সুদীপ রায়চৌধুরী: প্রবল গ্রীষ্ম বিকেলে হালিম-উল্লাসে মেতে উঠেছে তামাম কলকাতা। রমজান মাসে সারাদিন রোজার পর সন্ধেয় উপোস ভাঙার ইফতারি আসরে হালিমের সঙ্গত ঠিক যেন শরতের সন্ধেয় বড়ে গোলাম আলির গলায় শ্যামকল্যাণ রাগ। ‘এক’কে বাদ দিলে ‘অন্য’টা সত্য নয়।
সাতের দশকে রোল, আটের দশকে চাইনিজ পেরিয়ে নয়ের দশক বাঙালি মেতেছিল বিরিয়ানির প্রেমে। ক’বছর রমজান এলেই আমবাঙালির বিরিয়ানি প্রেম পালটে যাচ্ছে হালিমের শৃঙ্গার রসে। এপ্রিলে বিকেল হতে কলকাতার চিৎপুরের রয়্যাল, খিদিরপুরের ইন্ডিয়া থেকে দক্ষিণ কলকাতার সেনসেশন হ্যাংলাথোরিয়াম- সব রেস্তরাঁর সামনে হালিম ভক্তদের লম্বা কিউ। সন্ধেয় বহু দোকানে বিক্রিবাটাও শেষ।
অথচ এদেশের মোগল পাকশালে হালিম নেহাতই নবীন সদস্য। পারস্য সম্রাটের শাহি দস্তরখান থেকে ষোড়শ শতকে মোগল সম্রাট হুমায়ুনের হাত ধরে এদেশে পা এই পদের। কিন্তু হালিমের ভারত জয় তার অনেক পরে। হায়দরাবাদে নিজামের তুর্কি সেনাদের দস্তরখান থেকে। ষষ্ঠ শতকে পারস্যদেশে তৎকালীন সম্রাট খুসরোর আমলে ডাল-গম-মাংস-মশল্লায় তৈরি হালিমের জন্ম। তখন তার নাম অবশ্য ‘হারিশ’। তীর্থযাত্রী ও পর্যটকদের হাত ঘুরে পরের শতকে তা পৌঁছয় তুরস্কের খলিফার প্রাসাদে। সেখান থেকে আরব দুনিয়া রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ে হারিশের পরিচিতি। নিজামের পাকশালে সেই ‘হারিশ’ নাম পালটে হয় ‘হালিম’।
[আরও পড়ুন: নিজের নাতনিকে চুরি করে নিঃসন্তান প্রেমিকাকে উপহার! উত্তরপ্রদেশে গ্রেপ্তার অভিযুক্ত দাদু]
বিরিয়ানির মতো এদেশে দুই কিসিমের হালিম জনপ্রিয়তম – হায়দরাবাদি ও আওয়াধি। হায়দরাবাদি হালিম থকথকে, মাংস, ডাল ও গমের পেস্ট। আওয়াধি তরল প্রকৃতির। কলকাতায় এই আওয়াধি ঘরানার চল। যদিও এবছর হায়দরাবাদি হালিমের রমরমা চোখে পড়ার মতো। কলকাতার এক রেস্তরাঁ চেনের মালিক সুনন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় বা খাদ্য গবেষক ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ীদের আওয়াধি থুড়ি কলকাতা ঘরানাই বেশি পছন্দের। হালিম বলতেই কলকাতার যে নাম মনে আসে, সেই জাকারিয়া স্ট্রিটের সুফিয়া, চিৎপুরের রয়্যাল, ধর্মতলার নিউ আলিয়া, আমিনিয়া, সিরাজ, পার্ক সার্কাসের সিরাজ বা খিদিরপুরের ইন্ডিয়া হোটেলে কলকাত্তাই হালিমই মেলে। মুসলিম হোটেলের পরিচিত ডালগোস্ত ও হালিমের ফারাক কোথায়? সুনন্দবাবুর কথায়, ডালগোস্ত হয় একরকম ডাল ও মাংস দিয়ে। হালিমে অন্তত ৫ রকম ডাল পড়ে। সঙ্গে গোবিন্দভোগ চাল, গম ও হরেক কিসিমের মশল্লা। যার একটি বিশেষ গাছের শিকড়।
আজন্ম বিরিয়ানিপ্রেমী বঙ্গজনতার রমজান আসলেই এহেন হালিম উল্লাসের কারণ কী? ইন্দ্রজিৎবাবুর কথায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় খাবার সংক্রান্ত কনটেন্টগুলি এখন প্রবল জনপ্রিয়। সেই দেখে উৎসাহিত হচ্ছেন খাদ্যপ্রেমীরা। খাদ্য বিশেষজ্ঞ দেবজিৎ মজুমদারের যুক্তি, “হালিম বা বিরিয়ানির সুবিধা হচ্ছে খিদে পেলে অপেক্ষার প্রশ্ন নেই।”