দীপঙ্কর মণ্ডল,নন্দীগ্রাম: সন্ধ্যা নামার মুখে নদীর এই জায়গাটা বেশ মায়াবী দেখায়। ওপারে একটু আড়াআড়ি ডায়মণ্ডহারবার। বাংলা করলে দাঁড়ায় হীরক বন্দর। আলোক ঝলমলে। এপারে নন্দীগ্রাম (Nandigram)। নদীতে চর। পাড় গিলে খাচ্ছে নদী। ভোটের বাজারে প্রচারের আর্কলাইট পড়া এই ভূমিতে জমি রক্ষার আন্দোলন দেশ তো বটেই ভারতের বাইরেও বহুলচর্চিত ছিল।
কিন্তু তার আগেও, এই জায়গাটা, যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি, তা ছিল অনেক বেশি আলোচিত এবং ভূমি রক্ষার আন্দোলন ও স্থানীয়দের চাকরির দাবিতে উত্তাল হওয়া এলাকা। জেলিংহাম (jellingham)। নামই যথেষ্ট। এখানেই হওয়ার কথা ছিল জাহাজ মেরামতির একটি প্রকল্প। যার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল আজ থেকে ৩৫ বছর আগে। সেই সময়ে জমি আন্দোলন শুরু করেছিলেন এখানকার মানুষ। ঝরেছিল রক্তও। এবং বাকিটা ইতিহাস। এবং তার পর সেখানেই প্রায় ২০০ কোটির টাকা রেল ওয়াগন তৈরি ও মেরামত প্রকল্প গড়ার কথা হয়েছিল ২০১০ সাল নাগাদ। তাও তলিয়ে গিয়েছে নদীর জলে। জাহাজ মেরামতির প্রকল্প গড়তে কাজ এগিয়েছিল অনেকটাই। তার সব যন্ত্রাংশ চুরি গিয়েছে। আর জেলিংহ্যাম এখন স্রেফ নদীর চর। শিল্পায়নের বধ্যভূমি।
[আরও পড়ুন: বাড়িতে বসে ভোটে আগ্রহ নেই অশীতিপরদের, ‘ফ্লপ’ কমিশনের পোস্টাল ব্যালট আনার উদ্যোগ]
নন্দীগ্রামের সোনাচূড়া থেকে খানিকটা দক্ষিণে এগোলে জেলিংহাম। লাল মাটির রাস্তা এখন তো রাজ্যে নেই বললেই চলে। ঢালাই রাস্তা। এখানেও তাই। নামমাত্র নিরাপত্তা। অনায়াসে ঢোকা যায় বন্ধ কারখানায়। আছেটাই বা কি। দুষ্কৃতীরা নিয়ে যেতে পারেনি, এমন একটি ওয়াগনের কঙ্কাল আর কিছু মরচে ধরা লোহার পাত। বিপুল অঙ্কের লোহা এবং যন্ত্রাংশ উধাও। এসব হয়েছে বামেদের সময়ে। অনেক পরে সেই বামেদের শেষের দিকে কেমিকেল হাব গড়ে নন্দীগ্রামকে ‘দ্বিতীয় হলদিয়া’(Haldia) করার চেষ্টা হয়। বিস্তীর্ণ এলাকায় জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা হয়েছিল। জমি হারাতে চাননি নন্দীগ্রামের বাসিন্দারা। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী আন্দোলন। কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঘোষণা করতে বাধ্য হন, জমি অধিগ্রহণ হবে না। তারপরও চলে জমি আন্দোলন।
[আরও পড়ুন:ঘরে ঘরে ধারা বইবে কোনদিকে? রাজ্য ও কেন্দ্রের জল প্রকল্পের মধ্যে জোর লড়াই]
নন্দীগ্রামের সেই রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধ ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছিল তৃণমূলকে। ২০০৭-এর ১৪ মার্চ হয়েছিল গণহত্যা। পুলিশের গুলিতে ১৪ জন প্রতিবাদী শহিদ হন। কেটে গিয়েছে চোদ্দ বছর। নন্দীগ্রামে এখন চলছে ভোটের প্রচার। বিজেপি(BJP) এবং তৃণমূল(TMC), দু’তরফে উসকে দেওয়া হচ্ছে জমি আন্দোলনের স্মৃতি। তবে বাসিন্দাদের আশা, যারাই ক্ষমতায় আসুক চালু হোক জেলিংহাম। বাজুক সাইরেন। সবার হাতে কাজ থাকুক। সবার পেটে ভাত জুটুক।
পোর্ট ট্রাস্ট জেলিংহামের জমি অধিগ্রহণ করেছিল ১৯৭৮ সালে। বার্ন স্ট্যান্ডার্ড কারখানা(Burn Standard Co. Ltd) চালু করে। কয়েক বছেরের মধ্যে ধারাবাহিক বাম আন্দোলনে তা বন্ধ হয়ে যায়। যা আজও খোলেনি। অনেক পরে রেলমন্ত্রী হওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন এখানে রেলের ওয়াগন তৈরি হবে। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন ২০১০ সালে মমতা দেশপ্রাণ-নন্দীগ্রাম ১৭ কিলোমিটার রেলপথের শিলান্যাস করেছিলেন। জমি অধিগ্রহণ করে মাটি ভরাটের কাজটুকু হয়েছে।
নন্দীগ্রামে রেলওয়ে স্টেশন(Nandigram Railway Station) তৈরির কাজও হয়েছে কিছুটা। ঘোলপুকুরিয়ায় রেলসেতু তৈরি শুরু হলেও শেষ হয়নি। নন্দীগ্রামের অধরা স্বপ্নগুলির জন্য রাজ্যের তরফে অভিযোগের আঙুল তোলা হয় কেন্দ্রের দিকে। তৃণমূলের বক্তব্য, তাদের সরকার ও হলদিয়া উন্নয়ন সংস্থা নন্দীগ্রামে রাস্তা, আলো ও পরিকাঠামোগত বেশ কিছু উন্নয়ন করেছে। তবে ভারী শিল্প আসেনি। এখন এখানে নামমাত্র ভেসেল অ্যাসেম্বল করা হয়। হাতে গোনা কয়েকজন ঠিকাকর্মী। আছেন কয়েকজন স্থানীয় নিরাপত্তা কর্মী। বন্ধই থেকে যায় জেলিংহাম। নন্দীগ্রাম চায়, এবার ভোটে যেই জিতুক, জেলিংহ্যামে ভোঁ বাজুক। ডায়মণ্ডহারবারের(Diamond Harbour) আলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস আর নয়, এখানকার আলোয় ঝলমল করুক নদীর পাড় এবং মানুষের মুখ।