ধ্রূবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: শীতের পড়ন্ত বেলা৷ জাঁকিয়ে ঠান্ডা না পড়লেও, কনকনে ভাবটা টের পাওয়া যায়৷ তাতে মধ্যবিত্তের ঘরে এখন হিসাবের কড়ি৷ বিয়ের কার্ড দেখিয়ে যেখানে আড়াই লাখ পাওয়ার কথা, সে জায়গায় বাপ-মেয়ের অ্যাকাউণ্ট মিলিয়ে সাকুল্যে দুই লাখ৷ তাও কি মিলবে না? কুরে খেয়েছে দুশ্চিন্তা৷ শেষপর্যন্ত বিয়েটা বোধহয় বাতিলই হবে৷ বাড়িময় লোক যখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন, ঠিক তক্ষুনি সদর দরজা থেকে হাঁক– ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে!
নিজের কানকে তখনও বিশ্বাস করতে পারছিল না দেগঙ্গার কার্তিকপুরের মজুমদার বাড়ির কনে৷ গলায় ঠেলে আসছে আবেগ৷ দরজাটা খুলতে যাবে, এমন সময় পাশের ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল মা, – ‘মান রাখলে ঠাকুর, ওরে শাঁখ বাজা, উলু দে৷’ সঙ্গে সঙ্গে হাজার সানাইও যেন বেজে উঠল মজুমদার বাড়ির উঠোনে৷ সোমবার, মরশুমের প্রথম দিনেই বিয়ে হচ্ছে মেয়ের৷ কনের বাবা দেবাশিস মজুদার গলায় একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে বলছেন, “দিনের পর দিন ধরনা দিয়েছি ব্যাঙ্কের সামনে৷ শনিবার মেয়ে নিজে গিয়েছিল বিয়ের কার্ড হাতে৷ শেষে এদিন বিকেলে টাকাটা হাতে পেলাম৷ যা চেয়েছিলাম, তা অবশ্য পাইনি৷ তবু যা টাকা পাওয়া গিয়েছে তাতেই হবে৷”
চেয়ে চিন্তে হাতে এসেছে পঁচাশি হাজার৷ খরচে কিছুটা টান দিয়েই মেয়ের বিয়ে সারবেন মজুমদারবাবু৷ শুধু দেগঙ্গার মজুমদার বাড়ি নয়, মরশুমের প্রথম বিয়ের দিনে কম খরচে এভাবেই প্রায় একাধিক কনের পরিবারে বাজল সানাই৷ কমদামি হলেও, ফুটল বিয়ের ফুল৷
ভয়ভয়ে অনেকেই বিয়ের কার্ডটুকু লুকিয়ে রেখেছিলেন৷ বিমানবন্দরের কাছে তেঘরিয়ার বাসিন্দা ঘোষ পরিবারের অবস্থাও এরকমই৷ আশপাশের খবর নিয়ে এদিনই নিমন্ত্রণের কার্ড হাতে বেরিয়েছেন৷ দক্ষিণের যাদবপুরের পুরনো কলোনিপাড়ায় আরও দু’ঘরে বিয়ে লেগেছে৷ এ মরশুমে হলেও বিয়েটা অবশ্য জানুয়ারিতে৷ বিয়ের খরচ তাঁদের জোগাড় হয়ে গিয়েছে ঠিকই৷ কিন্তু চক্ষুলজ্জায় কিছুটা কিন্তু কিন্তু করছিল ভট্টাচার্য বাড়িও৷
আরও একবার ঘটিবাড়ির কনের সঙ্গে বাঙাল পোলার বিয়ে বেধেছে শ্যামবাজারে৷ মেয়ের বাপের বুক থেকে কি যে পাথর নেমে গেল! তাঁদের প্রত্যেকের একটাই বক্তব্য, “টাকা পাওয়া যাবে বলেছিল৷ কিন্ত্ত শেষ পর্যন্ত যে কী হবে, তা তো জানা ছিল না৷”
পাশের বাড়ির মেসোমশাইয়ের কথাটা বেশ মনে ধরেছে ভটচায্যি বাড়ির৷ “মাথা তো গলিয়েই দিয়েছিল সকলে৷ কারও হাতে তো আর কিছু নেই৷ তবে যাই বলো, বড় পরীক্ষায় উতরোনো গেল৷”
নহবতখানাটা না বসাতে পারলেও বিয়েটা হচ্ছেই৷ বাপ-মায়ের সাধের বিয়ে৷ কার্ডে ‘সবান্ধবে’ লেখাটা ছিল তো? উপহার একটু কম আসবে ঠিকই৷ তা হোক, শেষপাতে মিষ্টিমুখটুকু তবু হচ্ছে৷ গাঁটের কড়ি বেশি বেরিয়ে যাওয়ার বদলে এবার নয় একটু আঁটসাঁটই হল৷ ক্ষতি কী?
বামুনে যে ওদিকে মন্ত্র পড়া শুরু করে দিল!
একি, মেয়ের মুখখানা ঝাপসা হয়ে আসছে কেন? ‘চোখটা মুছে নিন মেসোমশাই’– কাঁধে হাত মেয়ের হবু-ননদের৷
মাইকে সানাইয়ের সুর তীব্র হয়৷
অন্যদিকে, আরও এক সুর প্রবল হয়ে ওঠে তবে তা সানাইয়ের নয় গভীর শোকের৷ ধুমধাম করে নাতনির বিয়ে দিতে চান লক্ষ্মী ভট্টাচার্য নামে এক ৯০ বছরের বৃদ্ধা৷ কিন্তু ‘নোট বিপর্যয়’-এ ভেস্তে গেল সমস্ত পরিকল্পনা৷ বৃদ্ধার নাতনি জয়তীর বিয়ে ১৪ ডিসেম্বর৷ পাত্রীর মা দীপ্তি ভট্টাচার্য হুগলি জেলা পরিষদের সদস্য৷ মেয়ের বিয়ের কেনাকাটা করতে না পেরে তিনি হতাশ৷ আরবিআই একটি নির্দেশিকায় জানিয়েছে, বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য পাত্র বা পাত্রীর বাড়ির তরফে আড়াই লক্ষ টাকা তোলা যাবে৷ সেইমতো লক্ষ্মীদেবী আড়াই লক্ষ টাকা তোলার জন্য আবেদন জানান নবগ্রাম বিদ্যাসাগর রোডের পোস্ট অফিসে৷ ডাকঘর কর্তৃপক্ষ প্রথমে জানায়, বিয়ের কার্ড আনতে হবে৷ পরে বলে ৯০ বছরের বৃদ্ধাকে আসতে হবে৷ সেইমতো বৃদ্ধা মাকে নিয়ে যান দীপ্তির স্বামী বিশ্বনাথ৷ বিয়ের কার্ড-সহ আবেদন করা হয়৷ ডাকঘর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, আরবিআইএর নির্দেশিকা না আসায় টাকা দেওয়া যাবেনা৷