দুলাল দে: বুধবার অফিস যাননি। বরানগরের ফ্ল্যাট থেকে মোহনবাগান কোচ শংকরলাল চক্রবর্তী যখন ক্লাবে এসে ঢুকলেন, ঘড়িতে তখন ঠিক এগারোটা। ম্যাচ তো বিকেল সাড়ে চারটেয়। তাহলে এত সকালে কোচ ক্লাবে কেন?
মহামেডানের কাছে ইস্টবেঙ্গলের হেরে যেতেই ঠিক হয়ে যায়, মোহনবাগানের লিগ জয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু আট বছর পর যাঁর হাত ধরে কলকাতা লিগ আসছে, সেই শংকরলাল চক্রবর্তীর রাতের ঘুম তো উড়ে গিয়েছে। রাত দেড়টায় ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে শংকরলাল। উত্তেজনা, আবেগ, উৎকন্ঠায় ঘুম আসে না। যাঁর অনুপ্রেরনায় অন্ধকারময় ফুটবলার জীবনের পর কোচিং জীবনে আসা সেই সর্বক্ষনের সঙ্গী স্ত্রী পৌলমী ব্যালকনিতে এসে দেখেন, চুপ চাপ দাঁড়িয়ে শংকরলাল। তারপর কি তাঁরও ঘুম আসে? মোটামুটি নিদ্রাহীন রাত কাটল দু’জনের। তাই বুধবার এগারোটায় ক্লাবে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়লেন শংকরলাল।
সাড়ে বারোটায় লাঞ্চের জন্য ক্যান্টিন কর্মী ডাকছেন, “ শংকরদা, ও শংকরদা…।” জাগলেন শংকর। লাঞ্চ করলেন। ফের ঘুম। উঠলেন আড়াইটেয়। টেনশন যেন তাড়া না করে তাই ঘুমটাই সেরা রাস্তা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বাগান কোচ। মাঠে ঢোকার আগে ফুটবলারদের নিয়ে ছোট্ট মিটিং, “এই আটটা বছর ধরে ফুটবলার, সমর্থক, কর্মকর্তা, সবাই মিলে এই দিনটার দিকে তাকিয়ে। এবার সময় এসেছে সেই অপেক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটানো।” এখানেই শেষ। ফুটবলারদের আর কিছু বলতে হয়নি। ম্যাচের পর শংকরলাল ফুটবলারদের কাঁধে।
[‘কাউকে আঘাত করতে চাইনি’, বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী টুটু বোস]
হাসিমুখে মেপে কথা বলা শংকরলালের ভূষণ। তাই আট বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান যাঁর হাতে ঘটল, সেই তিনি এক ছুটে মাঠ থেকে ড্রেসিংরুমে। মোবাইলটা অন করে স্ত্রী পৌলমীকে ফোন।-“পেরেছি। আমি পেরেছি।” ব্যস। তারপর ‘আবেগ’ নামক শব্দ থেকে সরে বাস্তবের রুক্ষ্ম মাটিতে তিনি। ম্যাচ না থাকলে অন্যদিন এই সময় সল্টলেকে প্রাক্তন ফুটবলার মিহির বোসের বাড়িতে আড্ডা। সেখানে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়রাও থাকেন। এদিন আড্ডা নেই। ক্লাব থেকে সোজা পৌলমীর অফিসে। তাঁকে নিয়ে থেকে সোজা বাড়ি।
তার আগে শংকরলাল বলছিলেন, “ফুটবলার জীবন আমার একদম জিরো। তখন অফিস আর বাড়ি করতাম। পৌলমীই জোর করল কোচিংয়ে আসার জন্য। সেই কারণে এই লিগ জয়টা স্ত্রীকে উৎসর্গ করব। ভুলব না সুভাষ ভৌমিককেও। তিনিই আমাকে মোহনবাগানে সহকারি করে এনেছিলেন। সঞ্জয়দার সঙ্গে থেকেও তৈরি হয়েছি। কিন্তু প্লিজ এর মধ্যে কোনওরকম রাজনীতির রঙ খুঁজবেন না। সঞ্জয়দা চলে যাওয়ার পর দেশে বহু কোচ ছিলেন। কিন্তু দেবাশিসদা, সৃঞ্জয় আমার উপরে ভরসা করে ক্লাবের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এই অবস্থায় ওদের ভুলে যাই কী করে? কোচ হিসেবে আমার প্রতিষ্ঠা পাওয়ার দিনে এদের সবার ভূমিকা রয়েছে।” কথা শুনলে মনেই হবে না, একটু আগেই লিগ জিতে এসেছেন। শান্ত, ধীর-স্থির। টেবিলের উল্টোদিকে বসে একমনে তারকা কোচের কথা শুনছিলেন দুই প্রাক্তন, মিহির বোস আর অচিন্ত্য বেলেল। এই দীর্ঘ লিগে কোন ম্যাচটা টার্নিং পয়েন্ট? যেখান থেকে লিগটা নিজেদের দিকে ঝুঁকে পড়ল?-“সাধারণত ডার্বির পরের ম্যাচটা কঠিন হয়। আমরা সেই ম্যাচে এফসিআই-কে পাঁচ গোল দেওয়ায় চাপে পড়ে ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু লিগের কঠিন ম্যাচ খুঁজতে বললে আমি রেনবো ম্যাচকে বেছে নেব। লিগে ওদের বিরুদ্ধে এক গোলে পিছিয়ে পড়েছিলাম। স্বাভাবিক ভাবে ম্যাচটা কঠিন হয়ে যায়। তেমনই ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়ার্ধটাও কঠিন ছিল। এছাড়া লিগ জয়ের পথে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি।”
[লিগ জয়ের আনন্দ, ড্রেসিংরুমে ডিকাদের ২ লক্ষ টাকা দিলেন টুটু বোস]
আর লিগের আবিষ্কার? উত্তর দিতে গিয়ে হোঁচট খেলেন না। যেন তৈরিই ছিলেন। “পিন্টু আর সৌরভ। গতবছর সেভাবে সুযোগ পায়নি। এই মরশুমে দু’জনেই প্রমাণ করেছে ওরা লম্বা রেসের ঘোড়া। সেরকম বিপক্ষ দলের বেশ কিছু ফুটবলারকেও ভাল লেগেছে। যাদের নাম বলছি না। আই লিগের জন্য তাদের নামটা আমি কর্তাদের বলেছি।” আর এক প্রধানে যখন টিডি, কোচ, সহকারি কোচ নিয়েও সাফল্য নেই। সেখানে একাই কোচিং করিয়ে লিগ এনে দিলেন শংকরলাল। কী ভাবে সামলালেন সব কিছু? শংকরলাল বললেন, “বেশি লোক থাকলে একেকজনের একেক রকম মত হয়। একা থাকায় আমাকে সেই অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়নি। তার উপর ক্লাবের ভেতর বাইরে নানা সমস্যা। এটাতো অস্বীকার করার উপায় নেই, আর্থিক সমস্যা, ক্লাবের রাজনীতির সমস্যা ছিলই। তাই এই লিগ জয়টা কঠিন ছিল আমাদের জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লিগ এসেছে, এটাই আনন্দের।’’
একজন জানতে চাইলেন, “ প্র্যাকটিস কী কাল?” শংকরলাল বললেন, “প্লিজ এই মুহূর্তে প্র্যাকটিসের কথা বলো না। একটু ঘুমোতে দাও। তাড়াতাড়ি ছুটলেন টাটা সেন্টারের দিকে। সেখানে তখন পৌলমী দাঁড়িয়ে। তাঁর অনুপ্রেরণা।
[চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে উড়িয়ে ফের সাফ কাপের ফাইনালে ভারত]
The post টেনশনে সারারাত ঘুমাতে পারেননি শংকরলাল appeared first on Sangbad Pratidin.