'চাইব মানুষ যেন আমার ভিন্ন ধারণাটাও মেনে নেয়'- নতুন ওয়েব সিরিজ 'তালমার রোমিও জুলিয়েট'-এর প্রচারে এসে বললেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। মুখোমুখি শম্পালী মৌলিক
'তালমার রোমিও জুলিয়েট' আসছে সামনের সপ্তাহে হইচই-তে। আবার শেক্সপিয়রের কাছে ফিরলেন। এর আগে ‘মন্দার’ করেছেন, ‘অথৈ’ করেছেন, এবারে রোমিও-জুলিয়েট। বারবার এই ফেরা কেন?
- ‘মন্দার’-এর সঙ্গে বাকি দুটোরই স্বকীয়ভাবে তফাত আছে। ‘অথৈ’ অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের অ্যাডাপ্টেশন এবং সিনেমা করার ভাবনা। ‘তালমার রোমিও জুলিয়েট’ কমপ্লিটলি অর্পণ গড়াই এবং দুর্বার শর্মার ক্রিয়েশন। ওদের অ্যাডাপ্টেশন এবং ভাবনা। আমি সেখানে পরবর্তীকালে অভিনেতা হিসাবে এবং ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসাবে যুক্ত হই। আমার সিদ্ধান্ত নয়, যে প্রথমে ‘ম্যাকবেথ’ করব, তারপর ‘ওথেলো’ এবং ‘রোমিও জুলিয়েট’ করব। ঘটনাচক্রে একই সময়ের মধ্যে এগুলো আসছে। আমার কাছে এটা খুব ভালো অভিজ্ঞতা। শেক্সপিয়র করতে কে না চায়।
এই সিরিজে আপনি ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরের ভূমিকায়। আর টাইবল্টের চরিত্রে। টাইবল্ট এখানে ‘মোস্তাক’। ইদানীংকালে আমরা দেখেছি ভিলেন বা অ্যান্টিহিরোর প্রতি মানুষের একটা প্রশ্রয় কাজ করছে। এই ‘মোস্তাক’ কেমন?
- না, আমি এটা সাক্ষাৎকারে বলতে চাই না। মনে করছি, দর্শক এটা সিরিজ দেখেই উপভোগ করুক (হাসি)। খুব ইন্টারেস্টিং চরিত্র।
আপনার কাছে রোমিও-জুলিয়েট মানে কী? বললে কী মনে হয়?
- এককথায় বললে, প্রথমেই মনে হয় ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’, তারপরে ‘ওয়েস্টসাইড স্টোরি’, তারপরে অনেকগুলো ছবির কথা মনে আসে। আর দুটো ফুলের
মতো ছেলেমেয়ের প্রেমের কথা মাথায় আসে।
ভালোবাসার অর্থ আপনার কাছে কী?
- ভালোবাসা মানুষের অর্জন করা জিনিস। মানুষ চর্চা করে ভালোবাসা তৈরি করেছে। ঘৃণা ছিল, ভালোবাসা মানুষকে নির্মাণ করতে হয়েছে। তার জন্য পরিশ্রম করতে হবে। যে কোনও ভালোবাসা, কাজের প্রতি, বন্ধুর প্রতি, বান্ধবীর প্রতি, মায়ের প্রতি, স্ত্রীর প্রতি, ভালোবাসা এমনি এমনি থাকবে না। ভালোবাসা
জারি রাখতে চাষির মতো পরিশ্রম করতে হবে।
কমবয়সে রোমিও-জুলিয়েট পড়ার সেই সময়ের কিছু স্মৃতি আছে?
- না। আমার শুধু মনে আছে, পড়ার আগে দেখেছিলাম। তখন 'প্রাচ্য' বলে নাট্যদল, বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় যার পরিচালক, তারা 'রোমি ও জুলি' বলে একটা নাটক করেছিল। সেখানে জুলিয়েটের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শাঁওলি, আর রোমিওর চরিত্রে রণদীপ মানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাতি। ওদের দুজনকে চমৎকার দেখাত। ওই নাটকটা আমরা বারবার দেখতাম। পরে ‘রোমিও জুলিয়েট’ পড়েছি, সিনেমায় দেখেছি। কিন্তু আমাকে একটু বেশি টানত ‘ম্যাকবেথ’। আমি খুব অল্প বয়সেই ‘কিং লিয়র’-এর মতো ট্র্যাজেডিতে অভিনয় করেছি। ‘হ্যামলেট’ বোঝা-না বোঝার মাঝামাঝি ছিল। তবে ‘রোমিও জুলিয়েট’ খুব পছন্দের নাটকের মধ্যে ছিল না। কিন্তু অর্পণ-দুর্বাররা যেটা লিখে এনেছিল, আমি মুগ্ধ। তালমা-র এত সুন্দর জগৎ ক্রিয়েট করেছে, আমি একেবারে উড়ে গেছিলাম (হাসি)।)
কেউ কেউ বলছেন ‘সাইরাত’-এর একটা ফিল রয়েছে...
- তা তো বটেই, একই তো গল্প। রোমিও-জুলিয়েট নিয়ে যা যা কাজ হয়েছে, তার সবকিছুর সঙ্গেই এই সিরিজের মিল আছে। এটা কোনও মৌলিক ক্রিয়েশন নয়। এই গল্প নিয়ে তো বারবার কাজ হয়েছে।
ইনফ্যাক্ট, ‘আরশিনগর’। যেখানে আপনি নিজেও কাজ করেছিলেন, অপর্ণা সেনের পরিচালনায়।
- হ্যাঁ, সেটাই সিনেমায় আমার প্রথম কাজ।
আপনি যখনই যা কিছু করেন, তা নিয়ে সাংঘাতিক প্রত্যাশা বা আগ্রহ তৈরি হয়। সে সিনেমা, সিরিজ বা গান। কিন্তু যখনই মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয় না, তক্ষুনি ট্রোল করতে শুরু করে লোকজন। এটা কি বিচলিত করে?
- না, সেটাকে মানুষের রিঅ্যাকশন হিসাবে দেখি।
‘অথৈ’-এর ক্ষেত্রে একাংশের মানুষের খুব ভালো লেগেছিল। আবার কারও মনে হয়েছে, অতি-অনির্বাণ অর্থাৎ বেশি হয়ে গিয়েছে। সহমত হবেন?
- না। ওটা একটা শয়তানের কথকতা। একটা শয়তান গোটা গল্পটা বলে। বাকিদের ক্রীড়নক করে রাখে, একটা খেলা খেলে, সার্কাসের রিং মাস্টারের মতো। ও মানুষের জীবনের সর্বনাশ করে দিতে চায়। সেই কারণে ও এত বেশি, মানে গল্পের প্রয়োজনে। এই গল্পটা যে কথা বলতে চেয়েছে, যে ইভিলকে দেখাতে চেয়েছে, সেই কারণে ইভিল বেশি।
যদি তুলনা করি, ‘গোগো’ আর ‘মোস্তাক’-এর মধ্যে, কোনটা বেশি পছন্দের?
- দুটোই সমান পছন্দের। আর দুটো সম্পূর্ণ আলাদা।
আপনার মতো সমাজ-রাজনীতি সচেতন শিল্পীর কাছে মানুষের একটা প্রত্যাশা আছে। আর জি কর কাণ্ডের পরবর্তী সময়ে প্রতিবাদ-আন্দোলন ইত্যাদিতে আপনি নীরব ছিলেন। সেটা নিয়ে একাংশের মানুষের হতাশা তৈরি হয়েছে। এই স্তব্ধতার জায়গাটা জানতে চাই।
- হ্যাঁ, আমি সমাজ নিয়ে সচেতন, রাজনীতি নিয়ে সচেতন। এবং আমি কী কাজ করি, সেটা আমি জানি। আমি অভিনয় শিল্পী, পরিচালনা করি। বেশকিছু সামাজিক ঘটনায় প্রতিবাদে অংশ নিয়ে, গানের মাধ্যমে, বক্তব্যের মাধ্যমে, কথা বলে এবং তার ফলশ্রুতিতে সমাজে কী কী হয় আমি দেখেছি। শুধু আমার কথা নয়, যাবতীয় শিল্পী সমাজের লোকদের বক্তব্য নিয়ে সমাজ, গণমাধ্যম এবং সমাজমাধ্যম কী চেহারা নিয়েছে দেখার পর, বোঝার পর আমি নিজে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যে, এর মধ্য দিয়ে আমি আর যাব না, ফর দ্য রেস্ট অফ মাই লাইফ। এবারে সেইটা মানুষের যে প্রতিবাদের ধারণা, সেটার সঙ্গে মিলমিশ খাচ্ছে না। মানুষের যে প্রতিবাদের ধারণা, সেটা মেনে নিতে আমার কোনও অসুবিধা নেই। আমি চাইব মানুষ যেন আমার ভিন্ন ধারণাটাও মেনে নেয়। তার কারণ, সমাজে ভিন্নতা থাকতেই হবে।
যেহেতু এর আগে আপনি বিভিন্ন ইস্যুতে সরব হয়েছেন, গানও বেঁধেছেন, তাই এতে অনেকে অবাক। আর জি কর কাণ্ডের পরবর্তী পর্বে আপনার নীরবতার কারণে সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ আপনাকে বিরূপ মন্তব্যও করেছে, সেটা মানসিকভাবে অ্যাফেক্ট করেছিল?
- আমি জানতাম এটা হবে। আমার মতো করে প্রস্তুতি ছিল। জানি, এটা কেন বলছি না। সেটা ইতিমধ্যে কিছু কথায় বলার চেষ্টা করেছি, ভবিষ্যতেও হয়তো বলব। নাও বলতে পারি। কিন্তু আমি খুব ভালো জানি, এরকম স্ট্যান্ড কেন নিয়েছি।
অন্যদিকে আপনার স্ত্রী মধুরিমা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে ছিলেন। আপনি তাঁকে নিশ্চয়ই সমর্থন করেছেন?
- অবশ্যই। সেও আমাকে। আমি তার যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছি। সে আমার যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্তকে।
এর পরের কাজ কী?
- আবার একটা ওয়েব সিরিজে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর, ‘ভূত তেরিকি’ বলে সিরিজটা। সেটা আমার বন্ধু কৌশিক হাফিজির ক্রিয়েশন। অপূর্ব স্ক্রিপ্ট। সেটার শুটিং করতে যাব সামনের সপ্তাহে। ওটা করে, ডিসেম্বরে আমার একটা অভিনয়ের কাজ আছে।
গানের দল নিয়ে আসছেন এবার?
- আমাদের গানের দল ‘হুলিগানিজম’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিশেষ করে আমি, শুভদীপ, দেবরাজ, সুশ্রুত, কৃশানু এরা অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম। ২০১৫ সাল থেকে যখন আমরা ‘চৌমাথা’ বলে নাটক করি, তখন থেকেই একসঙ্গে মিউজিক নিয়ে কাজ করছি। এতদিন ধরে করতে করতে আমারই মাথায় পোকা নড়ে উঠল যে কিছু অরিজিনাল গান করি। একটু নতুন রকমের, এক্সপেরিমেন্টাল কিছু করার চেষ্টা করি। নজনের ব্যান্ড আমাদের। ঠিক করেছি শো করব, অ্যালবাম রিলিজ করব। সবকটা গান হবে অরিজিনাল (হাসি)।