সরোজ দরবার: বিরাট কোহলি (Virat Kohli) যেন এখন বাবুদের সেই তালপুকুর। এককালে ছিল একবুক টলটলে জল। এখন ঘটি ডোবে না। জল-ভরা সেই দিনকালের গল্প আজও একা একা ঘুরে ঘুরে কথা বলে। পরিসংখ্যানের পাতা উলটে উলটে বর্তমান যেন সারছে স্মৃতিরক্ষা কমিটির কাজ। কিন্তু ভবিষ্যৎ? সে যেন জঘন্য এক ধাঁধা।
এ-কথা ঠিক যে, বিরাটকে তাঁর মতো থাকতে দেওয়াই ভাল। ক্রিকেট অনুরাগীদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে, বছর কয়েক আগে একটা প্রশ্ন খুব ঘুরে বেড়াত, ‘শচীন তেন্ডুলকর (Sachin Tendulkar) কবে অবসর নেবেন?’ বাজারে বেগুন বাছতে বাছতে মানুষ সিদ্ধান্ত টেনে ফেলত, যত মহানই তিনি হোন না কেন, এবার থেমে যাওয়াই সঙ্গত। কিঞ্চিত ইন্টেলেকচুয়াল, এই কথাটার উপর আর-একটু মাত্রা যোগ করে বলতেন, সঠিক সময়ে থেমে যাওয়াও একটা আর্ট। সে তো একশোবার সত্যি। কিন্তু কেন যে তা শুধু শচীনের জন্য প্রযোজ্য, যিনি বলছেন তাঁর জন্য নয়, এর কোনও ব্যাখ্যা এই বাচালতার যুগে আশা করাও ভুল। খাঁটি কথাটা বলেছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly)। এক সংবাদমাধ্যমকে এই প্রসঙ্গে তিনি যা বলেছিলেন, তার অস্যার্থ এই যে, ভদ্রলোকের নাম যখন শচীন তেন্ডুলকর, তখন তাঁকেই ঠিক করতে দাও যে, তিনি কখন থামবেন। শচীন-ই শচীনকে সবথেকে ভাল চেনেন। ফলত কখন ব্যাট তুলে রেখে পিচে শেষপ্রণাম জানানো উচিত, তা বাইরের আর পাঁচজন ঠিক করে দিতে পারেন না। বিরাট কোহলি অবশ্য শচীন তেন্ডুলকর নন। তবু তিনি যে-গোত্রের খেলোয়াড়, তাতে তাঁকে তাঁর মতো ছেড়ে দেওয়াই মঙ্গল। ফেসবুকে যখন কেউ বিরাটকে ভুল বানানে পরামর্শ দিতে থাকেন, তখন ভালবাসা-আবেগ ইত্যাদি স্বীকার করে নিলেও আসলে বিষয়টি হাস্যকর হয়ে ওঠে। বিরাট নিজেই সবথেকে ভাল জানেন, ভিতরের সেই আগুন এখনও জ্বলছে কি-না, যে-আগুন ছাড়া শিল্পীজীবন বৃথা।
[আরও পড়ুন: ‘দলকে আর ১০০ শতাংশ দিতে পারছি না’, ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে বিদায় বেন স্টোকসের]
তারপরেও একটা প্রশ্ন অবশ্য থেকে যায়। এই মেনে নেওয়া আর কতদিন? প্রতি ম্যাচে অনুরাগীরা আশা নিয়ে বসে থাকেন। এই বুঝি বিরাটের ব্যাটে রচনা হবে কোনও অলৌকিক কথামালা; কিন্তু হায়! ভরাডুবির গল্প যেন ফুরোতেই চায় না। সত্যি বলতে, নির্জন এককের গান তো আর গাইতে আসেননি বিরাট। অযুত জনতার উন্মুখ দৃষ্টির সামনে তিনি তাঁর শিল্পের উপস্থাপক; ভরামঞ্চে দর্শককে বসিয়ে রেখে বারেবারে তিনি তো ফিরে যেতে পারেন না। এ-প্রবঞ্চনা যত না অন্যের সঙ্গে, ততখানি তো নিজের সঙ্গেও। জনতার প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া যাঁর ধর্ম, তিনি কি নিজে মেনে নিতে পারবেন এই আত্মপ্রবঞ্চনা! না-পারারই কথা। ব্যাড প্যাচের গোড়ার দিকে যখন সহজ ভুলে আউট হতেন বিরাট, তখন তাঁর মুখে লেগে থাকত সরল হাসি। বিরাট যেন বিশ্বাসই করতে পারতেন না, স্বয়ং বিরাট কোহলি এই ভুল করতে পারেন। ক্রমে সেই ভুল যেন অভ্যাস হয়ে দাঁড়াল। এখন সেই ভুলের পাহাড় সরিয়ে নিজের কাছেই আর পৌঁছাতে পারেন না বিরাট।
এ-কথা তো অনস্বীকার্য যে, সমস্ত শিল্প, আবেগ, ভালোবাসার সা-রে-গা-মা পেরিয়ে ক্রিকেটের সঙ্গে যা জড়িত, তা হল অর্থ এবং বিনিয়োগ। এ উপমহাদেশে ক্রিকেট একই সঙ্গে ধর্ম ও ব্যবসা। বিরাটের প্রতিভা যে ব্র্যান্ড নির্মাণে প্ররোচনা জুগিয়েছিল, তা এখনও যথেষ্ট জোরদার। সাফল্যের পরিসংখ্যান এতটাই প্রোজ্জ্বল যে, ব্যর্থতার বাদলায় তা ম্লান হয় না। কিন্তু এইসব সহজ সমীকরণেও বাইরেও যা থেকে যায়, তা হল, এই ব্র্যান্ড বিরাটকে আদর-যত্ন করে যে তৈরি করা হয়েছে, তার সবটুকু শুধু ব্যাটে-বলের খেলা নয়। বিরাটের আগ্রাসন, কলার-তোলা ঔদ্ধত্য, মাঠের বাইরে ফ্যাশনদুরস্ত জীবনযাপন, অনুরাগীদের প্রতি ভালবাসা, আর সমালোচনায় চটে উঠে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার ফরমান – সব মিলিয়ে যত্ন করে রচিত হয়েছে এক ‘বিরাট’ গল্পকথা। ঠিক যেন সিনেমার মতো। নায়কের চরিত্রে যা যা গুণ থাকা উচিত, চিত্রনাট্যে তাই-ই রাখা হয়েছে। সমসময়ের জাতীয়তাবাদী আবেগের কড়া ডোজও দেওয়া হয়েছে পুরোদমে। গল্প এবার জমে উঠে পৌঁছেছে ক্লাইম্যাক্সে। এখন সমস্ত প্রতিকূলতাকে কুপোকাত করে শেষ দৃশ্যে হাততালি কুড়োনোর পালা। সিনেমা হলে তাই-ই হতো। তবু সিনেমা তো ঠিক জীবনের মতো নয়। এখানে চিত্রনাট্যে নিয়তির হাত থাকে। ডেস্টিনি অতিক্রম করতে পারে না জীবনের কুশীলবরা। বিরাটও পারেননি। যে চক্রব্যূহে স্বেচ্ছায় প্রবেশ করেছিলেন বিরাট, তা থেকে বেরনোর মন্ত্র যে তিনি জানেন না, সে-কথা মোহমেদুর দিনে মনে না-থাকাই স্বাভাবিক। হয়তো এখনও তাঁর উপর বিনিয়োগের পাল্লা এতটাই ভারী যে, ব্র্যান্ড বিরাটকে এখনই ড্রপ করা সম্ভব নয়। | কিন্তু তা যে অসম্ভবও নয়, তা বোধহয় বিরাট ভালই জানেন| তিনি জানেন না, এ-বঙ্গ একদা দেখেছে ‘ব্র্যান্ড বুদ্ধ’-এর উত্থান ও পতন| সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের কামব্যাকের গল্প যেমন রূপকথা, পাশাপাশি এই বাংলার একজন বাসিন্দা হয়ে তাই বলা বোধহয় অনুচিত হবে না যে, ফেরার গল্পটা সর্বদা সহজ নয়; বরং কখনও কখনও তা অসম্ভবপ্রায় হয়ে ওঠে|
[আরও পড়ুন: ফের চমক, এবার মোহনবাগানের ৯ নম্বর জার্সি গায়ে চাপাচ্ছেন এই বিশ্বকাপার]
প্রসঙ্গক্রমে দুটো গল্প হলেও সত্যি ঘটনার অবতারণা। হিন্দি সিনেমার সঙ্গীতে যিনি বিপ্লবের সমতুল, সেই রাহুলদেব বর্মণ, আটের দশকের মাঝামাঝি মোটেই কাজ পাচ্ছিলেন না। ময়দানে তখন বাপি লাহিড়ি। সিনেমার ধরন বদলেছে। সুর রচনায় ডাক পড়ছে নতুনদের। আনন্দ-মিলিন্দ জুটি মাতিয়ে দিচ্ছে দশকের শেষলগ্ন। ঠিক সেই সময় বিধুবিনোদ চোপড়া একটা প্রাক-স্বাধীনতা আমলের প্রেমের গল্পে সুর করতে ডাকলেন রাহুলদেবকে। এ-ছবি মুক্তির আগেই ইহলোক ত্যাগ করেন রাহুল। ছবির গানগুলোকে তাই জনতার উদ্দেশে তাঁর শেষ চিঠি হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে। নিজেকে খুঁড়ে শৈশবের সুর, বাবা শচীনদেব বর্মণের সহজ সুরের শয়তানির কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন তিনি। প্রত্যাখ্যানের আগুন শিকড়ে ফিরিয়েছিল আর ডি-কে। অন্য গল্পটিও সঙ্গীতের। বেলাশেষের গীতা দত্ত। সাম্রাজ্যপাট তখন গিয়েছে তাঁর। এদিকে লতা মঙ্গেশকর, অন্যদিকে আশা ভোঁসলের দখলে চলে গিয়েছে প্রায় সবটুকুই। ব্যক্তিগত জীবনের নানা উথালপাতালের জেরে গীতার নিজের ভিতরও এত পরিবর্তন এসেছিল যে, তাঁর অতীতদিনের নিকটজনেরাও আর তাঁর সঙ্গী হতে পারছিলেন না। অস্তরাগের আলো তখন স্বয়ং গীতার কাছেও স্পষ্ট। ঠিক সেই সময় এল বাসু ভট্টাচার্যের পরিচালনায় ‘অনুভব’ ছবিতে গান গাওয়ার ডাক, সঙ্গীত পরিচালক কানু রায়। এর এক বছর পরেই শেষ হবে গীতার জীবন-অধ্যায়। ঠিক তাঁর আগের বছর তিনি গাইলেন – ‘মেরে জান মুঝে জান না কহো মেরি জান’। যাঁরা শুনেছেন তাঁরা জানেন এ-গানে কী কাণ্ডটাই না করেছেন গীতা! সঙ্গীতের ইতিহাস বিস্ময়ে আজও এই গানটিকে লক্ষ্য করে; কণ্ঠকে যে কী করে ইন্সট্রুমেন্ট করে তুলতে হয় – যেখানে বেজা ওঠে যন্ত্রণার আগুন থেকে উঠে আসা আনন্দ-বিষাদের মিলিত ধ্বনি – দেখিয়ে দিয়েছিলেন গীতা দত্ত। না, বিষাদের বাঁশরি বেজে উঠুক, হেন উদ্দেশ্যে এই দুটি গল্পের আনাগোনা নয়। যাঁরা ‘গ্রেট’, যাঁরা শিল্পী, যাঁরা ঠিক আমাদের মতো সাধারণ মানুষ নন, তাঁরা দুসময়ে পড়লে কী করেন, তার নমুনা উদ্ধারের জন্যই দুই মহৎ মানুষের দ্বারস্থ হওয়া। আত্মবিশ্বাস হারানোর অভিশাপ একদিন ঘিরে ফেললে, নিজেকে খনন করাই ফেরার মন্ত্র| এ-গল্প কি আমাদের সে-কথাই বলে না!
অতএব নিজেকে খুঁজে দেখো পুনর্বার। বিরাটের কাছে এটুকুই আরজি। কী করলে তিনি হারানো বিরাট হয়ে উঠবেন, সে-বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া যায় না। কেননা বিরাট কোহলি হয়ে-ওঠা যেমন সহজ নয়, ততোধিক কঠিন বিরাট কোহলিকে খুঁজে পাওয়া। সে-কাজ একান্তই বিরাটের। বড়জোর পোল্যান্ডের কথাসাহিত্যিক ওলগা তোকারচুকের উপন্যাস থেকে একটি লাইন বিরাটকে শোনানো যেতে পারে- ‘উই মাস্ট রিসার্চ আওয়ার পেইন’। যন্ত্রণালিপিতেই রাখা উত্তরণের ভাষ্য। বাউন্ডারিলাইনের এপারে বসে উদাসচোখে যখন মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকেন, এ-কথাটুকু কি কখনও অনুভব করেন বিরাট কোহলি! জনতার মুগ্ধদৃষ্টিকে মোহিত করার দায় তাঁর নিশ্চিত আছে, কিন্তু এক লহমার জন্য হলেও তিনি ভুলে যেতে পারেন এইসব কথা। ভুলে যেতে পারেন, ব্র্যান্ড বিরাটের নির্মাণ, তার ভ্যালু ও বিনিয়োগের সাপ-সিঁড়ি খেলা। তিনি বরং ফিরে যান শিকড়ে। অন্যের কাছে নয়, নিজের কাছেই নিজেকে প্রমাণ করুন যে, তিনি বিরাট কোহলি; কর্ণ নয়, আধুনিক মহাকাব্যে তিনি এসেছেন অর্জুন হতেই। ব্যাটের মাঝখানে বল লাগার প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না এসে ধুয়ে দিক বিরাটের মন। এক মুহূর্ত অন্তত মুছে যাক জগতের বাকি সবকিছু, পরস্পরের দিকে চোখ রাখুক তিনি আর তাঁর শিল্প। নিজেকে খুঁড়ে যদি মুখোমুখি বসিবার সেই মুহূর্তে পৌঁছাতে পারেন, তবেই হয়তো বিরাট কোহলিকে খুঁজে পাবেন বিরাট স্বয়ং। এই মুহূর্তে সেটাই কাম্য। এ-লেখায় যদি কিছু অর্বাচীনের পরামর্শ থেকেও থাকে, অপরাধ নেবেন না। আমরা তো চাই, এই সব পাদটীকা তুচ্ছ করে স্বমহিমায় ফিরে আসুন বিরাট কোহলি। রথের পরে যেমন প্রতিবার উলটো রথে জেগে থাকে ফিরে-আসার গল্প।