বিশ্বদীপ দে: আজ সেই দিন। উমা কৈলাসে ফিরে গিয়েছেন। এবার পালা লক্ষ্মীর (Lakshmi) আরাধনার। সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি, সৌন্দর্য, উর্বরতা ও ধনসম্পদের দেবী আসবেন গৃহস্থের বাড়িতে। গভীর রাতে দৈবী পাদস্পর্শের অলৌকিক মহিমায় আলোকিত হবে ঘরদুয়ার। সমুদ্রমন্থন করে একদা যাঁকে ফিরে পেয়েছিলেন দেবতারা। কিন্তু মা লক্ষ্মী কেন স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিলেন? কেন তাঁকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল সমুদ্রগর্ভে?
সেকথায় যাওয়ার আগে একবার দেখে নেওয়া যাক এবঙ্গে লক্ষ্মীপুজোর ইতিহাসকে। নীহাররঞ্জন রায় তার ‘বাঙালীর ইতিহাস’ বইয়ে লিখেছেন, ‘এই লক্ষ্মী কৃষি সমাজের মানস-কল্পনার সৃষ্টি; শস্য-প্রাচূর্যের এবং সমৃদ্ধির তিনি দেবী। এই লক্ষ্মীর পূজা (Lakshmi Puja) ঘটলক্ষ্মী বা ধান্যশীর্ষপূর্ণ চিত্রাঙ্কিত ঘটের পূজা।’ তাঁর দাবি, মোটামুটি ভাবে দ্বাদশ শতক থেকেই কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর প্রচলন হয়। দুর্গাপুজোর বিসর্জনের বাদ্যি বেজে ওঠার সঙ্গেই অপেক্ষা শুরু হয় গৃহস্থের। বিশ্বাস, কোজাগরী রাতে ধরাধামে আবির্ভূত হন দেবী। যে ভক্ত রাত জেগে তাঁর উপাসনা করেন তিনি পান মা লক্ষ্মীর আশীর্বাদ। শাস্ত্রমতে, লক্ষ্মীর চার হাত। প্রতিটি হাতের আলাদা মাহাত্ম্য। ধর্ম, কর্ম, অর্থ ও মোক্ষ। অর্থাৎ তাঁর কৃপা পেলে সবদিক থেকেই সৌভাগ্যপ্রাপ্ত হন ভক্ত।
[আরও পড়ুন: ‘ধর্ষণ, লুঠ, ডাকাতিতে মুসলিমরাই এক নম্বর’, সংখ্যালঘু নেতার মন্তব্যে তুঙ্গে বিতর্ক]
কথিত রয়েছে, একদা লক্ষ্মীহীন হয়ে পড়েছিল স্বর্গ। আর এর পিছনে রয়েছে দুর্বাসা মুনির অভিশাপ। আসলে দুর্বাসা পারিজাত ফুলের মালা উপহার দিয়েছিলেন ইন্দ্রকে। কিন্তু দেবরাজ সেই মালা নাকি ঐরাবতের দিকে ছুড়ে দেন। আর ঐরাবতও সেই মালা নিজের পায়ে দলে দেয়। স্বাভাবিক ভাবেই এমন বিষয়কে ভালো চোখে দেখেননি দুর্বাসা। তার উপরে তাঁর মেজাজও যে বিশেষ সুবিধার নয় সেকথা সকলেরই জানা! তিনি বেজায় ক্ষিপ্ত হলেন। আর দিয়ে বসলেন অভিশাপ। কিন্তু কাকে? না লক্ষ্মীকে। আসলে দুর্বাসা অভিশাপ দিয়েছিলেন, স্বর্গ এবার লক্ষ্ণীহীন হয়ে পড়ুক। ফলে একদিকে যেমন স্বর্গ তার জৌলুস হারাল, অন্যদিকে মা লক্ষ্মীর স্থান হল সমুদ্রগর্ভে।
এর পরই হয় সমুদ্রমন্থন। যাকে ঘিরে দেবাসুরে লেগে যায় তুলকালাম কাণ্ড। সমুদ্রমন্থনেই উঠেছিল গরল ও অমৃত। উঠেছিল নানা মণিমানিক্যের সম্ভার। এর মধ্যে অমৃত নিয়ে প্রবল টানাটানির গল্প আমাদের সকলেরই জানা। রাহু ও কেতু দেবতা সেজে অমৃত খেতে গিয়ে কী নাকাল হয়েছিল তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে গ্রহণের পৌরাণিক ব্যাখ্যাও। আর এসবের পাশাপাশি এই সমুদ্রমন্থনের সময়ই বিষ্ণু ফিরে পেয়েছিলেন লক্ষ্মীকে।
[আরও পড়ুন: পাতায় পাতায় বিপুল লেনদেনের হিসাব! আর কী রয়েছে জ্যোতিপ্রিয়র নাম লেখা ‘মেরুন ডায়েরি’তে?]
অবশ্য ভিন্ন কাহিনিও রয়েছে। স্কন্দ পুরাণে বলা হয়েছে, নারায়ণকে স্বামী হিসেবে পেতে লক্ষ্মী সমুদ্রের গর্ভে প্রবেশ করে বছরের পর বছর ধরে কঠোর তপস্যা করেছিলেন। আর সেই সময় বহু দেবতাই ছদ্মবেশে লক্ষ্মীর সামনে আসেন। কিন্তু লক্ষ্মী তাঁদের বিশ্বরূপ দেখাতে বলেন। স্বাভাবিক ভাবেই যা কেবল বিষ্ণুই দেখাতে পারেন। ফলে অন্য দেবতারা রণে ভঙ্গ দেন সহজেই। শেষপর্যন্ত দেখা দেন নারায়ণ। তাঁর সঙ্গেই বিয়ে হয় লক্ষ্মীর।
তবে ভারতে লক্ষ্মী কেবল হিন্দুদেরই পূজিতা নন। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মেও উল্লেখ রয়েছে তাঁর। বৌদ্ধ জাতকে পাই, দুর্ভাগ্যকে দূর করতে লক্ষ্মীর আরাধনা করছেন বিপন্ন নারী-পুরুষরা। দুর্ভাগ্যের দেবী কলঙ্কিনীর কবল থেকে বাঁচাতে তাঁরই উপাসনা করতে দেখা যায় তাঁদের। আবার ‘অভিধানপ্পদীপিকা’ ও ‘সিরি-কালকন্নি’ জাতকেও দেখা মেলে দেবী লক্ষ্মীর।
পাশাপাশি জৈন ধর্মেও দেখা পেলে দেবী লক্ষ্মীর। তীর্থঙ্কর তথা মহাবীরের জন্মের আগে তাঁর মা স্বপ্নে অনেকগুলি শুভ জিনিসের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দেবী শ্রী। এছাড়াও তাঁর স্বপ্নে ভেসে উঠেছিল পাত্র, রত্নের স্তূপ, নাগ, যক্ষ, ঘোড়া, হাতি, শঙ্খ, সিংহাসন, ইচ্ছাপূরণকারী গাছ।
লক্ষ্মীকে ঘিরে পৌরাণিক আখ্যান কিংবা অন্য ধর্মে তাঁর উল্লেখের পাশাপাশি লোককথাও রয়েছে। যেমন, অলক্ষ্মী বিদায়ের আখ্যান। এক রাজার কাছে মূর্তি বিক্রি করতে আসেন এক কারিগর। রাজা কথাও দেন, তাঁর কাছে যে মূর্তিই থাকুক সেটাই তিনি কিনবেন। কিন্তু তাতেই ঘটে গেল গণ্ডগোল। কেননা ওই শিল্পীর কাছে ছিল একটিই মাত্র মূর্তি। সেটি অলক্ষ্মীর। আর তাতেই তাঁর রাজ্যে দেখা দিল দুর্যোগের ঘনঘটা। শেষ পর্যন্ত সেই রাজ্যের হারানো শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে দিলেন দেবী লক্ষ্মী। তাঁকে আহ্বান করতে তিনি লক্ষ্মীপুজো করেছিলেন সেই রাজা। তবে সেই পুজো আসলে অলক্ষ্মী বিদায়। যেটা দীপাবলির সন্ধ্যাতেই সম্পন্ন হয়। প্রথমে অলক্ষ্মীকে বিদায় করে তারপর লক্ষ্মীকে আহ্বান করে গৃহিণীরা লক্ষ্মীর আরাধনা করেন।
এভাবেই পুরাণ ও লোককথায় মিশে রয়েছেন লক্ষ্মী। তবে বাঙালি হিন্দুর কাছে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি মা দুর্গার সন্তান। যিনি কয়েকদিন আগেই সপরিবারে ঘুরে গিয়েছেন। এবার তাঁর একাই পূজিতা হওয়ার পালা। শনিবার রাতে যাঁর পদধূলি পড়বে এবঙ্গে। যাঁর অপেক্ষায় রাতে জেগে বসে থাকবেন গৃহস্থ। এই আধুনিক পৃথিবী পুরাণ ও মঙ্গলকাব্যের সময়কাল থেকে যতই দূরে সরে যাক, আজও মানুষের মনের স্থির বিশ্বাসে জ্যোৎস্নায় ভরে থাকা উঠোনে পড়ে লক্ষ্মীর শ্রীচরণ। দেবী জানতে চান, ”কে জেগে আছ?” সেই কোজাগরী লক্ষ্মীর আশায় আজও রাত জাগে মানুষ।