সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ফের মার্কিন মসনদে ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump)। খাতায় কলমে জাদুসংখ্যা ২৭০ থেকে তিন আসন দূরে থাকলেও তিনিই যে শেষপর্যন্ত আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন তা পুরোপুরিই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। তাঁর মসনদে প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে কাটাছেঁড়া শুরু হয়ে গিয়েছে। এই জয়কে অতি দক্ষিণপন্থার জয় হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজনীতির ময়দানে বর্ণময় এক চরিত্র ট্রাম্প। গোটা পশ্চিমী বিশ্বে অতি ডান নীতি ও বাকচতুরতাকে রাজনৈতিক মূলমঞ্চে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই তাঁর অন্যতম ইউএসপি। যার অনুরণন দেখা গিয়েছে অন্যান্য রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যেও। যে অভিবাসন নিয়ে এত কথা বলেছেন ট্রাম্প, সেটাই ফ্রান্স, ব্রিটেনের মতো দেশেও গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছিল। কয়েক মাস আগেই ইংল্যান্ডের নির্বাচনে সুনাকদের পরাজয়ের পিছনেও সেই অভিবাসী কাঁটাই অতি বড় একটা ইস্যু ছিল। আবার ফ্রান্সেও সেটা বারে বারে রাজনৈতিক বিতণ্ডার কেন্দ্রে চলে এসেছে। আসলে গোটা ইউরোপেই এক দশক ধরে এটা একটা জ্বলন্ত ইস্যু। ইউরোপের অভিবাসী জনসংখ্যা ২০১০ সালে ছিল ৮.৫ শতাংশ। যা পরবর্তী বারো বছরে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ সালে ১০ শতাংশ হয়ে গিয়েছে। সেই ইস্যুটি বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতারও প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার ছিল। যে কটি ফ্যাক্টর ট্রাম্পকে শেষপর্যন্ত কমলার থেকে এগিয়ে দিল তার মধ্যে অন্যতম হল অভিবাসন সমস্যা।
ভোটের (US Election Result 2024) আগে অ্যারিজোনায় নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্যে রাখতে গিয়ে ঘুরিয়ে অভিবাসীদের ‘আবর্জনা’ বলেন ট্রাম্প। তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল, “আমরা আসলে বাকি বিশ্বের কাছে আবর্জনার পাত্রের মতো।” ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে কটাক্ষ করে ট্রাম্প আরও বলেন, “আমেরিকা আসলে অনেকের কাছেই আবর্জনা ফেলার একটা জায়গা মাত্র।” অনেকেরই বক্তব্য, ঘুরিয়ে অভিবাসীদেরই আবর্জনা বলছেন ট্রাম্প। এরও আগে গত ডিসেম্বরে ট্রাম্প একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। জানিয়েছিলেন, ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করলে তিনি মোটেই একনায়ক হয়ে উঠবেন না। তবে এর ব্যতিক্রম রয়েছে। একেবারে প্রথম দিনটিতে তিনি একনায়কত্ব দেখাবেন! আসলে এক টিভি অনুষ্ঠানে ভাষণ দিচ্ছিলেন বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা। সেই সময় তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, ক্ষমতায় ফিরলে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধ’ নেবেন কিনা। জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি একনায়ক হয়ে উঠবেন না তো। এর জবাবে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলে ওঠেন, ”না না। তবে প্রথম দিনটা…”
প্রথম দিন কী এমন করবেন? ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ট্রাম্প দাবি করেন, দেশের দক্ষিণ সীমান্ত, যেদিকে মেক্সিকো রয়েছে সেই সীমান্ত বন্ধ করে দেবেন তিনি। পাশাপাশি তৈল খননও বাড়াবেন। আর এটা করবেন প্রথম দিনই, একনায়ক হয়ে। মেক্সিকো সীমান্ত হয়ে বহু মানুষ আমেরিকায় প্রবেশ করেন আশ্রয়ের খোঁজে। ক্ষমতায় এসে মার্কিন মুলুকে শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ আটকাতে এই সীমান্তেই প্রাচীর তোলার ঘোষণা করেছিলেন ট্রাম্প। এই ধরনের মন্তব্য যে শেষপর্যন্ত তাঁর অনুকূলেই গিয়েছে তা প্রমাণিত হতে থাকে ভোটগণনা শুরুর পর থেকেই। এমনকী অনিশ্চয়তার যে সাত প্রদেশ, সেই 'সুইং স্টেটে'ও ট্রাম্প একেবারে নিরঙ্কুশ জয় পেতে চলেছেন। তিনটিতে জিতেই গিয়েছেন। বাকিগুলিতেও অনেক এগিয়ে।
আরও একটি বিষয় গর্ভপাতের অধিকার। গর্ভপাত সমস্যা ভোটের নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে, এটা প্রথম থেকেই মনে করা হচ্ছিল। মার্কিন নারীদের গর্ভপাতের অধিকারের ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ 'রো বনাম ওয়েড' মামলা। ২০২২ সালে ৫০ বছর আগেকার ওই মামলার এক রায় বাতিল করে দেয় মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট। মনে করা হচ্ছিল, এর ফলে আমেরিকার লক্ষ লক্ষ নারী গর্ভপাত করানোর অধিকার হারালেন। আর তা নিয়ে মহিলা এবং প্রগতিশীলরা কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে কট্টরপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়তে শুরু করার পর ডেমোক্র্যাটদের দিকে জনসমর্থন বাড়ছে। কিন্তু ভোটের ফলাফল বুঝিয়ে দিল আসল ছবি উলটোটাই। শেষপর্যন্ত এই ইস্যুতেও রিপাবলিকানদেরই বুঝি সমর্থন করছেন মার্কিন নাগরিকরা।
তবে নিঃসন্দেহে এই নির্বাচনে পয়লা নম্বর অর্থনীতিই। এক মার্কিন সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টের বিশ্লেষণ হল, এই বিষয়টিকেই ভোটাররা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। আর সেক্ষেত্রে তাঁরা ট্রাম্পকেই বেছে নিয়েছেন যোগ্যতর হিসেবে। যদিও সাম্প্রতিক সমীক্ষার হিসেবটা অন্য কথা বলছিল। গত সেপ্টেম্বরে টাইমস/ সিয়েনার একটি পোলে দেখা গিয়েছিল ১৩ শতাংশ পয়েন্ট পেয়েছেন ট্রাম্প। কিন্তু গত সপ্তাহেই তা কমে আসে ৬ শতাংশে। ফলে মনে করা হচ্ছিল, এই ইস্যুতে জো বাইডেনের প্রতি হতাশা থাকলেও মার্কিন নাগরিকদের কমলা হ্যারিসের প্রতি আস্থা বাড়ছে। কিন্তু গণনা শুরু হতেই দেখা গেল, সেই হিসেব একেবারেই ভুল। ফের মসনদে ফিরছেন ট্রাম্পই। একাধিক মামলার ফাঁদ থাকলেও শেষপর্যন্ত তিনিই হয়ে উঠবেন মার্কিন মসনদের অধিশ্বর।