মনিরুল ইসলাম, উলুবেড়িয়া: আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছিল বছর ২০-র ছেলেটা। দু’চোখে ভরা স্বপ্ন চিকচিক করত সেই ছোটবেলা থেকেই। মফস্বলে যে শৈশব ডাংগুলি, ডুব সাঁতার আর ডানপিঠে হয়ে ওঠার ট্রেডমার্ক, সেই বয়সেই একবগ্গা জেদের সওয়ারি হয়েছিল ছেলেটা। হাওড়ার পাঁচলা থেকে মায়াবি বার্মিংহামের দূরত্ব কত? গুগল হয়তো জবাব দিয়ে দেবে কয়েক হাজার মাইল। তবে যে জবাব পাওয়া যাবে না তা হল, কতটা স্বপ্নে হাঁটলে তবে নিয়নের স্রোতে ভাসা যায়!
অচিন্ত্য শিউলির (Achinta Sheuli) ‘সোনার ছেলে’ হওয়ার পথটা মোটেও ফুলের পাপড়ি বিছানো ছিল না। বরং তা ছিল কাঁটায় মোড়ানো। বাবা দিনমজুরের কাজ করতেন। অভাব, অনটন, দারিদ্র লেগেই ছিল। একদিন হঠাৎই অচিন্ত্যর বাবা না ফেরার দেশে চলে গেলেন। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। সেই সময়ে অচিন্ত্যর বয়স ছিল মাত্র ১১। ডিকেন্সের কথায়, সে বড় সুখের সময় ছিল না। পিতৃহারা অচিন্ত্য। সংসার হয়ে পড়ল ‘নাবিক’হারা।
এর মধ্যেও আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখত ছেলেটা। পাড়াপড়শি বুঝেছিলেন, এ ছেলে সত্যি সত্যি একদিন দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। মা ভাবতেন, ছোট ছেলেটা বিশ্বমঞ্চে পরিবারকে গর্বিত করবে। রবিবারের পর সেই ছেলেটিই তো দেশের স্বপ্নের সওদাগর। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, তাঁর সাফল্য দেশের অসংখ্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে। এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাবে। চ্যাম্পিয়নরা তো এমনই হয়। শুধু পারফরম্যান্স দিয়ে কথা বলেন তাঁরা। বিশ্বমঞ্চে উড়িয়ে দেন বিজয়কেতন। পোডিয়ামে পদক গলায় নিয়ে শোনেন দেশের জাতীয় সংগীত। কঠিন চোয়ালে আরও স্বপ্ন দেখেন চ্যাম্পিয়নরা। এই স্বপ্ন যে অনন্ত! রবিবার থেকে দেশের শ্বাসপ্রশ্বাসে শুধু অচিন্ত্য আর অচিন্ত্য। বার্মিংহাম থেকে বহুদূরের হাওড়ার সেই ঘর আজ যে সব পেয়েছির দেশ।
[আরও পড়ুন: মাঝরাতে সোনা জয় বঙ্গসন্তানের, কমনওয়েলথ গেমসে রেকর্ড হাওড়ার অচিন্ত্যের]
বাবা মারা যাওয়ার পরে সংসারের জোয়াল এসে পড়ে মা পূর্ণিমা শিউলির উপরে। তিনি জরির কাজ শুরু করেন। তাঁকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন দুই ভাই-অচিন্ত্য আর অলোক। খুব কষ্ট করে সংসার চলত তাঁদের। এত দারিদ্রের মধ্যেও ফোকাস হারাননি অচিন্ত্য।
কমনওয়েলথ গেমসে (Commonwealth Games) যাওয়ার ঠিক আগে দেশের নতুন চ্যাম্পিয়নের সঙ্গে কথা বলেছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেই সময়ে অচিন্ত্যর সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হয়েছিলেন মোদি। হাওড়ার ছেলের সংকল্প, তাঁর পরিশ্রম, উঠে আসার গল্প শুনে মোহিত হয়েছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। রবিবার মাঝরাতে অচিন্ত্য যখন বার্মিংহ্যামে নতুন নজির গড়ছেন, তার কিছুক্ষণ বাদেই টুইট করে প্রধানমন্ত্রী লেখেন, ”মা ও দাদার অবদানের কথা আমাকে বলেছিল অচিন্ত্য।” পদক জয়ের পরে অন্যান্য কোচদের সঙ্গে দাদাকেও সেই সাফল্য উৎসর্গ করেন নতুন চ্যাম্পিয়ন। অচিন্ত্যর সাফল্যে দারুণ খুশি তাঁর পরিবার, তাঁর গ্রাম।
দাদা অলোক শিউলি বলেন, ”খুবই ভাল লাগছে। আমরা জানতাম ভাই ভাল কিছু করবে। সেটাই হয়েছে।” ভাইয়ের কীর্তি ছুঁয়ে যায় গর্বিত দাদাকেও। অচিন্ত্য যে এবার কিছু একটা করতে চলেছেন কমনওয়েলথ গেমসে তার ‘গন্ধ’ আগেই পেয়েছিল তাঁর প্রতিবেশীরা। কমনওয়েথ গেমস শুরু হওয়ার পর থেকেই আশায় বুক বাঁধেন মা পূর্ণিমা শিউলি। শুধু মা নন দাদা অলোক শিউলি-সহ গ্রামের অন্যান্যরাও অচিন্ত্যর সাফল্যের অপেক্ষায় বসে ছিলেন। তাঁদের সবার মুখে অচিন্ত্য ছড়িয়ে দিয়েছেন হাজার ওয়াটের আলো।
এই সাফল্যের পিছনে রয়েছে গভীর অধ্যবসায়। মাসখানেক আগেই বার্মিংহ্যামের মাটিতে পৌঁছে গিয়ে কঠোর অনুশীলন শুরু করেন অচিন্ত্য। তাঁর দাদা অলোক শিউলি নিজেও একজন ভারোত্তোলক ছিলেন। মূলত দাদার ইচ্ছেতেই স্থানীয় কোচ অষ্টম দাসের কাছে প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তী সময়ে পুণের সেনাবাহিনীর স্পোর্টস ইন্সটিটিউট এবং পাতিয়ালায় ভারতীয় শিবিরে যোগ দেন অচিন্ত্য।
দাদা অলোক একবার বলেছিলেন, ”২০১০ সালে আমি অষ্টম দাসের কাছে ভারোত্তোলন প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করার পর ২০১১ সাল থেকে অচিন্ত্যকে সেখানে নিয়ে যাই। দেউলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় ২০১৩ সালে আমরা দু’ ভাই একসঙ্গে ন্যাশনাল প্রতিযোগিতায় অংশ নিই।” সেই প্রতিযোগিতায় অচিন্ত্য চতুর্থ হওয়ার পরেই সেনাবাহিনীর নজরে পড়ে যায়।
পরে অল ইন্ডিয়া ট্রায়ালে অংশ নেন। বাংলা থেকে একমাত্র অচিন্ত্য সুযোগ পান সেখানে। ২০১৪ সালে হরিয়ানায় ন্যাশনাল গেমসে তৃতীয় হয়ে সেনাবাহিনীর স্পোর্টস ইন্সটিটিউটে যোগ দেন অচিন্ত্য। পাতিয়ালায় ভারতীয় শিবিরে ডাক পান দেশের নতুন চ্যাম্পিয়ন। এরপর শুধু এগিয়েই চলেন অচিন্ত্য। জয়যাত্রা শুরু হয় তাঁর। ২০১৫ সালে ভারতে যুব কমনওয়েলথ গেমসে রুপো জেতেন। ২০১৭ সালে তাসখন্দে যুব বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে রুপো, ২০১৯ সালে জুনিয়র বিভাগে সোনা জেতার পরে ২০২১ সালে তাসখন্দে ওয়ার্ল্ড জুনিয়র প্রতিযোগিতায় রুপো এবং জুনিয়র ও সিনিয়র বিভাগে জোড়া সোনা জেতেন অচিন্ত্য।
অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সিলেকশন ট্রায়ালে অল্পের জন্য ব্যর্থ হন। ভাইয়ের পাশাপাশি সিনিয়র ন্যাশনাল প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য আগামী অক্টোবর মাসে ট্রায়ালে অংশ নেবেন দাদা অলোকও। ২০১৮ সালে দমকল বিভাগে কাজ পান তিনি। চলতি বছর বাড়ি পাকা করেছেন তাঁরা। মা পূর্ণিমা শিউলি আগেই জানিয়েছিলেন, ”আমার মন বলছে অচিন্ত্য দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।” মায়ের আশা পূর্ণ হয়েছে। দেশকে গর্বিত করছেন ছেলে অচিন্ত্য। কাঁটার পথ অতিক্রম করে অচিন্ত্য আজ দেশের সোনার ছেলে।