বাংলা ইন্ডাস্ট্রি যে নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নয়, সেটা মেনে নেওয়ার সময় চলে এসেছে। ৭ জন অভিনেত্রী শেয়ার করলেন তাঁদের হয়রানির কথা। এবার টলিউডেও কি দরকার হেমা কমিটির রেপ্লিকা? লিখছেন বিদিশা চট্টোপাধ্যায়।
আর জি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে ঝড়, অন্যদিকে হেমা কমিটির রিপোর্ট ঘিরে মালয়ালম চলচ্চিত্র জগতে উত্তাল পরিস্থিতি। বাংলা ফিল্ম এবং থিয়েটার ইন্ডাস্ট্রি যে এর বাইরে নয়, তেমনটাই মনে করছেন আজকের প্রজন্মের এবং প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রীরা। সমসময়ের কথা মাথা রেখেই টলিউডে (Tollywood) কাজের পরিবেশ ঠিক রাখার দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়েছে “উইমেন’স ফোরাম ফর স্ক্রিন ওয়ার্কার্স প্লাস”। ইমপা, আর্টিস্ট ফোরাম, ফেডারেশন ও টেলি অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে এই চিঠি মেল করা হয়েছে। এখনও কোনও উত্তর আসেনি। সম্প্রতি যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে সোশাল মিডিয়াতে সরব হয়েছেন ঋতাভরী চক্রবর্তী, রূপাঞ্জনা মিত্র। অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র মালয়ালম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন।
ইন্ডাস্ট্রিতে হ্যারাসমেন্ট এবং বুলিংয়ের প্যাটার্ন বোঝার জন্য যোগাযোগ করেছিলাম তাঁদের সঙ্গে যাঁরা ‘উইমেন’স ফোরাম ফর স্ক্রিন ওয়ার্কার্স প্লাস’-এর চিঠিতে সই করেছেন। অনেকেই কখনও না কখনও হেনস্তার শিকার। নিজেদের পরিচয় প্রকাশ না করে শোনালেন সেই অভিজ্ঞতার কথা। বেশির ভাগই চান ‘হেমা কমিটি’র মতো বা এমন কোনও প্ল্যাটফর্ম, যেখানে তাঁরা নিঃসংকোচে নিজেদের অভিযোগ জানাতে পারবেন। ‘কম্প্রোমাইজ’ শব্দটা একাধিকবার উঠে এল। একই সঙ্গে অভিনেত্রীদের অশালীনভাবে অবজেক্টিফিকেশন, বডি শেমিং, নারীর প্রতি সেন্স অফ বাউন্ডারি না থাকা, পাওয়ার পজিশন ব্যবহার করে এক্সপ্লয়েট করা খুব বেশি চোখে পড়ে। কথা বলতে এগিয়ে এসে অনেক কিছু বললেন তাঁরা যার সবটা লিখতে বারণ করলেন। তাঁদের সম্মতি নিয়ে, পরিচয় প্রকাশ না করে কিছু ঘটনা তুলে ধরা হল।
১. আড্ডা মারার ছলে যৌন হয়রানি
২০১৬ সাল, কলকাতার পরিচিত প্রযোজক। পূর্বপরিচিত। আমি তখন মুম্বইয়ে ছিলাম, তিনিও মুম্বইয়ে। আমাকে দেখা করতে বলেন। দেখা করতে গিয়েছি। বেশ কিছুক্ষণ নর্মাল কথাবার্তা হওয়ার পর তিনি আমার উপর চড়াও হন। অসাড় হয়ে গিয়েছিলাম। আড্ডা মারার অভিসন্ধির পিছনে এটা ছিল বুঝিনি। তারপর আমি ওঁকে সরিয়ে দিই, খুব কিছু করতে পারেননি। এবং বেরিয়ে চলে আসি। এখন তাঁর সঙ্গে আমার হাই-হ্যালো-র সম্পর্ক। পরে একাধিকবার ঘরভর্তি লোকের সামনে বলেছিলেন, 'তোর সঙ্গে তো আমার সেক্স হয়নি, যদিও আমি ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম।' বোঝা যায়, নারী কেবলই মাংসপিণ্ড। এর বেশি কিছু মনে করে না। (এই প্রজন্মের অভিনেত্রী।)
২. নিভৃতে দেখা না করলে, বাদ পড়ার সম্ভাবনা
সব সময় হয়তো শারীরিক হেনস্তা হয় না, কিন্তু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে হয়। এক পরিচালক আমাকে বারবার মেসেজ করে বাড়িতে দেখা করতে বলেন। তিনি খুবই বিখ্যাত। প্রত্যেকবার কিছু না কিছু বলে কাটিয়ে দিয়েছি। তারপর থেকে পাবলিকলি দেখলে অ্যাকনলেজ করেন না। ধরা যাক কোনও পার্টিতে গিয়েছি সেখানে বলা হত একটু রাত অবধি থাকতে, আলাদা পার্টি হবে। আমার 'ভাইব' পছন্দ হয়নি, তাই যাইনি। আমি তাদের সঙ্গে কলিগ হিসাবে কাজ করতে পারি। কিন্তু তারপর থেকে কাজেও নেয়নি। পেশাদার জগতে একটা যে সেন্স অফ বাউন্ডারি থাকা প্রয়োজন সেটা কেউ ধর্তব্যের মধ্যেই রাখে না। (ওয়েব সিরিজ এবং সিনেমার নতুন মুখ এই অভিনেত্রী।)
৩. প্রযোজকের কাছে 'দেখাতে' নিয়ে যেতে হয়
একটা কথা আমাদের প্রায়ই শুনতে হয়। আমি একটা উদাহরণ দিচ্ছি। অডিশনে সিলেক্টেড হয়ে গিয়েছি। তখন মিটিংয়ে একঘর লোকের সামনে আমাকে উদ্দেশ করে বলা হয়, ‘দাঁড়াও, ওকে তো একবার প্রোডিউসারের কাছে নিয়ে যেতে হবে দেখানোর জন্য’। অডিশন, পারফরম্যান্স নয়, প্রোডিউসার আমাকে দেখবেন। সেই কাজটা আমি পাইনি। আরও একটা কমন ঘটনা হল, এই ধরনের যে কোনও মিটিংয়ে আমাকে অনেকবার বলা হয়েছে, ‘স্কিন শো’ হবে এমন পোশাক পরে আসতে হবে। “তোমার আগে যারা এসেছে তারা ‘কমপ্রোমাইজ’ করেছে, তুমি কোথাকার কে”– এই কথা আমাকে শুনতে হয়েছে। (ছোট পর্দা থেকে উঠে আসা অভিনেত্রী, ওয়েব প্ল্যাটফর্মে সফল।)
[আরও পড়ুন: জনপ্রিয় ফুটবলারকে মন দিয়েছেন ‘রানিমা’, দিতিপ্রিয়ার প্রেমিকের পরিচয় জানেন?]
৪.কাজের জন্য ডেকে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব
আমার তিন থেকে চারজন ছাত্রীর কাছে তো একজনের নামেই কমপ্লেন শুনি। এবং ঘটনাগুলো অলমোস্ট একধরনের। ছবিতে রোল আছে বলে ডাকছেন। নিজের সাফল্যের তালিকা পেশ করে বলছেন, ‘তুমি আমার জন্য কী করতে পারবে? অনেক রোগা হয়েছ, কোমরটা বেশ সরু, চলো আমরা বেড়াতে যাই’, কিংবা বলেছে, ‘আমার অফিসের পাশের রুমটা তো আছেই।’ দুটো জিনিস প্যারালালি ঘটে চলেছে। এক যাঁরা পুরস্কারপ্রাপ্ত, নামকরা, ব্লকবাস্টার দেওয়া প্রযোজক-পরিচালক তারা ক্ষমতার জোর দেখিয়ে হ্যারাস করছেন। আর একটা সেকশন হল, যাঁদের কেউ চেনে না, জানে না, তাঁরা অডিশন দেওয়ার নাম করে একেবারে অচেনা, আনকোরা অভিনয় করতে চাওয়া মেয়েদের হ্যারাস করছেন। আর আমি যেহেতু কাস্টিং করি। আমাকেও ফোন করে বলছেন, ‘বাকিটা তো জানো, ওটা নিশ্চয়ই তোমাকে বলতে হবে না, ওইটুকু তো করতেই হবে।’ (সিনিয়র অভিনেত্রী ও অ্যাক্টিং কোচ)
৫. হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো ফর্মে ছিল ‘কমপ্রোমাইজ’ শব্দটা
কাস্টিং ডিরেক্টররা অনেক সময় বিভিন্ন ক্রাইটেরিয়া জানতে চেয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ফর্ম পাঠান। সেখানে সব ধরনের ডিটেল প্রোভাইড করতে হয়। হাইট, গায়ের রং, হেয়ার কালার, আই কালার, বাইরে ট্রাভেল করতে পারবে কি না, কোনও স্কিল আছে কি না– এরকম নানা তথ্য দিতে হয়। ২০২৩ সালে এইরকম একটা ফর্ম আমার হোয়াটসঅ্যাপে আসে যেখানে একটা ‘ক্লজ’ ছিল ‘কমপ্রোমাইজ’-এ কমফর্টেবল কি না! আমাকে এও জানায়, "মুম্বই থেকে এইভাবেই ফর্ম পাঠানো হয়। তোমারই অনেক সহকর্মী হয়তো ‘ইয়েস’ লিখবে। তুমি চাইলে কমপ্রোমাইজ শব্দটা বাদ দিয়ে পাঠাতে পারো।" আসলে এমন ‘ফর্ম’ যে এগজিস্ট করে, দ্যাট টেলস এ লট অ্যাবাউট দ্য সিস্টেম। (মডেল-অভিনেত্রী)
[আরও পড়ুন: রাত ২টোয় রাস্তায় একাই ঘুরছেন মধুমিতা, মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে বড় বার্তা দিলেন অভিনেত্রী]
৬.ইন্ডাস্ট্রির মানুষ দ্বারা ব্যক্তিগত পরিসরে দীর্ঘদিন অ্যাবিউজড হয়েছি
আমার ঘটনাটা কর্মক্ষেত্রে না হলেও, যাঁর দ্বারা অ্যাবিউজড হয়েছি তিনি ইন্ডাস্ট্রির লোক। আমি খুব স্ট্রাগল করে এই ট্রমা কাটানোর চেষ্টা করেছি। আমি তখন টিনএজার। এবং এই হেনস্তা তিন-চার বছর ধরে চলেছে। আমার বাবা-মাকে বলতেও অনেক সময় লেগেছে। আমার অনেক বন্ধু আছে যারা ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে। তাদের সঙ্গে আমার কথা হয়। কম করে, দুদিন অন্তর কারও না কারও থেকে শুনি যে তারা মেন্টালি, ফিজিক্যালি বা সেক্সুয়ালি অ্যাবিউজের শিকার হয়েছেন। সেটা রাতে অশ্লীল মেসেজ থেকে শুরু করে যে কোনও এক্সটেন্ট-এ যেতে পারে। মেনে না নিলে কাজ পাবে না এই ভয়ও দেখানো হয়। এমনও মানুষ আছে যারা এটা নিয়ে দিনের পর দিন কথা বললেও, তাদের কথা কেউ শোনে না। তাই সবার কথা বলার জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম হওয়া দরকার। (একেবারে নতুন প্রজন্মের অভিনেত্রী যিনি ইতিমধ্যে বেশ কিছু ছবির অংশ হয়েছেন।)