আইন-আদালতের প্রশ্ন উঠলেই যে মানুষ ভড়কে যায়, এর কারণ তিনটি। ‘সময়,’ ‘খরচ’ ও ‘ভাষা’। তায় ভারতে ১০ লাখে বিচারকের সংখ্যা ২০। যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১০০-র উপরে, কানাডায় ৭৫। কাজেই রায় নিয়ে বিতর্ক ও একের পর এক আবেদন করে সময় নষ্টের যে প্রচেষ্টা চলে, সেটারও সীমা থাকা উচিত। লিখছেন নীল সরকার
‘মিছিলে যাচ্ছ, যাও। তবে মামলায় ফেঁসো না।’ সন্তানের প্রতি অভিভাবকের চিরন্তন সতর্কবাণী। স্বাধীনতার ‘প্ল্যাটিনাম জুবিলি’-তে এই কথা বলাই যায় যে, সংবিধান ও আইনের অধীনে নাগরিকদের সামাজিক ব্যবহার ও চরিত্র গড়ে উঠেছে। স্বদেশি শাসকের হাতে আইন এসে যাওয়ার পরেও অভিভাবকদের কেন এই শঙ্কা? সংবিধান-স্বীকৃত অধিকার আদায়ে কড়া নাড়তে হয় আদালতের। প্রশ্ন: আদালত আম-নাগরিকের নজরে সমস্যার সমাধান, না, খোদ সমস্যা?
উপনিবেশের শাসন-কাল থেকেই নাগরিক ও প্রশাসনের মাঝে একটা সচেতন ফারাক রাখা হয়েছে। নাগরিক অধিকার আমাদের সংবিধান মৌলিক অধিকারের মাধ্যমে নিশ্চিত করেছে। মুশকিল হচ্ছে, তার সীমানা সংখ্যাগরিষ্ঠের অজানা। উলটোদিকে, নাগরিকদের কর্তব্য বিষয়ে দায়বদ্ধতা নেই। আইন এই পরিসরে শাসক ও নাগরিককে নিয়ন্ত্রণ করে। অধিকার ও কর্তব্য- এই দ্বন্দ্বে আইন ভেঙে নাগরিকরা বিপত্তি বাধায়। আসে পুলিশ ও আদালত। অথচ পুলিশ ও আদালতের নামে আম-নাগরিকের কপালে ভাঁজ পড়ে।
[আরও পড়ুন: কৃষি আইন প্রত্যাহার নির্বাচনী চাল, না কি বোধোদয়?]
বাস্তব উদাহরণ, পুলিশের তদন্তকারীরা সাক্ষীর নাম লিখতে চাইলে ভিড় পাতলা হয়। কেন? কারণ, মানুষ সাক্ষ্য দেওয়াকে কর্তব্য বলে ভাবে না। জনমানসে ধারণা, আদালত বেশ সময় ও ঝক্কির ব্যাপার। মামলা শুরু হলে চট করে শেষ হয় না। সময় মানেই ‘অর্থ’। এই চেতনা থেকে নাগরিকরা সরে আসে। ইংরেজ আমলে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, মামলা বড়লোকদের বিষয়। দুটো সমস্যা উঠে আসে। এক ‘বড়লোকের বিষয়’, এই তকমা দূর করে গরিব নাগরিকদের নাগালে আনা। পরেরটা লম্বা সময় ধরে চলা মামলা। যে-কারণে নাগরিকরা এড়িয়ে যায়। সমস্যার থেকেও সময় তাদের কাছে বেশি দামি।
সময়ের সমস্যা কেন? আদালতের পরিকাঠামো ও মানবসম্পদ জনসংখ্যার অনুপাতে কম। ভারতে ১০ লাখে বিচারকের সংখ্যা ২০, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১০০-র উপরে, কানাডায় ৭৫। আগামী বছরের ক্যালেন্ডারে ২২০ দিন কাজের খবর প্রকাশিত হতেই বিতর্ক। পরলোকগমন করলে ছুটি অতিরিক্ত। করোনায় ভার্চুয়াল শুনানি শুরু হলেও কমতেই পুরনো পথে। ভারচুয়াল শুনানিতে কম কাগজের ব্যবহারে দূষণ নিশ্চিত কমে। ডিজিটাল পরিকাঠামো সারা দেশে ‘এক’ মানের নয়। আদালতের মক্কেলদের উপর নির্ভরশীল টাইপিস্ট, জেরক্স, ফুটপাথের হোটেল। কত সংসার চলে বলুন তো? আদালতকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অর্থনীতিও চিন্তার বিষয়।
অন্যদিকে, হাতের মোবাইলে চট করে সবকিছু পাওয়া যায়। মানুষের ধারণা, এক লহমায় সবকিছু সম্ভব। বিচারের যে প্রক্রিয়াটা প্রচলিত, তা প্রায় সার্ধশতবর্ষ আগের। সাক্ষীদের যাতায়াতের সমস্যা যেমন ছিল, তেমনই কাগজ তৈরিতেও বিপুল সময় নিত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেখে যাওয়া যে আইনি ভিতের উপর আমাদের বর্তমান কাঠামো দঁাড়িয়ে, সেই আইনের কোনওটার জন্ম ১৮৬১, তো কোনওটার ১৮৭২ সালে। ইংরেজরা উপনিবেশে নাগরিকদের বিচারের জন্য অতিরিক্ত পয়সা খরচ করতে রাজি ছিল না। বিচারের পয়সা উসুল করার লক্ষ্যে নানাবিধ ফি-র আয়োজন রাখা ছিল। গরিব মানুষরা একদিকে দামি আইনজীবী যেমন জোগাড় করতে পারতেন না, তেমনই মামলার ব্যয় বহন করতে অপারগ ছিলেন। মুখ বুজে অন্যায় মেনে নিতেন। সেই ধারণা দূর করতে সরকারি খরচে আইনজীবী দেওয়ার ব্যবস্থা হলেও নাগরিকরা তার কতটা সন্ধান রাখেন?
আদালতের ফারসি-ঘেঁষা ভাষা, বা সাবেক ইংরেজি স্বল্প আমজনতার কাছে হিব্রু। মোট কথা, সহজবোধ্য নয়। আদালতে দাঁড়িয়ে বিচারে কী চলছে, টের পান না। তৃণমূল স্তরের গরিব নাগরিক কেন জটিল এক বিষয়কে সমস্যার সমাধান বলে ভাববেন? কীভাবে আদালতের কাছে হাজির হলে সহজে বিচার পাওয়া যাবে- তা সাধারণ নাগরিকের অজ্ঞাতপ্রায়। বিষয়টা জটিল হয়েছে বিভিন্ন ফি ও তার আনুষঙ্গিক খরচে। একজন মানুষ সমস্যায় পড়ল, তারপর খরচ ও সময় ব্যয় করে রায় পেল। রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার আবেদন হলে খরচ চড়বে। স্বাভাবিক, সেই নাগরিক তখন পস্তাবেন।
একে-একে দেখলে সমস্যাগুলো হল ‘সময়,’ ‘খরচ’ ও ‘ভাষা’। বিশেষজ্ঞরা বলে, স্মার্টফোনের যুগে বিচারও তদন্তের মতো সময় বেঁধে করা উচিত। অতিরিক্ত বিচারক ও কর্মচারী নিয়োগে জনসংখ্যার অনুপাতে ভারসাম্য রাখা উচিত। প্রযুক্তি ব্যবহারে সময়ের সমস্যা কমতে পারে। নাগরিকদের সুবিধার্থে চলতি ভাষার ব্যবহার বাড়ানো উচিত। যেমন, ‘আলামত’ কতজন বুঝবে? পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো উচিত দেশের আইন ও তার ব্যবহার। ভাবা উচিত, আইন সব সমস্যার সমাধান নয়।
উন্নত দেশে আইনজীবীরা ‘কৃত্রিম মেধা’ ব্যবহার করে মামলার সম্ভাবনা জেনে মামলা রুজু করেন। অর্থাৎ, আদতে মামলা করার যুক্তির কতটা জোর, জানা জরুরি। কতটা সময় ও খরচ লাগবে, সেটাও জানিয়ে দেওয়া উচিত। আদালত ও নাগরিকদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ কাম্য। আদালত একমাত্র পরিষেবা, যা নিতে হয় কোনও পেশাদারের মাধ্যমে।
সরকার এই সময়ে দেশের অন্যতম বৃহত্তম মামলাকারী। সরকারকেও ভাবতে হবে মামলা রুজু করার আগে। সরকার ও বিচারব্যবস্থা সাধারণত এক রেখায় চলে- এটা নিন্দুকদের বয়ান। কাজেই ন্যায়ের বিষয়ে ভিন্ন মত হবে কী করে? তবে শাসক ও রাষ্ট্র ‘এক’ বিষয় নয়। কাজেই রায় নিয়ে বিতর্ক ও একের পর এক আবেদন করে সময় নষ্টের যে প্রচেষ্টা চলে, সেটারও সীমা থাকা উচিত। বারবার বিচার চেয়ে সত্যকে তো বদলে ফেলা যায় না। ১৯৫৬ সালের দেওয়ানি মামলাও বকেয়া আছে। সারা দেশে ছয় দশকের বেশি বয়সি মামলার সংখ্যা ১৪০-এর কাছাকাছি। প্রবাদ, বিচারে দেরির অর্থ বিচার না দেওয়া।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক প্রাবন্ধিক
sarkarnil91@gmail.com