সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: শুধু দশমী নয়, একাদশীতে মহরমের দিনও প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া যাবে। বৃহস্পতিবার এক অন্তর্বর্তী নির্দেশে একথা জানায় কলকাতা হাই কোর্ট। আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার কথা ছিল রাজ্যের। কিন্তু শুক্রবার আইনজীবী তথা তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছে না রাজ্য।
তাঁর বক্তব্য, ‘এই রায় আদতে রাজ্যের পক্ষেই গিয়েছে।’ রায়ের নথির ১৭ নম্বর পাতার প্রথম অনুচ্ছেদে আদালতের বয়ানকে হাতিয়ার করে কল্যাণবাবুর বক্তব্য, “আদালত বলেছে ‘যদি রাজ্য মনে করে বিসর্জন দেওয়ার অনুমতি দেবে…।’ কল্যাণবাবু জানিয়েছেন, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই তো একাদশীর দিন বিসর্জন বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছিল প্রশাসন। আদালতও তো তাই বলেছে। তাহলে আদালতের নির্দেশ মানতে অসুবিধা কোথায়? খোদ মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন, সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে শান্তিরক্ষার স্বার্থে মহরমের তাজিয়া ও বিসর্জনের শোভাযাত্রা একসঙ্গে একদিনে না বেরনোই ভাল। অন্যদিকে এদিনও, বিসর্জন ও মহরমে সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে নবান্নে জরুরি বৈঠকে বসেন কলকাতার সিপি ও অন্যান্য পুলিশকর্তারা। উৎসবের নিরাপত্তা নিয়ে নবান্নে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বসেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পুজো, মহরমের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে এই বৈঠকে। হাইকোর্টের রায়ের পর বিসর্জন-মহরমের তাজিয়া যাতে সুষ্ঠুভাবে বার করা যায়, তারই প্রস্তুতিতে এদিনের বৈঠক বলে সূত্রের খবর। বৈঠকে রয়েছেন স্বরাষ্ট্রসচিব, মুখ্যসচিব, ডিজি, সিপি, এসপি-সহ পুলিশ আধিকারিকরা।
[আদালতের বিসর্জন নির্দেশ মানতে অসুবিধা নেই, প্রতিক্রিয়া রাজ্যের]
একাদশীর দিন বিসর্জন নিষিদ্ধ করে রাজ্য সরকারের দেওয়া বিজ্ঞপ্তির বিরুদ্ধে মোট তিনটি জনস্বার্থ মামলা হয় হাই কোর্টে। সেই মামলায় বৃহস্পতিবার ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাকেশ তিওয়ারি ও বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডনের ডিভিশন বেঞ্চের অন্তর্বর্তী নির্দেশ, শুধু দশমী নয়। মহরম-সহ সবদিনই রাত ১২টা পর্যন্ত বিসর্জন দেওয়া যাবে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। এছাড়াও রাজে্যর ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ, সমস্ত পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের আদালতের নির্দেশ, মহরমের তাজিয়া ও বিসর্জনের শোভাযাত্রার জন্য আলাদা রুট করতে হবে। কীভাবে পৃথক রুট ঠিক হবে তা আলোচনা মাধ্যমে ঠিক করতে হবে। তাজিয়া ও শোভাযাত্রার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশকর্মী মোতায়েন রাখতে হবে। বুধবার এই মামলার শুনানি শেষ হয়ে গেলেও রাজ্যের আবেদনে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার আগে আরও একবার নিজেদের বক্তব্য জানানোর সুযোগ দেয় আদালত। সেই বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে অ্যাডভোকেট জেনারেল (এজি) কিশোর দত্ত বলেন, “ধর্মীয় আচার পালনের অধিকার যেমন সংবিধান দিয়েছে তেমনই আইনশৃঙ্খলার স্বার্থে কোনও ধর্মীয় মিছিলকে নিয়ন্ত্রণের অধিকার রাজ্যের রয়েছে।” তাবর বক্তব্যের স্বপক্ষে তিনি সুপ্রিম কোর্টের একটি মামলার উদাহরণও দেন। আদালতের কাছে এজি-র প্রশ্ন, “যদি কোনও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে যায় তাহলে কে দায়ী থাকবে?”
[মহরমেও হবে বিসর্জন, রায় হাই কোর্টের]
এজির এই বক্তব্য শুনে প্রধান বিচারপতি রাকেশ তিওয়ারি বলেন, “কোনও জমায়েত থেকে যদি হিংসা ছড়ায় সেখানে প্রথমে জল কামান ব্যবহার করার রীতি। তারপর প্রয়োজনে মৃদু লাঠি চার্জ করা যেতে পারে। কিন্তু প্রথমেই তো গুলি চালানো যায় না?” তিনি যোগ করেন, “প্রথমেই যেমন গুলি যেমন চালানো যায় না তেমনই কিছু ঘটার আগেই নিষেধাজ্ঞা জারি করা যায় না।” প্রধান বিচারপতি বলেন, “কোনও অনভিপ্রেত ঘটনার আশঙ্কা থাকলে আগে থেকে সতর্ক হওয়া উচিত। সরকারের হাতে ক্ষমতা আছে। তাকে কাজে লাগান। কিন্তু নির্দিষ্ট একটি দিন নিরঞ্জনে নিষেধাজ্ঞা জারি কোন কারণে, তা স্পষ্ট নয়।” প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের জবাবে এজি বলেন, “সরকার অনভিপ্রেত ঘটনা এড়াতে আগে থেকেই ব্যবস্থা নিয়েছে। তাছাড়া বিসর্জনের জন্য চার দিন দেওয়া হয়েছে। মাঝে একটা দিন শুধু বাদ রাখা হয়েছে। একাদশীর পরে আরও তিন দিন বিসর্জন চলবে।” প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন তোলেন, “আপনারা ক্যালেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন? চাঁদের গতি কি সরকারের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব?” প্রধান বিচারপতি জানতে চান, এর আগেও প্রতিমা নিরঞ্জন ও মহরম একসঙ্গে পড়েছে। কোনও গোলমালের উদাহরণ দিতে পারেন?” ডিভিশন বেঞ্চ আরও বলে, “সরকারের হাতে ক্ষমতা আছে বলেই তা খেয়ালখুশি মতো ব্যবহার করা যায় না। আদালতও সেই নির্দেশ দিতে পারে না। নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।” এরপরই ওই অন্তর্বর্তী রায় দেয় ডিভিশন বেঞ্চ। রায়ের পরই তাতে অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ চান এজি। তাঁর সেই আবেদন খারিজ করে দেয় আদালত। মামলাকারীদের তিন সপ্তাহের মধ্যে জবাবি হলফনামা দিতে বলা হয়েছে। পাঁচ সপ্তাহ পর ফের এই মামলার শুনানি হবে।
[বিসর্জন মামলার শুনানিতে রাজ্যকে ফের তোপ হাই কোর্টের]
আদালতের রায়ের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, রাজ্য প্রশাসন চেয়েছিল আগাম সতর্ক থাকতে। কারও নাম না করে মুখ্যমন্ত্রী জানান, অশান্তি কিছু হলে বিজেপিই পুরোপুরি দায়ী থাকবে। “খুঁচিয়ে ঘা করার চেষ্টা হচ্ছে। দেখছে, রাজ্যের মানুষ শান্তিতে আছে। ভাবল, তাদের মধ্যে একটু অশান্তি লাগিয়ে দেবে।” বলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “শান্তি বজায় রাখতে কষ্ট হয়। অশান্তি করতে এক সেকেন্ড সময় লাগে। আগুন লাগলে নেভাতে কষ্ট হয়। জ্বালাতে একটা দেশলাই কাঠিই যথেষ্ট। এত হিংসা কেন? এত চক্রান্ত কেন?” দক্ষিণ কলকাতায় মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের পুজো একডালিয়া এভারগ্রিনের উদ্বোধনে গিয়ে একথা বলেন মমতা। পাশে বসা সুব্রতবাবুকে সেখানেই তিনি প্রশ্ন করেন, “বলুন তো সুব্রতদা, আপনি কি একাদশীতে প্রতিমা বিসর্জন দেবেন?” সুব্রতবাবু মাথা নাড়িয়ে বোঝান, দেবেন না। এর পরই প্রশ্নের অভিমুখ উপস্থিত জনতার দিকে ঘুরিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ দাগেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, “এই পুজো আমাদের প্রাণের পুজো। একাদশীর দিন কেউ মা’কে বিসর্জন দেয় নাকি? যে দেবে, সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার।” একইসঙ্গে মমতার সংযোজন, “বলছে, বাংলায় সংহতি নেই! শিক্ষা নেই, সাহিত্য নেই, সংস্কৃতি নেই! কখনও কখনও আমার খুব রাগ হয়। যখন বাংলাকে নিয়ে কেউ জ্ঞান দেয়। গালাগালি করে।” মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “আমায় গালাগাল করুক। কিন্তু বাংলার সংহতিকে না। বাংলাকে এরা জানে না। যারা জানে, তারা জ্ঞান দেবে না। বাংলার মানুষ জানে, বাংলা যা পারে, অন্য কেউ তা পারে না। এরা বাংলার কৃষ্টি—সংস্কৃতি জানে না। বাংলা আমার গর্ব। বাংলা নিয়ে ওদের জ্ঞান শুনব না।” মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি, “ভাগাভাগি করার কোনও অধিকার মানুষকে কেউ দেয় না। গণতন্ত্র দেয় না। সংবিধানও দেয় না। আমি সংবিধান মেনে চলা লোক।” বস্তুত এর পর বিজেপির অস্ত্রেই বিজেপিকে ঘায়েল করার পথ নেন মমতা। বলেন, “বলছে আমি তোষণ করি! এটা অপমানজনক কথা।” তাঁর স্পষ্ট দাবি, “আমি সেই ধর্মে বিশ্বাস করি, যার নাম মানবধর্ম। আমি সেই ধর্মে বিশ্বাস করি, যে ধর্মের নাম সর্বধর্মসমন্বয়।