১০ মে, কর্ণাটকে ২২৪টি আসনকে কেন্দ্র করে বিধানসভা নির্বাচনের লড়াই শুরু হতে চলেছে। স্বভাবতই, এখানেও প্রচারে বিজেপির আখ্যান ‘ডাবল ইঞ্জিন’-এর সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি। কিন্তু, রাজনৈতিক উপস্থিত বুদ্ধি ও তৃণমূল স্তরে সংযোগের শক্তিতে দেখা যাচ্ছে কংগ্রেস বেশ এগিয়ে। কে শেষ হাসি হাসবে? আঞ্চলিক শক্তি, না কি নেতৃত্বের মুখ? বিশ্লেষণে রাজদীপ সরদেশাই
নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে, গত আট বছরে ‘ডাবল ইঞ্জিন সরকার’-এর গল্পটা ক্রমশ ভারতীয় রাজনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছে। দেশের প্রতিটি রাজ্যর নির্বাচনেই ‘ডাবল ইঞ্জিন’ অলংকারটি বিজেপির অন্যতম প্যাঁচ। এই প্যাঁচ দিয়ে ভোটারদের এই বলে প্রলুব্ধ করা হয় যে, যখন কেন্দ্র ও রাজ্যে একই পার্টির সরকার চলে, তখনই প্রকৃত উন্নয়ন এসে ধরা দেবে মানুষকে। এছাড়াও এই আখ্যানটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ভাবমূর্তিরও প্রতিফলন। কারণ, তাঁর ভাবমূর্তিকে ব্যবহার করেই বিজেপির যাবতীয় নির্বাচনী চাল, তা সে পুর নির্বাচন হোক বা সাধারণ নির্বাচন। কিন্তু কর্ণাটকের ভোটকেন্দ্রগুলি থেকে বেশ আকর্ষণীয় একটি প্রশ্ন ভেসে আসছে: প্রধানমন্ত্রীর সন্দেহাতীত জনপ্রিয়তা কি বেঙ্গালুরুর অপেক্ষাকৃত দুর্বল বিজেপি সরকারের টলোমলো অবস্থা থেকে বাঁচিয়ে তুলতে পারবে?
এখনও অবধি ‘ডাবল ইঞ্জিন’ টোটকা থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এসেছে। হিমাচল প্রদেশেই, এই ছ’-মাস আগের কথা, ভোট পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং রীতিমতো অতুলনীয় ভোটভিক্ষা চেয়েছিলেন এই মর্মে যে, পদ্ম চিহ্নে এক-একটা ভোটও তাঁর কাছে আশীর্বাদ হিসাবে পৌঁছবে! তদাপি, সেই নির্বাচন বিজেপি জিততে পারেনি। উল্টোদিকে, গুজরাটেও ভোট হল হিমাচল প্রদেশে ভোটের কাছাকাছি সময়েই, কিন্তু সেখানে বিজেপি জিতল মহাসমারোহে। গুজরাটের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র প্যাটেল বলতে গেলে পার্টির কোনও মুখই ছিলেন না। প্রথমবার বিধায়ক হয়েছিলেন আগের বছর। কিন্তু, সেখান থেকে একবছরে তাঁকে এমন দায়িত্বপূর্ণ জায়গায় তুলে আনা হয়। অথচ, বিজেপির প্রচারাভিযানে, তাঁকে প্রায় দেখাই যায়নি। তবুও, কেবলমাত্র মোদি-ম্যানিয়াকে পাশে রেখে গুজরাটে বিজেপি রেকর্ড-ভাঙা জয় নিশ্চিত করেছিল। তবে, এ-কথাও মানতে হবে, গুজরাট বিজেপির বিশেষ ঘাঁটি। প্রধানমন্ত্রীর সাকিন রাজ্য বলে কথা। একইসঙ্গে, এই রাজ্যে গত ২৫ বছর ধরে বিজেপি শাসন কায়েম রেখেছে।
[আরও পড়ুন: ‘গুগাবাবা’র হিন্দি করতে চেয়ে গুলজারকে ডেকেছিলেন সত্যজিৎ রায়]
তাহলে, কর্ণাটকে এই ‘ডাবল ইঞ্জিন’ প্রোপাগান্ডা কীভাবে কার্যকর হতে পারে? বিগত কয়েক বছরে, বেঙ্গালুরুতে বিজেপি সরকার বেশ কয়েকটা আর্থিক তছরুপ ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। এমন পরিস্থিতিতে ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার হওয়া মানে, কেন্দ্রও হয়ে উঠবে এই দুর্নীতির অংশ। বাস্তবে, দুর্নীতি-বিরোধিতার স্লোগান হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর একরোখা ‘না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা’ (খাবও না, খেতেও দেব না) ধ্বনি কর্ণাটকের মাটিতে প্রায় ভূ-লুণ্ঠিত হয়েছে। কারণ, বিজেপির বিধায়করা সেখানে কালো টাকা-সহ ধরা পড়ছেন। আবার, কর্ণাটক কনট্রাকটর অ্যাসোসিয়েশন কড়া অভিযোগ তুলেছে এই সরকারের বিরুদ্ধে যে, বিভিন্ন নির্মাণ বা সংস্কার প্রকল্প পাস করানোর জন্য এই সরকার প্রকল্প-পিছু ৪০ শতাংশের কমিশন চেয়েছিল! এই অভিযোগ যদি মিথে্য প্রমাণিত হয়ও, তারপরেও দুর্নীতির এই সাংখ্যমান মানুষের মাথায়-কথায়-আলোচনায় গেড়ে বসেছে রীতিমতো।
কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই এমনিতে মৃদুভাষী, অমায়িক রাজনীতিক। জনমুখী নেতা তিনি কোনওকালেই তেমন ছিলেন না, বরং তাঁর আগের মুখ্যমন্ত্রী বি. এস. ইয়েদুরাপ্পা ছিলেন অনেক জনপ্রিয়, ২০২১-এ যাঁকে সরিয়ে বোম্মাই আসেন। কিন্তু, ইয়েদুরাপ্পা হলেন বিজেপির বর্তমান ক্ষমতাতন্ত্রে বিরল প্রজাতির নেতা। তিনি যথেষ্ট শক্তিশালী আঞ্চলিক নেতা, তাঁর নিজস্ব ঘাঁটি ও প্রভাব রয়েছে, বিশেষত লিঙ্গায়ত সম্প্রদায়ে। কিন্তু বিজেপি তাঁকে মুখ্যমন্ত্রিত্বের পদ থেকে সরিয়ে ‘মার্গদর্শক মণ্ডল’ অর্থাৎ পার্টির উপদেষ্টামণ্ডলীতে প্রায়-অবসরভুক্ত করল যে, তা কিন্তু মোটেই কাজে দিল না আখেরে। এবারের নির্বাচনে সেই তাঁকেই নির্বাচনী প্রচারের অন্যতম মুখ হিসাবে মাঠে নামিয়েছে। কারণ, কর্ণাটকে জনপ্রিয়তা ও জনমুখিতার নিরিখে তিনিই বিজেপির দিঘল স্ট্যাচারের মুখ।
আরও বড় বিষয় হল, বিজেপি যখন রাজ্যস্তরে নেতৃত্বের ঘাটতি নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে, সেখানে অনন্যভাবে শক্তপোক্ত স্থানীয় নেতাদের আধিক্যে কংগ্রেসের ভরন্ত সংসার। আছেন, রীতিমতো করিৎকর্মা নেতা ডি. কে. শিবকুমার। আছেন ভিড় টানতে সিদ্ধহস্ত জনমোহিনী নেতা সিদ্দারামাইয়া। এঁরা দু’জন হয়তো একমত পোষণ করেন না সর্বক্ষেত্রে, কিন্তু এঁরা দু’জনেই আখেরে কংগ্রেসের কন্নড় ‘ডাবল ইঞ্জিন’। রাজনৈতিক উপস্থিত বুদ্ধি এবং তৃণমূল স্তরে সংযোগ- এই দুই ক্ষেত্রেই এঁরা পারদর্শী- কর্ণাটকের বিজেপি এঁদের ধারেকাছে নেই এই ব্যাপারে। বিশেষ করে, সিদ্দারামাইয়া ২০১৩-’১৮ যাবৎ, মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ঘটা করে দরিদ্র কল্যাণমূলক কর্মসূচি পালন করতেন, যে-কারণে তঁার একটা আলাদা আবেদন রয়েছেই জনকুলে। প্রান্তিক গ্রামগুলিতে, কর্নাটকের বহুকালীন বর্ণের ত্রুটি-বিচ্যুতি পেরিয়ে ওখানকার ভোটাররা সিদ্দারামিয়াকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে এবং মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে আসছে, আর এহেন আখ্যান শোনা অস্বাভাবিকও নয়।
যা থেকে আন্দাজ করা যায়, কেন বিজেপির কাছে প্রধানমন্ত্রী মোদির মাধ্যমে ঘনঘটাময় প্রচারাভিযান তাদের শেষ তুরুপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজেপি সভাপতি, জে. পি. নাড্ডা এমনকী, পরামর্শ দিয়েছেন যে, ‘কর্ণাটকের জনগণ যদি মোদি সাহেবের আশীর্বাদ উপভোগ করে যেতে
চায়, তবে বিজেপিকে ভোট দেওয়াই বাঞ্ছনীয়।’ বিজেপির মাননীয় সভাপতি হয়তো ‘মোদি ভক্তি’-তে চিত্ত গরগর হয়ে এমন কথা বলে ফেলেছেন, কিন্তু বিরোধীরা এই মন্তব্যটিকে অগ্রাধিকারমূলক আচরণের হুমকি হিসাবেই দেখছেন। তবে হাতে-নাতে প্রমাণিত হয়ে গেল এটাও যে, কেন ‘ডাবল ইঞ্জিন’ ধারণাটি রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিকভাবে বড়সড় বিপদে পরিপূর্ণ। যেখানে কিনা ভারত একটা বিস্তৃত ও বৈচিত্রময় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় গড়া দেশ।
সংবিধান তৈরিই হয়েছে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে রক্ষা করার জন্য, যেখানে কেন্দ্রের আচরণ অবৈষম্যমূলক থাকবে রাজ্যগুলির প্রতি। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে এই প্রতিশ্রুতিই ভঙ্গ করা হয়েছিল, যখন কর্তৃত্ববাদী কেন্দ্র ৩৫৬ ধারার অপব্যবহার করেছিল বিরোধী সরকারের রাজ্যগুলিকে ধূলিসাৎ করার জন্য। তারপর এই এখন। আবারও মোদি-যুগে সমবায় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বিপন্ন। বিবিধ বিরোধী রাজ্য এই ভেবে ভয় পাচ্ছে যে, কেন্দ্র পক্ষপাতমূলক এবং প্রতিশোধমূলক ব্যবহার করছে। মূল ইঞ্জিনের চালকেরা কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করছে পূর্বের সব হিসাব চোকাতে, না-হলে তহবিল আটকে দেবে।
রাজনৈতিকভাবে এর ফলে রাজ্যগুলিতে আঞ্চলিক অনুভূতি, এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের ইতিহাস পুনরুজ্জীবিত হয়েছে: আমরা বাংলার ক্ষেত্রেও এটা লক্ষ করেছি। প্রধানমন্ত্রী যখন সেখানে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘দিদি ও দিদি’ বলে বিদ্রুপ করেছিলেন, তখন মুখ্যমন্ত্রী সফলভাবে বাংলার আহত আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। ঠিক একই বিষয় আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি কর্নাটকে। সেখানে কংগ্রেস কন্নড় জাতীয়তাবাদকে বেশ কিছু ক্ষেত্রে চাগিয়ে দিয়েছে। স্থানীয় ব্র্যান্ড ‘নন্দিনী’ বনাম ‘আমুল’-এর ডেয়ারি শিল্পক্ষেত্রের তরজাকে (আদপে কেন্দ্রীয় বনাম আঞ্চলিক তরজাই) কৌশলে পাকিয়ে তুলেছে তারা।
[আরও পড়ুন: বিজেপির জগদ্দল পাথর নড়াতে সার্বিক বিরোধী ঐক্য ছাড়া গতি নেই]
এই কর্ণাটক বনাম কেন্দ্রের আখ্যান কিন্তু সেই আবেগপূর্ণ আখ্যান, যা বিজেপির রাজনৈতিক কূটনীতিবিদদের রাতের ঘুম কেড়ে নিতে পারে। আর এই অশান্তি শুধু নির্বাচনেই আটকে থাকবে না। সর্বোপরি, বিজেপি কর্নাটককে তাদের দক্ষিণের প্রবেশদ্বার হিসাবে দেখেছিল, দেখেছিল তাদের ভৌগোলিক সম্প্রসারণের প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে। কিন্তু যদি এই ধারণাই প্রবল হয়ে ওঠে যে, ‘ডাবল ইঞ্জিন’ মডেল আদপে দিল্লি-কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা, তাহলে এটি দক্ষিণের রাজ্য সরকার এবং নেতাদের আঞ্চলিক উদ্বেগে আরওই আশঙ্কিত করে তোলারই কথা।
‘ডাবল ইঞ্জিন’-এর প্রচারের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে মোদি-ব্যক্তিত্বের জয়গান। যা, আদপে দু’মুখো তরবারি। এই মোদি কাল্ট একদিকে যেমন রাষ্ট্রপতিসুলভ নির্বাচনের ঘরানায় বিজেপিকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে, তেমনই এই ভাবমূর্তি এমন একটি রাজনৈতিক মডেলের সীমাবদ্ধতাও উন্মোচিত করে, যা প্রায় একক ব্যক্তির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। কর্নাটক হয়তো ভবিষ্যতের দিক-নির্দেশক হতে পারে: রাজ্য নির্বাচনগুলি যখন স্থানীয় ইস্যু নিয়ে ক্রমবর্ধমান শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে, তখন সাধারণ নির্বাচনগুলি গণভোট তৈরি করে নেতৃত্বের নিরিখে।
পুনশ্চ ‘ডাবল ইঞ্জিন সরকার’ বনাম কংগ্রেসের স্থানীয় নেতৃত্বের বিতর্কের মাঝে অারও একটি বিতর্কের প্যাঁচ রয়েছে। রাজ্যটিতে গত চারটি নির্বাচনের মধ্যে তিনটিতেই বিধানসভা ত্রিশঙ্কু হয়েছিল, এবং দু’বার ‘জনতা দল (সেকুলার)’-এর নেতা কুমারস্বামী মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। বেঙ্গালুরুর বাইরে একটি বাগানবাড়িতে বসে তিনি মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘হয়তো আমি তাসবাক্সের সেই জোকার, কিন্তু মনে রাখবেন, কখনও কখনও বাজিমাত করতে হলে জোকারকেই প্রয়োজন পড়ে!’