কৃশানু মজুমদার: মেলবোর্নের বিশাল মাঠে হ্যারিস রাউফকে মারা দুটো দুরন্ত ছক্কা এখনও সবার স্মৃতিতে টাটকা। ওই দুটো ছয় পাক-ক্রিকেটারদের মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত বইয়ে দিয়েছিল। কোহলির দাপটে শেষ হাসি তোলা ছিল ভারতের জন্য।
এরকম দুটো ‘বিরাট’ ছক্কা কোহলি মেরেছিলেন ইডেনেও।তখন তিনি আজকের বিরাট কোহলি (Virat Kohli) হননি। ছিল না এখনকার মতো স্টারডম। রাস্তায় বের হলে মবড হতে হত না।
সেই রকম এক সময়ে ক্রিকেটের নন্দনকাননে মারা দুটো ছক্কা আজ লোকগাথার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। চোখ বন্ধ করলেই ২০০৯ সালের ২৪ জুনের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রত্যক্ষদর্শীদের।
[আরও পড়ুন: বিসিসিআইয়ের সভাপতি পদ থেকে সৌরভকে সরানো বেআইনি, অভিযোগে মামলা হাই কোর্টে]
এই শহর জানে তাঁর প্রথম সবকিছু। এই শহর এখনও ভুলতে পারে না পি সেন ট্রফির ফাইনালে মোহনবাগান (Mohun Bagan) জার্সিতে বিরাট কোহলির খেলা অবিশ্বাস্য ১২১ বলে ১৮৪ রানের ইনিংস। সবুজ-মেরুন ক্রিকেট দলের প্রাক্তন কোচ আবদুল মোনায়েম স্মৃতিরোমন্থন করে সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে বললেন, ”প্রচণ্ড গরম ছিল কলকাতায়। ঘামছিল বিরাট। ক্র্যাম্প হচ্ছিল। ৮৯ রানে ব্যাট করছিল কোহলি।উঠে আসতে চাইছিল। কিন্তু সামনে সেঞ্চুরি বলে আমি কোহলিকে ক্রিজে থাকতে বলেছিলাম। তার পর দুটো ছক্কা হাঁকিয়ে সেঞ্চুরিতে পৌঁছেছিল বিরাট। সেঞ্চুরি করার পরে বেরিয়ে এসেছিল মাঠ থেকে। বিশ্রাম নিচ্ছিল ড্রেসিং রুমে। আইস বাথ নিচ্ছিল। পরে আবার যখন ড্রেসিং রুমে গিয়ে কোহলিকে ব্যাট করতে নামার কথা বলি, ও কোনও কথা না বলেই নেমে পড়েছিল। ব্যাট করতে যে কী ভালবাসে বিরাট, এই ঘটনাই তার প্রমাণ। দ্বিতীয় দফায় টাউন ক্লাবের বোলারদের ধ্বংস করেছিল। চার আর ছক্কায় বাকি আশি রান করেছিল। ওরকম ইনিংস আমি দেখিনি।”
আজ জন্মদিনে শুভেচ্ছাবার্তায় ভাসছেন কোহলি। তাঁর কাছ থেকে আরও রান চাইছেন ভক্তরা। পুরনো ‘শিষ্য’কে একবুক শুভেচ্ছা জানিয়ে কোচ আবদুল মোনায়েম বলছেন, ”হ্যাপি বার্থডে বিরাট। বিশ্বকাপ এবার দেশে নিয়ে এসো।”
পি সেন ট্রফির ফাইনালে কোহলির ‘বিরাট’ সেঞ্চুরিতে টাউন ক্লাবকে ৯৭ রানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল মোহনবাগান। তৎকালীন ক্লাবকর্তা সৃঞ্জয় বোস বলছিলেন, ”বিরাট যে এই জায়গায় পৌঁছবে, তখন কেউই ভাবতে পারেননি। কোহলি, মণীষ পাণ্ডে ও লক্ষ্মীপতি বালাজি খেলতে এসেছিল মোহনবাগানে। প্রবল গরমে দুর্দান্ত একটা ইনিংস খেলেছিল বিরাট। কিন্তু যেটা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, তা হল বিরাট কিন্তু ভোলেনি মোহনবাগানের হয়ে খেলা সেই ইনিংস। বছর দুয়েক আগে বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসে ওই ইনিংসটার কথা বলছিল কোহলি। ওর প্রতিটি মুহূর্ত এখনও মনে রয়েছে।”
ছোট ছোট ঘটনার মাধ্যমে খেলোয়াড়ের চরিত্র ধরা পড়ে। বুঝতে পারা যায় তাঁর দায়বদ্ধতা, খেলার প্রতি ভালবাসা। মোহনবাগানের প্রাক্তন ক্রিকেট সচিব সম্রাট ভৌমিক বলছিলেন, ”প্রচণ্ড গরমে খুব কষ্ট হচ্ছিল কোহলির। সাময়িক বিশ্রাম নিয়ে আবার ব্যাট করতে ফিরে এসেছিল। এগুলোতেই বোঝা যায় খেলাটার প্রতি ওর ভালবাসা কত গভীর। ভারত-বাংলাদেশ গোলাপি বল টেস্টের সময়ে ভারতীয় দলের লোকাল ম্যানেজার ছিলাম আমি। তখন কোহলির সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ফাইনালে কত রান করেছিল কোহলি। বিরাটই আমাকে মনে করিয়ে দিয়ে বলেছিল, একশো আশির মতো রান করেছিল ও।” সম্রাটবাবু আরও বলেন, ”দশ-বারো বছর আগে একটা ক্লাবের হয়ে খেলা ইনিংসের পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘটনা ওর মনে রয়েছে। এটাই একজন গ্রেটের পরিচয়।”
এই ইঙ্গিত কিন্তু ছোটবেলা থেকেই মিলেছিল। দিল্লির ছোট্ট গলিতে ক্রিকেট খেলত ছোট্ট কোহলি। পাড়ার বড়দের সঙ্গে খেলতে একটুও ভয় পেত না। জোরে শট মারত। বলের আঘাতে কত বাড়ির কত জানালা ভেঙেছে তার ইয়ত্তা নেই। বয়স্ক ছেলেগুলো পালিয়ে যেত বকা খাওয়ার ভয়ে। কিন্তু বাচ্চা ছেলেটা ক্রিকেটকে এতটাই ভালবাসত যে স্টাম্প ছেড়ে, ব্যাট ফেলে রেখে পালাতে পারত না। পড়শিদের কাছে ধরা পড়ে যেত। বকুনি জুটত। তবুও ক্রিকেট ব্যাট ছাড়ত না। ওটাই ওর প্রাণের আরাম।
এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ থেকেই বিরাটের ব্যাট কথা বলছে। কোহলি এখন মেঘের উপর দিয়ে হাঁটছেন। ফিরে পেয়েছেন আগের সেই ছন্দ। আর তাই বিশ্বজয়ের স্বপ্নও ক্রমশ জোরাল হচ্ছে দেশবাসীর। সেই স্বপ্নের মাঝেই ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’র জন্মদিনেও ফিরে এল মোহনবাগানে খেলে যাওয়া সেই সোনালি ইনিংসের স্মৃতি।