই শুট করেন তিনি। এই জেলার সংস্কৃতির সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। আদ্রা উৎসব, জয়চণ্ডী পাহাড় পর্যটন উৎসবের উদ্বোধন হয় তাঁর হাত ধরে।তাই পরিচালকের প্রয়াণে শোকে পাথর রুখাশুখা এই জেলা। তাঁর স্মৃতিতে ডুব দিয়েছেন এখানকার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব-সহ শিল্পীরা।
[আরও পড়ুন: প্রয়াত বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে শ্রদ্ধা জানিয়ে টুইট প্রধানমন্ত্রীর, সমবেদনা জানালেন মুখ্যমন্ত্রীও]
সাবেক মানভূমের এই জেলার একাধিক অভিনয় প্রতিভাকে তিনি হাত ধরে সিনেমা জগতে নিয়ে এসেছিলেন। অনুপ মুখোপাধ্যায়, পাপিয়া মুখোপাধ্যায়, কুচিল মুখোপাধ্যায়, স্বরূপ দত্ত, স্বাতী দত্ত, সুদিন অধিকারীর মত শিল্পীদের সিনেমার পর্দায় জায়গা করে দেন তিনি। তাই কবি-পরিচালকের প্রয়াণের খবর সাতসকালে পাওয়ার পরেই মন ভালো নেই এই রুখা ভূমির। তাঁর ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি একাধিক ছবিতে স্থির চিত্রের কাজ করেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পুরুলিয়ার ফটোগ্রাফার স্বরূপ দত্ত। তাঁর কথায়, “সিনেমা জগতে আমার যতটুকু খ্যাতি ও সম্মান মিলেছে, সবটাই তাঁর জন্য। আমার পরিবারের সঙ্গে পরিচালকের একটা আলাদা সম্পর্ক ছিল। আমি যে তাঁর কত ছবি তুলেছি তার হিসাব নেই। ডেস্কটপে থাকা সেই সব সাদাকালো ছবি দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারছি না।”
[আরও পড়ুন: নুসরতের বিবৃতির পরই ইঙ্গিতপূর্ণ পোস্ট যশের, কাকে কটাক্ষ করলেন অভিনেতা?]
কবি লিখেছিলেন, “সুইচ টিপলেই ছবি উঠবে, কী আর/ বেশি কথা/ সেই ছবি কি তুলতে পারো/স্বপ্ন দিয়ে গাঁথা?” স্বরূপ বলছিলেন, “পরিচালকের কর্মজীবনের যত ছবি রয়েছে তার অধিকাংশই আমার তোলা।” স্মৃতিমেদুর পুরুলিয়া এখন ইউটিউবে পরিচালকের ছবিতেই ডুবে রয়েছে। ১৯৯৯ সালে পুরুলিয়ার একাধিক ল্যান্ডস্কেপে শুটিং হওয়া ‘উত্তরা’ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কারের শিরোপা পান পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। একদল নাটুয়া শিল্পী মুখোশ পড়ে গাইছেন, “কালো জলে কুচলা তলে ডুবল সনাতন/ আজ সারানা কাল সারানা পাই যে দর্শন”। পরিচালকের প্রয়াণে ‘উত্তরা’ ছবির এই লোকগান যেন কানে বাজছে পুরুলিয়ার জয়পুরের আগরপুর-নারায়ণপুর ডুঙরিতে। আজ পুরুলিয়ার যেসব লোকেশন টলিউড-বলিউডের অন্যতম ঠিকানা। তার সব কটিরই আবিষ্কর্তা প্রয়াত পরিচালক। তাঁর ছবিতে কাজ করা পুরুলিয়ার সাংস্কৃতিক কর্মী সুদিন অধিকারী বলেন, “সত্যজিৎ রায়ের পর পুরুলিয়ার রূপ চিত্রকে যিনি সিনেমার পর্দায় সবচেয়ে বেশি ভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর নাম বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তিনি বরাবর তাঁর ছবিতে স্থানীয় শিল্পীদেরকে জায়গা করে দিতেন। ২০০৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত এই জেলায় একাধিক ছবির শুটিং করেছিলেন তিনি।”
দেখুন ভিডিও:
মহাশ্বেতা দেবীর ১৩ টি গল্প নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৩টি কবিতা নিয়েও এই জেলায় ছবি নির্মাণ করেন পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। সেই ‘ক্যামেলিয়া’ ছবিতে অভিনয় করা সাঁওতালি বিনোদন জগতের বিখ্যাত অভিনেত্রী তথা রাজ্যের বন দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী বীরবাহা হাঁসদা বলেন, “খুব সকালেই খবরটা পেয়ে কেমন যেন থমকে গিয়েছিলাম। উনি শুধু নামকরা পরিচালকই নন, ভাল মানুষ ছিলেন। আমার সঙ্গে প্রথম আলাপেই উনি আমাকে আপন করে নিয়েছিলেন। পুরুলিয়ায় ওই ছবির কাজ করার সেইসব ঘটনাগুলো আজ চোখের সামনে ভাসছে।” সেই স্মৃতিকেই আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় পুরুলিয়া। আড়শার সেনাবোনা হাট, বেলকুড়ির আমবাগান, আঘরপুর ডুঙরিতে আর তিনি বলবেন না “রোল, ক্যামেরা, অ্যাকশন…।”