বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: টুইঙ্কল খান্না সম্প্রতি আরিয়ান খানের (Aryan Khan) গ্রেপ্তারির ঘটনাকে ‘স্কুইড গেম’-এর (Squid Game) সঙ্গে তুলনা করেছেন। আবু ধাবির কোরিয়ান কালচারাল সেন্টার সম্প্রতি তাদের নিজেদের ‘স্কুইড গেম ভার্সান’ লঞ্চ করে। প্রতিটি সেশনে পনেরো জনের দু’টো টিম ‘স্কুইড গেম’-এর লোগো দেওয়া টি-শার্ট পরে এই শোয়ের কিছু গেম (গ্রিন লাইট রেড লাইট, মার্বল গেম, ডালগোনা গেম) খেলেছে। এর দেখাদেখি এক্সপো দুবাইও ‘রিয়্যাল লাইফ স্কুইড গেম’-এর আয়োজন করেছে তাদের কোরিয়ান প্যাভিলিয়নে।
বেলজিয়ামের একটি স্কুলে ‘স্কুইড গেম’ খেলেছে বাচ্চারা, শুধু তাই নয় যারা হেরেছে তাদের মারধর করেছে অন্য ছাত্ররা। ‘ওয়ালমার্ট’ এবং বিভিন্ন ফ্যাশন কোম্পানি এবার ‘স্কুইড গেম’-এর চরিত্রদের আদলে পণ্যদ্রব্য আনতে চলেছে। এবং এ বছর হ্যালোইন পার্টির জন্য ‘স্কুইড গেম’ কস্টিউম নিয়ে সবচেয়ে বেশি ইন্টারনেট সার্চ হয়েছে। আসন্ন কালীপুজোয় (Kali Puja 2021) যদি পুজোর প্যান্ডেলে ‘স্কুইড গেম’-এর থিম দেখতে পান অবাক হবেন না। ফ্রক পরা ভয়ংকর রোবট পুতুলের চাহিদা এখন সবচেয়ে বেশি।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এমন নানা ঘটনা ঘটেই চলেছে, ১৭ সেপ্টেম্বর নেটফ্লিক্সে (Netflix) হং দুং ইয়ক পরিচালিত সাউথ কোরিয়ান ওয়েব সিরিজ ‘স্কুইড গেম’ রিলিজ করার পর। নব্বইটি দেশে ‘স্কুইড গেম’ সর্বোচ্চ ভিউয়ারশিপ দখল করেছে। এই শো নেটফ্লিক্সের ব্যবসা, সাবস্ক্রিপশন একধাপে অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। বলা হচ্ছে প্রায় ৩.৮৬ মিলিয়ন সাবস্ক্রিপশন বেড়েছে। মুক্তি পাওয়ার প্রথম সপ্তাহে ১৪২ মিলিয়ন বাড়ির লোক এই ওয়েব সিরিজ দেখেছে বলে জানা গিয়েছে।
‘স্কুইড গেম’-এর বিষয় কী? বড়রা নিজেদের প্রাণ হাতে করে ছোটদের খেলা খেলতে নামে। একেকটা এপিসোড, একেকটা গেম। যে হারবে সে খতম! প্রচণ্ড রুদ্ধশ্বাস, নৃশংস এই মরণ-বাঁচনের খেলায় দেখতে মেতেছে গোটা দুনিয়া। যে জিতবে সে পাবে ৩৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার। এবং খেলছে কারা? ধার-দেনায় ডুবে থাকা আমজনতা। সে নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে, অতিশিক্ষিত ব্যবসায়ী, গ্যাংস্টার, পকেটমার, মধ্যবিত্ত দম্পতি থেকে মৃতপ্রায় বৃদ্ধ – কে নেই! পরিচালক হং দুং ইয়ক এই কনসেপ্ট নিয়ে প্রায় দশ বছরেরও বেশি ঘুরেছেন। কিন্তু অবাস্তব এবং হিংসাজনিত কারণে বেশ কিছু স্টুডিও এই ভাবনা নিয়ে ছবি বানাতে চায়নি। প্রথমে এটি চলচ্চিত্র হিসাবেই ভেবেছিলেন পরিচালক। পরিচালকের কথায় সত্যি ঘটনা থেকেই অনুপ্রাণিত ‘স্কুইড গেম’। সাউথ কোরিয়ার ধুঁকতে থাকা ইকোনমি, তাঁর নিজের একটা সময়ের আর্থিক অবনতি, তাঁর চারপাশের বন্ধু-বান্ধব- সবকিছু থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন পরিচালক।
এক সময় স্ক্রিপ্ট লেখা বন্ধ করে নিজের ল্যাপটপ বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন পরিচালক হং দুং ইয়ক। তাঁর কথায়, “আমার তখন আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ। ক্যাফেতে বসে জাপানিজ কমিক্স পড়তাম, অ্যানিমেশন দেখতাম। যেমন ‘ব্যাটেল গ্রাউন্ড’ বা ‘লায়ার গেম’। নিজে এই খেলায় প্রতিযোগী হলে কেমন হবে মনে মনে ভাবতাম। ‘স্কুইড গেম’-এ অবশ্য এত জটিল খেলা রাখতে চাইনি। বাচ্চাদের সহজ খেলাই রেখেছি যাতে দর্শকের বুঝতে সুবিধে হয়। এই সময়ে দাঁড়িয়ে, আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজের নিরিখে আমি একটা রূপকথার মতো গল্প বলতে চেয়েছিলাম। যে রূপকথায় উঠে আসে কমপিটিটিভ ক্যাপিটালিস্ট সমাজ। তবে এমন চরিত্রদের দিয়ে এই গল্প বলাতে চেয়েছি, যাদের সঙ্গে সবাই রিলেট করতে পারে।”
[আরও পড়ুন: পরপর ফ্লাইট বাতিল! কীভাবে ফিরবেন বাড়ি? বাগডোগরা বিমানবন্দরে দুশ্চিন্তায় পায়েল-দ্বৈপায়ন]
অন্য একটি সাক্ষাৎকারে হং দুং ইয়ক বলেন, “বিগত দশ বছরে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। আই.টি জায়ান্ট ‘গুগল’, ‘ফেসবুক’ মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। স্কুইড গেম-এ একজন ‘ভিআইপি’-র চরিত্রের সঙ্গে যেন ট্রাম্পের মিল পাওয়া যায়। ইটস অলমোস্ট লাইক হি ওয়াজ রানিং এ গেম স্পেস নট এ কান্ট্রি, লাইক গিভিং পিপল হরর।”
দশ বছর ধরে যে শোয়ের জন্য পরিচালক, প্রোডিউসার পাননি, সেই শো আজ কোটি কোটি মানুষের মুখে। এই পরিবর্তন আমাদের সমাজের দিকে আয়নাটা তুলে ধরে। ‘স্কুইড গেম’-এ আমরা দেখতে পাই নিরুপায় কিছু মানুষ, বেপরোয়া হয়ে ছুটছে টাকার পিছনে। খুড়োর কলের মতো সামনে ঝুলছে টাকা। সেই অর্থের লোভে একে অপরের প্রাণ নিচ্ছে। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এই ভয়ংকর খেলায় এগিয়ে আসছে কিছু মানুষ। এবং আরও একদল মানুষ এই ওয়েব সিরিজে আছে, তাদের দেখা যায় ‘ভিআইপি’দের চরিত্রে। তারা বসে বসে এই মরণ-বাঁচনের লাইভ শো দেখছে এবং এই খেলার পিছনে মোটা টাকা ব্যয় করছে। আর আছি আমরা যারা মোবাইলে, ল্যাপটপে দেখছি ‘স্কুইড গেম’। অসহায় মানুষের বাঁচার তাড়নায় রক্তপাত, হিংসা- এ সব আমাদের বড় প্রিয়।
‘খতরোঁ কে খিলাড়ি’, ‘সার্কাসে ট্রাপিজ’, সন্ত্রাস হামলার লাইভ টেলিকাস্ট, ধর্ষণের ‘সনসনি খেজ’ ডিটেল -এসব আমাদের কিক দেয়। আর সেই জন্যই নেটফ্লিক্স, ‘স্কুইড গেম’-এর সাবটাইটেল তৈরি করেছে ৩৭টি ভাষায় এবং ৩৪টি ভাষায় ডাব হয়েছে। ফলে বহু মানুষের কাছে খুব সহজেই পৌঁছে গিয়েছে এই ওয়েব সিরিজ। এটি অন্যতম প্রধান কারণ ‘স্কুইড গেম’-এর জনপ্রিয়তার নেপথ্যে। শুধু তাই নয়, ‘স্কুইড গেম’-এর চরিত্রদের সঙ্গে মানুষ নিজেদের সামাজিক অবস্থানের তুলনা করতে পারছে এবং সেই সঙ্গে রয়েছে টানটান উত্তেজনা। ‘বিঞ্জ ওয়াচ’-এর জন্য আইডিয়াল।
‘কোরিয়ান ছবি’ কোরিয়ান পপ কালচার এখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। বন-জং-হু-র ‘প্যারাসাইট’, সাউথ কোরিয়ান ব্যান্ড ‘বি টি এস’, আরও একটু পিছিয়ে গেলে রয়েছে সাউথ কোরিয়ার গায়ক পি এস ওয়াই-এর গ্যাংনাম স্টাইল। ‘কে-পপ’, ‘কে-ড্রামা’র জনপ্রিয়তা এনক্যাশ করছে OTT প্ল্যাটফর্মগুলো। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি বাধ্য হয়েছে ৩৬টি কোরিয়ান শব্দ সংযোজন করতে তাদের অভিধানে। এবং ‘স্কুইড গেম’ যতই ‘ক্যাপিটালিজম’-এর ভয়ংকর দিক তুলে ধরুক না কেন, এই পুঁজিবাদ এখন চলছে চলবে রমরমিয়ে– এটাই আয়রনি।
রুদ্ধশ্বাস এই শো একটানে দেখে ফেলার পর কেউ অত তলিয়ে ভাববে না, যে উপায় থাকে। সব সময়ই দু’টো রাস্তা থাকে আমাদের কাছে। এবং পরিচালক বিশ্বাস করেন, গোটা পৃথিবী একদিকে গেলে, কোথাও না কোথাও একজন থাকে যে সাম্যবাদ, মানবতাবাদের রাস্তাটা বেছে নেয়। মুশকিল এটাই যে আমরা কেউই সেই ‘একলা একজন’ হতে চাই না।