রেলে কিছু হলে আমরা রে রে করে উঠি। সেই আবেগের মর্ম আজকের রেল শাসকরা বুঝবে না। ওড়িশার বালেশ্বরের অদূরে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটিতে সাধারণ মানুষের মৃত্যুমিছিল প্রমাণ করে দিয়ে গেল, রেল মানে শুধুই বন্দে ভারত নয়। রেল মানে সন্ধ্যার ভিড়ঠাসা বনগাঁ লোকালও। কলমে কিংশুক প্রামাণিক
১২৩১১ আপ ‘কালকা মেল’-এ চলেছি। দু’রাত থাকতে হবে ট্রেনে। শুনেছিলাম দূরপাল্লার ট্রেনগুলিতে নতুন কোচ এসেছে। টয়লেটও সুন্দর। হাওড়া স্টেশনে ভিআইপি ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দিয়েছে দেখে আরও খুশি হলাম। কিন্তু কোথায় কী!
ট্রেনের বাইরের চেহারা দেখেই মন ভেঙে গেল। ভিতরে গিয়ে দেখি হতশ্রী এসি টু টিয়ার। বিবর্ণ দশা। পর্দা, বেড রোল সবই বেশ পুরনো। আলো জ্বলছে না। লাগেজ সিটের নিচে রাখতে গিয়ে নজরে পড়ল ইঁদুর! দৌড়ে লুকিয়ে পড়ল। এই ইঁদুর কালকা যাবে। আবার ফিরে আসবে হাওড়া।
কুপে সহযাত্রী এক ভদ্রলোকও দেখলাম আমার মতোই বিরক্ত। বড় চাকরি করতেন। দশ বছর আগে অবসরের পর স্ত্রীকে নিয়ে ট্র্যাভেল এজেন্ট ধরে শুধুই বেড়াচ্ছেন। মাঝে মাঝে ট্রেনে চড়েন। আলাপ হতেই বললেন, ‘জানেন, নাইনটিন সেভেন্টি নাইনে আমি এই কালকা মেলে প্রথম ট্র্যাভেল করেছি। কী দারুণ ট্রেন ছিল! হাওড়া থেকে উত্তর ভারতের দূরপাল্লার প্রথম ট্রেন এটি। একটা সময় ছিল যখন হাওড়ার স্টেশন সুপার নিজে দাঁড়িয়ে ফ্ল্যাগ-অফ করতেন প্রতিদিন। এমনই এই ট্রেনের কৌলীন্য! আজ রেলের হাল খুব খারাপ মশাই। সব আলো সরে গিয়েছে একটি ট্রেনের দিকে। ডিসগাস্টিং!’
ভদ্রলোক থামলেন। বুঝতে অসুবিধা হল না, ‘একটি ট্রেন’ মানে কী বলতে চাইছেন। উনি ‘বন্দে ভারত’-এর কথা বলছেন। মনে হল, ভুল তো বলছেন না কিছু। এখন তো সত্যিই সব নজর ওই একটি ট্রেনেই। হইচই চলছে। কেন্দ্রীয় সরকার এমন ভাব করছে যেন দেশের মানুষ শুধু ‘বন্দে ভারত’ই চড়বে। নতুন ট্রেনের উদ্বোধন করেন সাধারণত রেলমন্ত্রী। বন্দে ভারতের কদর এতটাই যে, এর উদ্বোধন করছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। লক্ষ্যটা স্পষ্ট। রেল নিয়ে মানুষের বিপুল ক্ষোভ। নজর ঘোরাতে বন্দে ভারতকে ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সাফল্য হিসাবে তুলে ধরো।
কিছুদিন আগে আমিও বন্দে ভারতে সফর করেছি। হাওড়া থেকে মালদহ। মাত্র চার ঘণ্টা। দারুণ অভিজ্ঞতা। বলা যায় ‘শতাব্দী এক্সপ্রেস’-এর একটু আপগ্রেডেড ভার্সন। একেবারে ঝাঁ চকচকে আয়োজন। স্বয়ংক্রিয় নানা ব্যবস্থা। টয়লেট বিমানের চেয়ে ভাল। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, ইউরোপে কয়েকবার রেল চড়ার অভিজ্ঞতা আমার আছে। সবচেয়ে বড় জার্নি ছিল লন্ডন থেকে এডিনবরা। দুর্দান্ত ব্যবস্থা। আমরা অনেক পিছিয়ে। ভারতীয় রেল এখন যা করছে ওরা অনেক আগে করেছে। যাই হোক, বন্দে ভারত মন্দের ভাল। ভাল লাগছিল সফর করতে। খাবার আসছে মাঝে মাঝে। আরাম পেয়ে মনে হল, দ্বিগুণ ভাড়া গোনা সার্থক। একই সঙ্গে এ-ও মনে হয়েছিল, আমি খুশি মানেই গোটা দেশ নয়। সাধারণ মানুষের কাছে কতটা সহজলভ্য হবে বন্দে ভারত? তারা কি পারবে বৈভবের এই রেলযাত্রায় শামিল হতে? পারবে না। দেশের ৭৫-৮০ শতাংশ মানুষের কাছে বন্দে ভারত মরীচিকা। তবু এই ট্রেন দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনভাবে প্রচার চলছে যেন ভারতীয় রেল বুলেট যুগে প্রবেশ করছে। যাত্রীও হচ্ছে। কারণ, টাকা দিয়ে আজকাল মানুষ কমফর্ট কেনে। এই নেট যুগে সময়ও বড় ফ্যাক্টর।
কিন্তু কারা চড়ছে এই বন্দে ভারত? সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বিমানযাত্রীদের একটি বড় অংশ বন্দে ভারত পছন্দ করছে। যেহেতু এই ট্রেন দূরপাল্লার নয়, খানিকটা ইন্টারসিটির মতো, তাই এক শ্রেণির মানুষের পছন্দ। রাজ্যে হাওড়া-এনজেপি বন্দে ভারত ভাল চলছে। বাগডোগরা বিমান এড়াচ্ছে অনেকেই।
প্রদীপের নিচে অন্ধকারটা টের পেলাম কালকা সফরে। একই মানুষের রেল সম্পর্কে বিপরীতমুখী অভিজ্ঞতা। কেন্দ্রীয় সরকার যখন বন্দে ভারত নিয়ে আহ্লাদে আটখানা, তখন দুয়োরানি কালকা মেল। বাংলার এমন খুব কম পরিবার আছে, যাদের কোনও না কোনও সদস্য একবার না একবার এই ট্রেনে চড়েনি। এত জনপ্রিয়। সেই কালকা মেলে হতশ্রী সফর। তাতে রেলের কিছু যায়-আসে না। হকারের তীব্র উৎপাত, নানা মানুষের রাতভর আনাগোনায় দুর্ভোগে কেটে গেল দু’রাত। চণ্ডীগড় পৌঁছে ভারতীয় রেলকে ‘প্রণাম’ জানিয়ে মানালির উদ্দেশে রওনা হলাম।
শুধু কালকা বলব কেন, অনেক দূরপাল্লার ট্রেনের এক দশা। পরিষেবা থেকে খাবার, বিস্তর অভিযোগ। মানুষের কথা কেউ ভাবে না। রেলমন্ত্রক ঘুমচ্ছে। রেল বাজেট ছিল এক সময় মজার দিন। গোটা দেশ কান পাতত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দিকে। এখন বাজেট নেই। কে রেলমন্ত্রী দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ বলতেই পারবে না! তাহলে কি শুধু বন্দে ভারত দেখিয়ে এগবে ভারতীয় রেল? বাকি রেল পরিষেবা পড়ে থাকবে অবহেলায়?
যখন এই প্রশ্ন নিয়ে আলোড়ন উঠছে, ঠিক তখনই অবহেলার করুণ পরিণতি ওড়িশার বালেশ্বরের অদূরে। রেলের চূড়ান্ত গাফিলতিতে ঘটে গেল শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। দু’টি ট্রেন ও একটি মালগাড়ির জট পাকিয়ে গেল ভয়াবহ সংঘর্ষে। নিহত প্রায় ৩০০। আহত এক হাজার যাত্রীর কেউ মারা যাবেন, কেউ পঙ্গু হবেন। লাশের পাহাড়। এখনও চেপটে যাওয়া বগি থেকে ঝুলতে দেখা যাচ্ছে যাত্রীদের হাত-পা।
[আরও পড়ুন: করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা ও ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’]
কে দায় নেবে এই হত্যাকাণ্ডের? ‘হত্যা’-ই তো সচেতনভাবে বলব। মানুষের এই বেঘোরে প্রাণহানি রেলের জন্য। উন্নত ট্র্যাক কই, স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ফেল করল কেন, অ্যান্টি-কলিশন ডিভাইস কেন ছিল না? গোড়ায় জল না দিয়ে আগায় দেওয়া চলছে। পরিকাঠামো তৈরি না করেই চালানো হচ্ছে দ্রুতগতির ট্রেন। আজ করমণ্ডলে হল, কাল বন্দে ভারতে হবে না, কে বলতে পারে!
আশ্চর্য লাগছে রেলমন্ত্রীকে দেখে। আগে তো মশাই দায় ঘাড়ে নিয়ে পদত্যাগ করুন। এর চেয়ে আরও কী-কী খারাপ ঘটলে আপনি পদত্যাগ করতেন? কোন সিবিআই তদন্ত করবে? যারা আপনার সরকারের নির্দেশে চলে?
রেল সাধারণ মানুষের। তার একটা জনপ্রিয়তা আছে। রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয় ছিল রেল। শান্তিনিকেতন থেকে শিলাইদহ তাঁর অনেক লেখনীর পিছনে আছে রেলভ্রমণের অভিজ্ঞতা। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পঁাচালী’-র কাশবন থেকে ‘সোনার কেল্লা’-য় মরুপ্রান্তরে সেই কালো ধোঁয়া-ওঠা স্টিম ইঞ্জিন বাঙালির মননে ঢুকে আছে। তাই রেলে কিছু হলে আমরা রে রে করে উঠি। সেই আবেগের মর্ম আজকের রেল শাসকরা বুঝবে না। ওড়িশার ঘটনায় সাধারণ মানুষের মৃত্যুমিছিল প্রমাণ করে দিয়ে গেল, রেল মানে শুধুই বন্দে ভারত নয়। রেল মানে সন্ধ্যার ভিড়ঠাসা বনগাঁ লোকালও।
সেদিন দিল্লিতে রেল ভবনের সামনে রাখা একটি বন্দে ভারতের ইঞ্জিনের খোল দেখে চমকে গেলাম। সেই সাবেক ইঞ্জিনটা কোথায় গেল! ইতিহাসকে মুছে দিয়েই তবে আমরা বুলেট যুগে ঢুকে গেলাম। বালেশ্বরের প্রান্তরে পড়ে রইল নিরীহ রেলযাত্রীদের গণলাশ। শত শত মানুষের কান্না এই দিল্লির হৃদয় স্পর্শ করবে না। এটাই ঘোর বাস্তব।
(মতামত নিজস্ব)