কৃষ্ণকুমার দাস: আক্রা সন্তোষপুরের দর্জিপাড়ায় ঢুকেছিলাম রেমাল ঘূর্ণিঝড় আসার আগের সন্ধ্যায়। সার দিয়ে পর পর বাড়িতে ডজন ডজন সেলাই মেশিন স্পিডে চলছে। রাস্তার দুপাশে ভর্তি কাটা কাপড়ের অজস্র ছাঁট। বাতাসে সুতোর মিহি টুকরো-তুলোর আঁশ উড়ছে। বারান্দায় ঘাঁড় গুজে জিনসের প্যান্ট সেলাই করছিলেন মোজ্জামেল হক। প্রশ্ন করলাম, ‘ঘূর্ণিঝড় আসছে তো, এখনও বাইরে বসে?’
–অভিষেক (Abhishek Banerjee) আছে। মাথা না তুলেই শান্ত গলায় উত্তর দিলেন।
–মানে, বুঝলাম না? ঝড় কীভাবে রুখবে অভিষেক?
–ঝড়ের পর, আমাদের বাঁচা-মরার সাথী ওই ছেলেটাই। কোভিডের সময় ওই আমাদের হাজার হাজার পরিবারকে দুবেলা রান্না করা খাবার দিয়ে এক মাসের উপর বাঁচিয়ে রেখেছিল। আজও ফোন এসেছে অভিষেকের অফিস থেকে। একটানে অভিজ্ঞতার ঝুলি উপুড় করে দিলেন মোজ্জামেল হক। ফলতার গঙ্গায় ভাগীরথী নদীর খেয়াঘাট, মাছঘাট নামেই পরিচিতি। সেখানেই নৌকার মাঝি সনৎ পাড়ুইয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বললেন, ‘‘মাঝরাতে বউয়ের পেটে ব্যথা হচ্ছিল খুব। অতরাতে আশপাশে ডাক্তার নেই, যাব কোথায়? স্কুল পড়া মেয়ে বড়, ‘এক ডাকে অভিষেক’-এর নম্বরে ফোন করতে বলল। ভয়ে ভয়ে ফোন করলাম, ১০ মিনিটের মধ্যে অ্যাম্বুল্যান্স এসে নিয়ে গেল হাসপাতালে। পরদিন গলব্লাডারে অপারেশন হল, অভিষেকের জন্যই সুস্থ হয়ে বউ বাড়ি এসেছে।’’
আমতলা থেকে বারুইপুর রোড ধরে মিনিট ২৫ গাড়িতে যাওয়ার পর পড়ে ঝুলপিয়া। পিচ রাস্তা থেকে নেমে ডানদিকে ইট পাতা সরু পথে হাঁটছিলাম, দেখা পঞ্চায়েত প্রধান সঞ্জীব মণ্ডলের সঙ্গে। নিয়ে গেলেন বিভারানি সর্দারের বাড়ি। পথ দুর্ঘটনায় স্বামীর মৃত্যু হয় বছর তিনেক আগে। খবর পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে সাংসদের অফিস থেকে লোক আর্থিক সাহায্য নিয়ে পাশে ছিল। ছিলেন বিধায়ক দিলীপ মণ্ডল। স্বয়ং বিভারানির কথায়, ‘‘শুধু দুঃসময়ে দাঁড়ানো নয়, পরিবারের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন অভিষেক।’’
[আরও পড়ুন: মাঝ আকাশে বিমান, সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দৌড়তে শুরু করলেন যাত্রী! তার পর?]
মেটিয়াবুরুজ থেকে ডায়মন্ড হারবারের শেষপ্রান্ত, মাঝে বজবজ, মহেশতলা, সাতগাছিয়া, ফলতা, বিষ্ণুপুর, সাত বিধানসভা। প্রায় ৬৯ কিমি দীর্ঘ জনপদ ঘুরে আঠারো থেকে আশি, সব বয়সের মানুষের ব্যক্তিগত জীবন্ত অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি জানিয়ে দিচ্ছে, দশবছরের তরুণ সাংসদের দশদিক জোড়া নজিরবিহীন কর্মকাণ্ড এবং পরিষেবার কথা। ডায়মন্ড হারবারে নদীর ধারের বহুল পরিচিত হোটেল সাগরিকার ডাইনিং রুমে বসেই একথা স্বীকার করলেন একটু দূরের মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জয়ন্ত মণ্ডল। তাঁর কথায়, ‘‘সশরীরে না থাকলেও প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে, তাঁর লোকসভা কেন্দ্রের প্রতিটি বুথেই হাজির আছেন অভিষেক। রাস্তাঘাট, শিক্ষা থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রীরা সবাই ওনার তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। বিস্তৃত নেটওয়ার্কে সাতদিন, ২৪ ঘণ্টাই ঝড়ের বেগে সাহায্য পাচ্ছে সাধারণ মানুষ।’’ পাশের টেবিল থেকে মুখ বাড়িয়ে কথা ধরলেন ডায়মন্ড হারবার মেডিক্যাল কলেজের রেডিওলজির আরএমও ডা. রাজীব বিশ্বাস। বললেন, ‘‘কোভিড মহামাীর সময়ে ‘কোয়ারেন্টাইন’-এ ঘরে থাকা কয়েক লক্ষ মানুষকে ‘ডক্টর অন হুইলস’ অ্যাম্বুল্যান্সে করে বাড়ি বাড়ি ডাক্তার-নার্স পাঠিয়ে শুধু চিকিৎসা নয়, সমস্ত ওষুধ দিয়েছেন তিনি। মাত্র সাতদিনে বাড়ি বাড়ি কিট ও ডাক্তার পাঠিয়ে ৫০ হাজার মানুষের ‘অ্যান্টিজেন টেস্ট’ করিয়েছেন।’’
চিকিৎসকের এই কথার প্রতিধ্বনি শুনছিলাম বজবজের প্রবীণ বিধায়ক অশোক দেবের গলায়। বলছিলেন, ‘‘কোভিডের সময় কমিউনিটি কিচেন চালিয়ে তিন সপ্তাহের বেশি রান্না খাবার ১৪ লক্ষ নিরন্ন মানুষকে পৌঁছে দিয়েছিল আমাদের সাংসদ। সন্তান যেমন বাবা-মাকে আগলে রাখে, নিজের কেন্দ্রের ভোটারদের তেমনই আদর-যত্ন করে অভিষেক।’’ স্বয়ং অভিষেক নিজের কেন্দ্রে প্রচারে নেমে দশবছরে তাঁর কাজের খতিয়ান তুলে ধরছেন। মন্ত্রী দিলীপ মণ্ডলের আয়োজনে বিষ্ণুপুরের সভায় এসে অভিষেক বলছিলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত ৫৫৮০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে পানীয় জল, রাস্তা, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে নানা পরিকাঠামো উন্নয়নে। আগামী ১০ বছরে আরও ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে।’’ মন্দির-মসজিদ, পুজোকমিটি, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা থেকে ক্লাব, সবাইকে সাধ্যমতো সাহায্য করার কথাও জানান তিনি। উল্লেখ করেন, আগেরদিন মহেশতলায় দুর্ঘটনায় একজন মারা গিয়েছেন। মৃতের বাড়িতে লোক পাঠিয়ে সংসারের পুরো দায়িত্ব নেওয়া হয়েছে বলেও সভায় জানান অভিষেক। অভিষেক সাংসদ হওয়ায় যে গোটা ডায়মন্ড হারবারের রাস্তা-জল-বিদ্যুৎ পরিকাঠামোর খোলনলচে বদলে গিয়েছে তা জানিয়ে দিলেন বিষ্ণুপুরের বিধায়ক-মন্ত্রী দিলীপ মণ্ডল।
[আরও পড়ুন: ‘অল আইজ অন রাফা’, সোশাল মিডিয়ায় হঠাৎ কেন ট্রেন্ডিং এমন বাক্য?]
পৈলানের অফিসে বসে বলছিলেন, ‘‘সম্প্রীতি উড়ালপুল হওয়ায় তারাতলা থেকে বজবজ পৌঁছতে আগে এক ঘণ্টার বেশি লাগত, এখন ১০ মিনিট। উপকৃত তিন বিধানসভার মানুষ। চড়িয়াল ব্রিজ ডবল লেন করায় রাস্তায় গতি বেড়েছে, যানজট উধাও।’’ ডোঙারিয়ায় তিনটি পানীয় জল প্রকল্পে লোকসভা কেন্দ্রের কয়েক লক্ষ মানুষ পাইপ লাইনের মাধ্যমে ঘরে ঘরে বিশুদ্ধ পানীয় জল পাচ্ছেন। শুধুমাত্র বিষ্ণুপুরেই ৩৫০ কোটি টাকার জল প্রকল্প প্রায় সম্পূর্ণ বলে দাবি মন্ত্রীর। বছরভর ফুটবল ক্লাব চালানো থেকে ক্রীড়া থেকে সাংসদের ভূমিকাও কেন্দ্রের তরুণ প্রজন্মের কাছে একটা বাড়তি উদ্দীপনা ছড়িয়েছে। আর এর প্রভাব পড়ছে ভোটে। বস্তুত সেই কারণেই ১ জুন ২ নম্বর বোতাম টিপে অভিষেকের প্রতি ভালবাসার প্রতিদান দিতে চান সকলে।
ফাইল ছবি।
ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্র (Diamond Harbour Lok Sabha) সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে অত্যন্ত গরিমা বহন করছে। বিশেষ করে সংসদে বাগ্মী হিসাবে খ্যাতি পাওয়া জ্যোতির্ময় বসু থেকে বাম-আন্দোলনের সিদ্ধপুরুষ কংসারী হালদারের মতো ব্যক্তিত্ব এই কেন্দ্রের দীর্ঘদিনের সাংসদ ছিলেন। অবশ্য অভিষেকও গত ১০ বছরে একাধিকবার সংসদীয় বিতর্কে অংশ নিয়ে ঝড় তুলেছেন, শব্দবানে কোণঠাসা করেছেন মোদি সরকারকে। রাজনৈতিক সমীকরণে ২০১৪ সালে অভিষেক যখন প্রথমবার প্রার্থী হন, তখন প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন সিপিএমপ্রার্থী ডা. আবুল হাসনাত। তিনি ৩৪.৬৬ শতাংশ ভোট পান। কিন্তু গত ২০১৯-এ ফুয়াদ হালিম কাস্তে-হাতুড়ির প্রতীক নিয়ে মাত্র ৬.৬৭ শতাংশ ভোট পান। বামপন্থীদের ভোট পদ্মফুলে যাওয়ায় গেরুয়াপ্রার্থী ৩৩.৩৯ শতাংশ ভোট পান। অবশ্য শুধু বামপন্থী ভোটার নয়। ফলতার বিধান পাড়ুইয়ের মতো ডায়মন্ড হারবারের বহু দাপুটে সিপিএম নেতাও বিজেপিতে যোগ দেন। তাৎপর্যপূর্ণ হল, ২০১৪ সালে প্রদত্ত ভোটের ৪০.৩১ শতাংশ পাওয়া অভিষেক মানুষের পাশে থাকার ফসল হিসাবে ২০১৯ সালে নিজের সমর্থন বাড়িয়ে ৫৬.১৫ শতাংশে নিয়ে যান। এবার তরুণ মুখ প্রতীক উর রহমানকে প্রার্থী করে রামে যাওয়া ভোট বামে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে আলিমুদ্দিন। পৈলানহাটে দেখা হল প্রতীকুরের প্রচারের আটটি ম্যাটাডোরের র্যালি। সঙ্গে মহম্মদ সেলিম এবং জনা ৩০ পার্টি সমর্থক। আর বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ দাস ওরফে ববি এই নিয়ে তৃতীয়বার প্রার্থী হয়েছেন ডায়মন্ড হারবারে (Diamond Harbour) । কিন্তু বামেদের দাবি, ‘‘এবার উনি শুধু হারার হ্যাটট্রিক করবেন না, দূরবর্তী তৃতীয়ও হবেন।’’
[আরও পড়ুন: ‘সন্দেশখালি, কাশ্মীর নিয়ে চুপ কেন?’, রোষানলে পড়ে Rafah পোস্ট মুছেও ট্রোলড মাধুরী দীক্ষিত]
উলটোদিকে ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূলের বিধায়ক পান্নালাল হালদার থেকে সাতগাছিয়ার বিধায়ক মোহন নস্করদের টার্গেট, অভিষেকের ভোটপ্রাপ্তির হার ৬৫ শতাংশ পেরিয়ে যাওয়া। বস্তুত সংসদীয় কেন্দ্র ঘুরে বামপন্থী বা গেরুয়া, কোনও প্রচার বা প্রভাবের ছিটেফেঁাটাও চোখে পড়ল না। উলটোদিকে বুথে বুথে শুধু মাত্র হোর্ডিং বা দেওয়াল লিখন নয়, নৌকার খেয়াঘাটের মাঝি, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, মন্দিরের পুরোহিত, মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম– সমাজের সর্বস্তরের মানুষের হৃদয় জুড়ে শুধুই অভিষেক। একাধিক ক্ষেত্রে দেখেছি, স্থানীয় বিধায়ক বা পঞ্চায়েত প্রধানের নাম বলতে না পারলেও গ্রামবাসীরা অভিষেকের নাম বলে দিচ্ছেন। বস্তুত সেই কারণেই গতবারের মার্জিন ৩ লাখ ১৯ হাজার থেকে বাড়িয়ে এবারের জয়ের ব্যবধান চার লাখ ছাড়ানোর যে টার্গেট অভিষেক দিয়েছেন তৃণমূলকর্মীদের, তা পূরণ হওয়ার জন্য এখন শুধুই ৪ জুন দুপুরের অপেক্ষা।