ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য: অরূপ, রাজীব দুই বন্ধু। ভারী গলাগলি, যেন হরিহরআত্মা। বাল্যবন্ধু নয়, মাত্র মাসখানেক আগে মরণের কানাগলির মুখে দাঁড়িয়ে ওঁদের সখ্যতার সূত্রপাত। এখন কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারেন না। কিন্তু ছাড়তে তো হবেই।
দাঁত কামড়ানো জীবনযুদ্ধে মৃত্যুকে পরাজিত করে শনিবার অরূপ রায় ও রাজীব বাগ বেলেঘাটা আইডি হাসপাতাল থেকে নিজের নিজের বাড়ি ফিরলেন। অরূপের বাড়ি বেলঘরিয়া, রাজীব থাকেন সিঁথি মোড়ে। দুই যুবকেরই স্ত্রী-সন্তান আছে। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে দু’জনেই টানা একমাস আইডি-র আইসিইউয়ের বেডে শুয়ে প্রতি সেকেন্ডে মৃত্যুকে চাক্ষুষ করেছেন। দু’জনেরই শ্বাসনালি, মানে ট্র্যাকিয়া ফুটো হয়ে গিয়েছিল। শ্বাস নিলেও বাতাস ফুসফুসে না ঢুকে বাইরে বেরিয়ে আসত, যেমনটা বড় একটা দেখা যায় না। বুক-পিঠ-গলা ফুলে অসহ্য যন্ত্রণায় ঝরঝরিয়ে কাঁদতেন দু’জনে।পরম মমতায় পিঠে ভরসার হাত বুলিয়ে চোখ মুছিয়ে দিতেন ওঁদের ‘স্যার’ ডা. সায়ন্তন বন্দ্যোপাধ্যায়।
[আরও পড়ুন: অবসাদের জেরে আত্মহত্যা? খাস কলকাতায় বিজেপি কর্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘিরে চাঞ্চল্য]
এটুকু শুনে মনে হতে পারে, এই অতিমারির আবহে এমন রোগী কি অন্য হাসপাতালে নেই? থাকতেই পারেন। কিন্তু অরূপ-রাজীবের ফিরে আসাটা যেন গল্পকথা। আইডি-র ডাক্তারবাবুদের কাছে মস্ত প্রাপ্তিও। কী রকম?
অক্সিজেন স্যাচুরেশন তলানিতে। ট্র্যাকিয়া ফুটো, গলা-বুক ফুলে ঢোল। বুকে হাত দিলে মনে হতো ফুটবলের ব্লাডার, এমনই খসখসে। এহেন রোগীর চিকিৎসা কীভাবে করতে হয়, কোনও ডাক্তারি বই বা জার্নালে তা ষ্পষ্ট লেখা নেই। শুধুমাত্র ধারণা আর অভিজ্ঞতায় ভর করে গলায় সূঁচ ফুটিয়ে হাওয়া বার করা হতো, সজ্ঞান অবস্থায়। মুখে হাই ফ্লো ন্যাজল ক্যানুলা চেপে ধরা, অসহনীয় যন্ত্রণায় চোখের জলে বুক ভাসিয়ে আর্তনাদ।
১০ এপ্রিল কোভিড পজিটিভ হওয়ার পর বেসরকারি সংস্থার কর্মী অরূপ বাড়িতে চিকিৎসা করে খানিকটা ভালো ছিলেন। সাত-আট দিনের মাথায় হঠাৎ বুকে ব্যথা, তড়িঘড়ি আইডি-তে ভরতি। একই সময়ে দু-দু’টো হাসপাতাল ঘুরে আইডির লবিতে মাঝরাত পর্যন্ত স্ত্রীকে নিয়ে বসে থেকে বেড পেলেন রাজীব, যাঁর অক্সিজেন স্যাচুরেশন তখন ৬৫, বুকে ব্যথা, প্রবল শ্বাসকষ্ট।
যুদ্ধের সেই শুরু। দু’জনের অভিজ্ঞতা একই রকম, “জল থেকে তোলা মাছের মতো খাবি খাচ্ছিলাম। দুনিয়াটা শূন্য হয়ে গিয়েছিল। একটু ভালো থাকলে বন্ধুদের ফোন করে বলতাম, আর বাঁচব না, তাই ফোন করছি।” শুক্রবার মোবাইলে দুঃসহ দিনগুলোর বিবরণ দিলেন অরূপ-রাজীব, “রোজ দেখতাম, রাতে দিব্যি ভাল থাকা মানুষটা পরের দুপুরে প্লাস্টিক প্যাকে বন্দি হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।” চিকিৎসক কিন্তু হাল ছাড়েননি। সায়ন্তনবাবুর কথায়, “রোখ চেপে গিয়েছিল। এমন দু’টো তরতাজা প্রাণকে হারতে দেব না। তবে ওঁরাও প্রাণপণ লড়েছেন। বাঁচার অদম্য ইচ্ছের জোরে সুস্থ হয়ে উঠেছেন।”
[আরও পড়ুন: পামেলা কাণ্ডের জের! নিউ আলিপুর থানার ওসি বদল]
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বেশি অসুস্থ্ হচ্ছেন অল্পবয়সিরা। দেদার মৃত্যুও হচ্ছে। অনেকের এই ধরনের সমস্যা- ফুটো ট্র্যাকিয়া। ডাক্তারবাবুরা বলছেন, চিকিৎসার পাশাপাশি মনের জোর ও হার না মানা মেজাজটাও লড়াইয়ের বড় অস্ত্র। সেই হাতিয়ার শানিয়ে জয়ী হয়ে ফিরলেন রাজীব-অরূপ। হাঁটতে কষ্ট, হাত নাড়তে পারেন না। তবু দুই বন্ধু সমস্বরে বলছেন, “আমাদের দেখুন। এভাবেই ফিরে আসা যায়। আমরা পেরেছি, আপনারা কেন পারবেন না?”