অপরাজিতা সেন: সদ্যপ্রয়াত প্রবাদপ্রতিম চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদারকে (Tarun Majumdar) নিয়ে সিপিএমের (CPIM) বাড়াবাড়ি দেখলাম। শুধু এইটা বুঝলাম না, যাঁর মরদেহে লাল পতাকা রাখা যায়, পার্টি তাঁকে সদস্যপদ দেয়নি কেন? বস্তুত, তরুণ মজুমদার নিশ্চয়ই তাঁর দিক থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বামপন্থাকেই ভালবেসেছেন, কিন্তু প্রশ্ন হল, লোকদেখানো নাটকের বাইরে সিপিএম তাঁকে রাজনৈতিক মর্যাদা কতটুকু দিয়েছে?
তরুণ মজুমদার বাংলা ছবির জগতে একটি যুগ, একটি নাম। বাঙালিয়ানা, বঙ্গসংস্কৃতি, সুস্থ চিন্তা, যৌথ পরিবার, রবীন্দ্রসংগীত, নতুন শিল্পী তৈরি— সব মিলিয়ে তিনি একাই একটা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস ও অবস্থান যাঁরা স্মৃতিচারণে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন, তাঁরা কি অনেকটা ফাঁক রেখে যাচ্ছেন না?
তরুণবাবু এখনকার তৃণমূল (TMC) সরকারের সমর্থক ছিলেন না। বামেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। গণশক্তিতে যেতেন, লাইব্রেরিতে বসতেন। অতএব সিপিএম তাঁহার মরদেহে রক্তপতাকা অর্পণ করিয়া দিকে দিকে বার্তা স্পষ্ট করিল, কমরেড আমাদিগের একজন। ছোট, বড়, মাঝারি নেতারা হাজির। যে সিপিএম মহানায়ক উত্তমকুমারের (Uttamkumar) মরদেহ রবীন্দ্রসদনে রাখতে দেয়নি, শেষ সম্মান জানায়নি, তাদের নব্য বহুবার পরাজিতরাও স্টুডিওপাড়ায় হাজির। চরম দ্বিচারিতা।
[আরও পড়ুন: পোস্টারে দেবী ‘কালী;র অপমান! এবার পরিচালকের মুণ্ডচ্ছেদের হুমকি অযোধ্যার পুরোহিতের]
তরুণ মজুমদার কতটা সিপিএম ছিলেন? এবং সিপিএম তাঁকে কতটা স্বীকৃতি দিয়েছিল?
অনিল চট্টোপাধ্যায়, অনুপ কুমাররা যেরকম শাখায় সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় ছিলেন, তরুণবাবু ছিলেন না। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়েরও যতটুকু বাম-ঘনিষ্ঠতা ছিল, তরুণবাবুর ততটাও নয়। ২০১১ সালে পরিবর্তনের নির্বাচনের আগে তিনি বামফ্রন্টের সমর্থনে এবং তৃণমূলের বিরোধিতায় বিবৃতি দেন। স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তনের পর নতুন সরকারের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে তরুণবাবুর। তখন সিপিএমের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা তুলনায় বাড়ে। সেটা অটুট ছিল।
তরুণবাবুর ঘনিষ্ঠমহল সূত্রে আক্ষেপ, পরিচালক যখন আন্তরিকভাবেই পার্টির কাজ করতে চেয়েছেন, তখন সিপিএম সেভাবে সাড়া দেয়নি। এমনকী সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময় অনিন্দিতা সর্বাধিকারীর মতো জঘন্য পরিচালককে দিয়েও পার্টি তথ্যচিত্রের কাজ করিয়েছিল, তরুণবাবুকে সেভাবে কাজে লাগায়নি। পার্টির গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের কাজেও তাঁর মতো অভিজ্ঞকে ব্যবহার করা হয়নি সেভাবে।
আইপিটিএ যুগের পর অনেক বুদ্ধিজীবীই সরে যান। কিন্তু তরুণবাবুকে কাজে লাগানো হয়নি তারপর। তিনি পার্টির সভা, সমাবেশে গেলেও সিপিএম তাঁকে সদস্যপদও দেয়নি। অথচ মৃত্যুর পর সেই তরুণবাবুকেই নিজেদের লোক বলে দেখাতে দৌড়ঝাঁপ করে গেলেন এখনকার সিপিএম নেতৃত্ব। বিবৃতির বন্যা বইল। তরুণবাবুর ঘনিষ্ঠমহল বলছে, তাঁর ইচ্ছে ছিল পার্টি সদস্যপদের। কিন্তু সিপিএম তা দেয়নি।
মঙ্গলবার ‘গণশক্তি’ লিখেছে, “আজীবন বামপন্থী।” যদি তাই হয়, তাহলে এত ঘনিষ্ঠতা থাকলেও তাঁকে সম্মান দিয়ে পার্টি সদস্যপদ দেয়নি কেন? মরদেহে লাল পতাকা দিলেও, কেন শেষ শ্রদ্ধা জানাতে নিয়ে যাওয়া হল না আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে? যেখানে তরুণবাবুর শেষ মুহূর্তে তৃণমূলের মন্ত্রীরা এবং প্রশাসন মুখ্যমন্ত্রীর নজরদারিতে যাবতীয় কর্তব্য পালন করেছেন, সেখানে বামেদের পক্ষ থেকেই যেন ঘাটতি প্রকট হয়ে উঠেছে। এইসব নিয়ে বাম মহলেও ময়নাতদন্ত চলছে।