বাজার-বিনিয়োগ-পুঁজি-লাভ কিংবা লোকসান। অনেকের কাছেই এগুলো খুব ভারী ভারী শব্দ। ‘মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়’, গোছের। কারও ক্ষেত্রে আবার জানার বা বোঝার উৎসাহ থাকলেও তাঁরা বিভ্রান্ত সঠিক পরামর্শদাতার অভাবে। মনের অন্ধকার মেটান, আগে বিষয়গুলি বিশদে জানুন। আমি-আপনি, আমরা প্রত্যেকেই সকালে চোখ খোলা থেকে শুরু করে রাতে শুতে যাওয়া পর্যন্ত এই বাজারেরই অংশ। তাই এর হাল-হকিকত সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা আমাদের সকলেরই দরকার। লিখলেন শীর্ষেন্দু ভট্টাচার্য
দীর্ঘদিন বাদে আমার স্কুলের ছোটবেলার বন্ধু নির্মাল্যর বাড়িতে গিয়েছিলাম নিখাদ আড্ডা মারতে। কিন্তু কথায় আছে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে! তা এ কথা সে কথায় হঠাৎই উঠল ‘ফাইনান্সিয়াল ফ্রিডম’ বা আর্থিক স্বাধীনতার প্রসঙ্গ। সঠিক সময়ে আর্থিক পরিকল্পনার গুরুত্ব ইত্যাদি নিয়ে আমাদের আলোচনা চলল। কথাবার্তার মাঝে আচমকাই যেন জোঁকের মুখে নুন পড়ার মতো ছিটকে গুটিয়ে গেল নির্মাল্য! ‘মিউচুয়াল ফান্ড’-এই একটি শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল মুখের অভিব্যক্তি। তারপর অবশ্য অনেক অনেক কথা হল। পরিশেষে নির্যাস যা বেরোল-তার পর নির্মাল্যর স্বগোতোক্তি, “সত্যিই মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে আমার সব বিভ্রান্তি আজ ভেঙে গিয়েছে।” শুধু তাই নয়, তারপর শুরু হল দোষারোপের পালা-আমরা কেন সেভাবে সাধারণ মানুষের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে পারছি না! স্বীকার করে নিলাম, সত্যিই কিছু ব্যর্থতা তো নিশ্চয়ই আমাদের রয়েছে। আমাদের অনেক বেশি করে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাহাযে্য আমজনতার কাছে পৌঁছতে হবে এবং সঠিক বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। বলা যেতে পারে, ওঁরই অনুপ্রেরণায় এই কলম ধরা।
[আরও পড়ুন: তীরে এসে তরী যেন না ডোবে, অবসরে সতর্ক থাকুন আর্থিক প্রতিবন্ধকতার ঝুঁকি থেকে]
ইনভেস্টমেন্ট ও সঞ্চয় সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণাটা আজকের দিনে আরেকটু স্বচ্ছ ও স্পষ্ট হওয়া বিশেষ প্রয়োজন। ধরুন, আপনি কোনও একটি জায়গায় কিছু টাকা নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য জমা রাখলেন। মেয়াদের শেষে ওই জমা টাকা আর তার সঙ্গে আরও কিছু বাড়তি বা অতিরিক্ত টাকা পেলেন, মূলত সাধারণত মানুষ সেই আশাতেই টাকা জমান। এমন হিসেব কষে দেখা গেল, আপনি যে পরিমাণ বাড়তি বা অতিরিক্ত মূল্য পেয়েছেন তা বার্ষিক শতকরার হিসাবে ৫ টাকা বা শতাংশ। এমন সময় যার ভূমিকা সবথেকে বেশি, তার নাম হল মুদ্রাস্ফীতি তথা বহুল চর্চিত ‘ইনফ্লেশন’। সোজা কথায় মুদ্রাস্ফীতি হল এক মুদ্রারাক্ষস। রোজ একটু একটু করে যা নিঃশব্দে আপনার, আমার কষ্টার্জিত টাকা খেয়ে চলেছে। এটা খালি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু বাস্তবে আমরা রোজ অনুভব করছি। সাধারণ মানুষ আলু, পটল পেট্রোল কিনতে গিয়ে প্রতিনিয়ত এর প্রভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সোজা কথায়, মুদ্রাস্ফীতি আমার আপনার টাকার ক্রয়মূল্য কমিয়ে দিচ্ছে।
ফিরে আসি আগের আলোচনায়। ধরা যাক, আজকের দিনে সরকার ঘোষিত মুদ্রাস্ফীতির হার ৬ টাকা বা শতাংশ আর আপনি মূলধন লাভ পেলেন ৫ টাকা। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে আপনার মূলধনী-লাভ দাঁড়াল নেগেটিভ বা -১ টাকা। আর ওই ৫ টাকার উপর যদি আয়কর দিতে হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা!
এই আলোচনার মূল নির্যাস সাধারণ মানুষ এইভাবে বুঝতে পারেন যে আপনি টাকা জমিয়েছেন বা সেভিংস করেছেন কিন্তু প্রকৃত অর্থে ইনভেস্টমেন্ট করে উঠতে পারেননি। মানে বাজারে ঘোষিত মুদ্রাস্ফীতির হারকে পরাজিত করে তার উপর যদি কোনও রিটার্ন বা লাভ করেন তখনই তাকে ইনভেস্টমেন্ট বলতে পারেন।
এই ইনভেস্টমেন্ট বিষয়টিকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক, DEBT অর্থাৎ ধার বা ঋণপত্র। আর দুই EQUITY মানে পুঁজি বা মূলধন।
একটু সোজাভাবে বোঝানো যাক। যেমন ধরুন, আপনি স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়াতে একটি ফিক্সড ডিপোজিট (FD) করলেন, নির্দিষ্ট মেয়াদের শেষে আপনি আপনার টাকা আর নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদ ফেরত পাবেন। স্টেট ব্যাংক ব্যবসা করে কত পরিমাণ লাভ বা ক্ষতি করেছে, তা নিয়ে আপনার মাথাব্যথার কোনও কারণ নেই। এবার একটু অন্যভাবে ভাবুন। ধরুন, আপনি ওই সম পরিমাণ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট না করে স্টেট ব্যাংকের কিছু শেয়ার কিনলেন। এবার কিন্তু ওই ব্যাংকের লাভ ক্ষতির সঙ্গে আপনার স্বার্থ জড়িয়ে আছে। এখন স্টেট ব্যাংক যদি ভাল ব্যবসা করে মানে লাভ করে, বাজারে শেয়ারের চাহিদা বাড়বে। মানে আপনার শেয়ারের দাম বাড়বে। আপনি শেয়ার বেচে অনেক মুনাফা করবেন। এটা শুনে যত সোজা মনে হচ্ছে, আসলে কাজটা ততটা সোজা নয়। এর জন্য একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ লাগে। মানে কোন শেয়ার কখন ধরতে হবে ও কখন ছেড়ে দিতে হবে, বিশেষজ্ঞই সঠিক পথ দেখাবেন।
আর এখানেই লুকিয়ে আছে মিউচুয়াল ফান্ডের লগ্নির সাফল্য ও সাফল্যের ইতিহাস। প্রতিটি মিউচুয়াল ফান্ড স্কিমে একজন দক্ষ ফান্ড ম্যানেজার থাকেন। যিনি আপনার আমার হয়ে সর্বক্ষণ কাজ করে চলেছেন। তিনি জানেন কখন মার্কেটে লগ্নি করা উচিত আর কখন মার্কেট থেকে প্রফিট বুক করা উচিত। আমাদের উচিত প্রথমেই ঠিক করা আমরা কতদিনের জন্য বিনিয়োগ করব। এখানে একদিনের জন্যও টাকা রাখা যায় আবার সাতদিনের জন্য, একমাসের জন্য, তিনমাসের জন্য, এক বছরের জন্য, দশ বছরের জন্য এমনকী কুড়ি বছরের জন্যও টাকা রাখা যায়। আপনি আপনার আর্থিক পরিকল্পনা অনুযায়ী আপনার লক্ষ্য স্থির রেখে টাকা জমাতে থাকুন। তা না করে আমরা মাঝে মাঝে উল্টোটা করে বসি। যেমন মার্কেট পড়ে গেলে পারলে আরও আরও বেশি করে টাকা রাখতে পারেন। কারণ এখন শেয়ারের দাম সস্তা। আর তা না করে শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করে, আতঙ্কিত হয়ে ফান্ড বেচে দিলে, আপনি অনর্থক ক্ষতির শিকার হবেন। আসলে শেয়ার বাজারের ওঠাপড়া খুব সাধারণ বিষয়। বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যাক্তির উপর ভরসা রাখুন, আপনি বিগত দশবছরের যে কোনও ভাল ফান্ডের ট্র্যাক রিপোর্ট ‘চেক’ করে দেখতে পারেন, কোনওভাবেই হতাশ হবেন না।
সবথেকে বড় কথা হল, মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে আপনি ডেট, ইকুইটি বা এই দুয়ের মিশ্রণ মানে হাইব্রিড, অর্থাৎ সবরকম জায়গায় বিনিয়োগ করতে পারবেন। সমস্ত বড় বড় কোম্পানি ও ব্যাংকও এখানে লগ্নি করে। আরও একটি নিশ্চিন্ত থাকার উপায় হল-মিউচুয়াল ফান্ডের ম্যানেজার কোনও একটি নির্দিষ্ট শেয়ার সম্পূর্ণ বিনিয়োগ করেন না। যেমন ধরুন, আপনি মাসে মাসে দশ হাজার টাকা বিনিয়োগ শুরু করলেন। এবার আপনার ফান্ডের ওই স্কিমটি বিভিন্ন সেক্টরে টাকা বিনিয়োগ করবে, যেমন গাড়ি শিল্প বা অটো মোবাইল সেক্টরে, ওষুধ শিল্প বা ফার্মা সেক্টরে, ব্যাংকিং সেক্টরে প্রভৃতি। অর্থাৎ কোনও একটি সেক্টরে এক সময় মন্দা থাকলেও অন্য সেক্টরগুলি ভাল ব্যবসা করার দরুণ আপনি আপনার পরিকল্পিত রিটার্ন ঠিক ঠিক পেতে থাকেন। আর আপনার বিনিয়োগের ঝুঁকি পরিকল্পিতভাবে বিভাজন করা থাকে।
এখন কথা হচ্ছে, বর্তমান বাজার অর্থনীতিতে ইকুইটি একটি অবিচ্ছিন্ন বিষয়। আমি আপনি চাইলেও উপেক্ষা করতে পারি না। আমরা সকালে ঘুম থেকে উঠে মোবাইল খোলার পর থেকে রাতে শুতে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে পরোক্ষভাবে বাজারে অংশ গ্রহণ করে চলেছি। উদাহরণস্বরূপ যেমন ধরুন, এই লেখা যে আপনি ধৈর্য্য ধরে পড়ছেন, এখানে অনেকগুলি কোম্পানি ব্যবসা করছে। কাগজে পড়লে কাগজ কোম্পানি, মোবাইলে ফোনে পড়লে মোবাইল ইন্টারনেট প্রদানকারী কোম্পানি, ইলেক্ট্রিসিটি কোম্পানি, চোখে চশমা থাকলে চশমার কোম্পানি। একটু হয়তো চায়ে হালকা চুমুক দিলেন, সেক্ষত্রে চায়ের কোম্পানি, দুধের কোম্পানি, চিনির কোম্পানি, জ্বালানি কোম্পানি-সকলেই ব্যবসা করে নিল।
ছোটবেলা থেকেই আমরা জেনে বুঝে এসেছি, ব্যবসা করলেই বড়লোক বা ধনী হওয়া যায়। আশেপাশে এমন প্রচুর সফল মানুষও আমরা দেখেছি। এবার আপনিও উঠে পড়ুন, বুঝুন-সময় হয়েছে, এবার জাগতে হবে। আমাদের সকলের পক্ষেই এগোনো সম্ভব। আম্বানি, আদানি, টাটা বিড়লাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব এভাবেই গড়ে তোলা সম্ভব। আর এখানেই মিউচুয়াল ফান্ডের স্বার্থকতা। আমার, আপনার প্রকৃত আর্থিক স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া সম্ভব।
[আরও পড়ুন: স্বাস্থ্য বিমা করছেন, জেনে নিন মাথায় রাখবেন কোন বিষয়গুলি]
পরিশেষে বলি, ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ব্রিটিশদের বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হয়েছিল। আর তা সম্ভব নয়। আমাদের দেশের ব্যবসার অংশীদার আপনি-আমি-আমরা সকলেই। প্রয়োজন নেই কোনও বিদেশি পুঁজির উপর নির্ভরতা। আমাদের দেশের অর্থনীতির বিকাশে আমরাই যথেষ্ট। নতুন ভোর, নতুন সূর্য, নতুন আশার আলোই আমাদের স্বপ্ন। আমাদের নতুন ভারতবর্ষকে বিশ্বের দরবারে এভাবেই গড়ে তুলব, মেলে ধরব। সম্পূর্ণ নতুনভাবে। প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসাবে অন্তত এটাই হোক আমাদের সকলের দৃঢ় অঙ্গীকার।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ,
ওয়েলথ কোচ, সাফল্য ও
সমৃদ্ধি এলএলপি