shono
Advertisement
Gaza

'এত রক্ত কেন!' অন্ধ নিশানার বারুদগন্ধে হতভম্ব গাজার শৈশব

কেবলই গাজা নয়... হাইতি, সুদান, সিরিয়া, ইউক্রেন, ইয়েমেন- তালিকা রীতিমতো দীর্ঘ।
Published By: Biswadip DeyPosted: 06:21 PM Apr 12, 2025Updated: 06:33 PM Apr 12, 2025

বিশ্বদীপ দে: 'সে কহিল, 'এত রক্ত কেন!'

Advertisement

এমন একপ্রকার কাতর স্বরে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করিল ‘এত রক্ত কেন’, যে, রাজারও হৃদয়ের মধ্যে ক্রমাগত এই প্রশ্ন উঠিতে লাগিল ‘এত রক্ত কেন!’ তিনি সহসা শিহরিয়া উঠিলেন।'

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'রাজর্ষি'র এই কয়েকটি লাইন বোধহয় সম্প্রতি বড় বেশি করে উচ্চারিত হচ্ছে মহাকালের হৃদয়ে। নেট ভুবনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাজার বিধ্বস্ত দৃশ্যে বহু সংবেদনশীল হৃদয়ে ঘা লাগছে। ঘা তো লাগছে, প্রতিবাদও হচ্ছে। কিন্তু মানুষ মারার, মানুষকে গৃহহীন করার যেমন খামতি নেই, তেমনই শিশুদেরও রেয়াত না করার অন্ধ প্রবণতারও নেই অন্ত। কেননা রাজার হৃদয়ে কোনও প্রশ্ন জাগছে না। সে রাজার নাম নেতানিয়াহু হোক কিংবা ট্রাম্প! হামাস জঙ্গিরাও দিব্যি লুকিয়ে পড়ছে হাসপাতালে। আর তাদের মারার 'অজুহাতে' বোমা মেরে চলেছে ইজরায়েলি বাহিনী। হাজারে হাজারে মরছে 'উলুখাগড়া'। ট্রাম্প সাহেবের আবার স্বপ্ন তিনি গাজা 'সাফ' করবেন। গড়ে তুলবেন 'ট্রাম্প গাজা'। আর সেজন্য ঘরহারা, স্বজনহারা মানুষগুলোকে পাঠিয়ে দেবেন প্রতিবেশী দেশগুলিতে! এই পৃথিবী এখন দাঁড়িয়ে আছে এখানেই। যুদ্ধবাজ চরম দক্ষিণপন্থীদের তাণ্ডবে রক্তে ভিজছে মাটি। সেই মাটিতে সবচেয়ে বেশি যা নজর কাড়ছে, তা ছিন্নভিন্ন শৈশবের জলছাপ।

ইউনিসেফের পরিসংখ্যান বলছেন, ১৮ মাসের যুদ্ধে গাজায় অন্তত ১৫ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়েছে। জখম ৩৪ হাজার। এবং অন্তত ১০ লক্ষ শিশু ঘরছাড়া! আর শুধু কি গাজা? হাইতি, সুদান, সিরিয়া, ইউক্রেন, ইয়েমেন... তালিকা রীতিমতো দীর্ঘ। একটা পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমান বিশ্বের প্রতি ৫টি শিশুর মধ্যে একজনই যুদ্ধের অভিশাপের শিকার। যুদ্ধ বা প্রতিহিংসার কবলে থাকা দেশগুলিতে সব মিলিয়ে ৪৭৩ মিলিয়ন শিশু রয়েছে। অর্থাৎ ৪৭ কোটি। এদের মধ্যে অনেকেই ঘরছাড়া। যাদের কেউ কেউ হয়তো একদিন না একদিন ফিরে আসবে। আবার অনেকেই আর কখনও নিজের বাড়িতে ফিরতে পারবেন। যুদ্ধের আগুনে তাদের শৈশব পুড়ে গিয়েছে। ২০১০ সালের পর থেকে গত পনেরো বছরে যুদ্ধে শিশুমৃত্যুর হার তিনগুণ বেড়ে গিয়েছে। ল্যান্ডমাইন ও বিস্ফোরকে মৃতদের অর্ধেকই প্রায় শিশু!

বড়দের পৃথিবীতে এভাবেই গুলি-বোমার ছোবলে বিপন্ন শৈশব। আর এব্যাপারে কেবল নতুন সহস্রাব্দকে কাঠগড়ায় তুলে লাভ নেই। একদিন আদিম অরণ্যে কৃষিকাজ শিখে সমাজবদ্ধ হতে শিখেছিল মানুষ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ঘৃণার চাষ করতে করতে সে সমাজকে ছিন্নভিন্ন করতেও শিখে গিয়েছে। নিষ্পাপ শৈশবকে পায়ের তলায় দলে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে তার কোনও সমস্যা হয় না। অচেতন মন আর পাথুরে হৃদয় নিয়ে সে অনবরত লক্ষ্যভেদ করছে শিশুর হৃদয়ের পাঁজর!

আবারও মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথকে। ১৯১২ সালে একটি নাটক লিখেছিলেন তিনি। 'ডাকঘর'। তখনও বিশ্বযুদ্ধ কাকে বলে জানে না পৃথিবী। এর ঠিক তিরিশ বছর পরের পৃথিবীতে পোল্যান্ড‌ের রাজধানী ওয়ারশ-এর বন্দি শিবিরে মঞ্চস্থ হল সেই নাটক। ততদিনে একটি বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে আরও একটি শুরু হয়েছে। যুদ্ধোন্মাদ হিটলারের দখলে পোল্যান্ড। সেই হিংসা-ঘৃণাময় দানবিক সময়ে দাঁড়িয়ে ইহুদি ডাক্তার জানুস করজ্যাক তাঁর অনাথ আশ্রমের ১৯২ জন শিশুকে নিয়ে মঞ্চস্থ করলেন এই নাটকটিই। শুধু তো নাটক করাই নয়। এই নাটকের সংলাপ, মুহূর্তগুলি বদলে দিয়েছিল মৃত্যুর অন্ধ আক্রোশের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা হতভাগ্য শিশুগুলিকে। মঞ্চস্থ করা কিংবা তার আগের মহড়া- বারবার অমলের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে করজ্যাক আসলে ওই শিশুদের মনে মৃত্যুকে সহজে গ্রহণ করার বীজ পুঁতে দিয়েছিলেন। ট্রেবলিংকার শ্রমশিবিরে ডাক পাওয়ারও তারা ছিল অকুতোভয়। গ্যাস চেম্বারে মৃত্যুর নীল বিষাক্ত শ্বাসের কথা তারা জানত। কিন্তু ভয় পায়নি। অমলের ঘুম তাদের জাগিয়ে রেখেছিল। এই ইতিহাস নৃশংসতার, লজ্জার। যুদ্ধের বীরপুঙ্গবরা নিরীহ শিশুদের অবলীলায় ছুড়ে দিয়েছে মৃত্যুরাক্ষসের দংষ্ট্রার ভিতরে। বরাবরই নারী ও শিশুদের এভাবেই যুদ্ধের 'সহজ শিকারে' পরিণত করা হয়েছে। আশি বছরেরও বেশি সময় পরে সেই প্রবণতা টোল খায়নি। পশুত্বের নির্মম ধর্মে মানুষ আজও একই রকম শিশুমৃত্যুবিলাসী। গাজা-সিরিয়া-ইউক্রেনের অশ্রুসিক্ত ছবি আমাদের সেই কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।

গত জানুয়ারিতে আমরা দেখেছিলাম মাহমুদ ফাসির কান্না। ঘরছাড়া হয়ে সমুদ্রের উপকূলে কোনও মতে ঠাঁই নিয়েছিলেন সন্তানদের নিয়ে। কিন্তু তীব্র শীতের ভয়াল কামড়ে আচমকাই দেখতে পেলেন কোলের ঘুমন্ত শিশুটি কখন যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে চিরকালের মতো! অসহায় বাবা গরম পোশাক জোগাড়ের চেষ্টা করেছেন। তবু তা দিয়ে অপত্যের শরীরে ঢুকতে থাকা ঠান্ডা স্রোতকে রুখতে পারেননি। মাহমুদ অতিকায় হিমশৈলের স্রেফ চুড়োমাত্র। ঠাঁইনাড়া মানুষ এভাবেই অসহায়ের মতো দেখেছে শিশুদের মৃত্যু। দেখে চলেছে। কেউ যুদ্ধের সরাসরি আঁচে দগ্ধ হয়েছে। কেউ যুদ্ধের কালো ছায়াতেই পৃথিবী ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে অনন্তের পথে।

সাময়িক যুদ্ধবিরতি শেষ হতেই স্রেফ মার্চ থেকে এই ক'দিনে অন্তত ৫০০ শিশু প্রাণ হারিয়েছে বলে দাবি করছে আল জাজিরার একটি রিপোর্ট। রাষ্ট্রসংঘের মতে গাজা এখন 'পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপ্টিক কিলিং জোন'। অর্থাৎ প্রলয়-পরবর্তী হত্যাক্ষেত্র। কেবল কি শিশু? ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই ঝলসে যাচ্ছে সম্ভাব্য প্রাণ! গত বছরের এপ্রিলে সামনে এসেছিল এমনই এক হাড়হিম তথ্য। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে গাজার সবচেয়ে বড় ফার্টিলিটি ক্লিনিকে ইজরায়েলি সেনার হামলায় ধ্বংস হয়ে যায় চারহাজারেরও বেশি 'টেস্টটিউব বেবি'। পাশাপাশি নিষেকের জন্য সংরক্ষিত হাজারেরও বেশি শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর নমুনাও ধ্বংস হয়ে যায় আল বামসা আইভিএফ সেন্টারের সেই বিস্ফোরণে।

কেবল মৃত্যুই নয়। যুদ্ধের থাবার আঘাত নানাভাবে দীর্ণ করে। ইউনিসেফ গত ডিসেম্বরে জানিয়েছিল গাজার ৯৬ শতাংশ নারী ও শিশু ভুগছে অপুষ্টিতে। রেশনের সস্তা আটা, ডাল, পাস্তা ও টিনের খাবার খেয়ে তারা বেঁচে আছে। কিন্তু তিলে তিলে ক্ষয়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্য ও মন। যা হয়তো সারবে কখনও, হয়তো কোনওদিনও আর সম্পূর্ণ সারবে না। আবার অনেকের এইটুকুও জুটছে না। সামান্য খাবার আর জলের জন্য তাদের হাহাকার পৃথিবীর কেন্দ্র পর্যন্ত ছড়িয়ে যাচ্ছে।

এই-ই গাজা। অথবা এই-ই যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীর করুণ ও তোবড়ানো চেহারা। গাজার পাশাপাশি অন্য সব যুদ্ধক্ষেত্রের ছবিটাও কি এমন নয়? অথচ সেসব ভুলে গাজাকে ঘিরে মুক্তাঞ্চল গড়ার স্বপ্ন দেখছেন ট্রাম্প। এই তো কয়েকদিন আগে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু আমেরিকায় আসার পর সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেছেন, গাজা ভূখণ্ডেরর ‘নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানার’ জন্য এক শক্তিশালী মার্কিন শান্তিবাহিনী থাকলে ভালো হয়। গত জানুয়ারিতে দ্বিতীয়বার মসনদে বসেই ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, তিনি গাজা খালি করে দিতে চান। গাজার অসহায় বাসিন্দাদের আশ্রয় দিতে প্রতিবেশী দেশ মিশর, জর্ডনকে অনুরোধ জানাতে দেখা যায় তাঁকে। পরে তিনি বলে বসেন, গাজা কিনতে হবে না, এমনিই নিয়ে নেবে আমেরিকা। ওখানে তো কেনার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখানেই শেষ নয়। ফেব্রুয়ারির শেষে একটি ভিডিও শেয়ার করেন ট্রাম্প। এআইয়ের সাহায্যে ভবিষ্যতের গাজার ছবি দেখাচ্ছে সেই ভিডিও।

প্রথমে সেই ভিডিওয় দেখা গিয়েছে শিশুদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে রাখা হামাস জঙ্গিদের। সকলে পালাচ্ছে। ভেঙে পড়ছে ঘরবাড়ি, মানুষের স্বপ্ন। আর তারপরই মৃত্যুপুরী হয়ে উঠছে মায়ানগর। হাওয়ায় উড়ছে টাকা। রেস্তরাঁয় জমজমাট উল্লাস। আনন্দে মশগুল ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও। কারও বা হাতে ট্রাম্পের সোনালি মুখের বেলুন। পথের মাঝে 'পৃথিবীর রাজা' মার্কিন প্রেসিডেন্টের বড় সোনার মূর্তি! এক বিলাসবহুল বাড়ির সামনে লেখা ‘ট্রাম্প গাজা’। সমুদ্রের ধারে সাঁতারের পোশাকে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু। দেখতে বসলে ঋত্বিক ঘটককে ধার করে বলতে ইচ্ছে হয় 'সে যে কী বীভৎস মজা!' আর সেই অশ্লীল মজার গাজায় নেই যুদ্ধে বিপন্ন শিশুর সারি। ট্রাম্প তাদের কোথাও না কোথাও শরণার্থী সাজিয়ে পাঠিয়ে দিয়েই খালাস! এই না হলে রাজার স্বপ্ন! গাজা বা পৃথিবীর অন্যত্র শিশু-সহ যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের করুণ ছবিকে ফুটিয়ে তুলতে কোনও পরিসংখ্যান হাতের কাছে না থাকলেও এই ভিডিওটি একবার দেখে নিলেই হয় বোধহয়।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • ১৮ মাসের যুদ্ধে গাজায় অন্তত ১৫ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়েছে। জখম ৩৪ হাজার। এবং অন্তত ১০ লক্ষ শিশু ঘরছাড়া!
  • আর শুধু কি গাজা? হাইতি, সুদান, সিরিয়া, ইউক্রেন, ইয়েমেন... তালিকা রীতিমতো দীর্ঘ।
  • একটা পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমান বিশ্বের প্রতি ৫টি শিশুর মধ্যে একজনই যুদ্ধের অভিশাপের শিকার।
Advertisement