বিশ্বদীপ দে: ইংল্যান্ডের ‘বাজবল’ চূর্ণ রোহিত বাহিনীর হাতে। যে সিরিজে বিরাট কোহলি নামের এক কিংবদন্তি খেলেনইনি। তবুও দেশের মাটিতে ইংরেজদের ৪-১ ব্যবধানে গুঁড়িয়ে দেওয়া জয়। এমন সাফল্য ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে এক সোনালি অধ্যায় হয়ে থাকবে তা বলাই বাহুল্য। আর এহেন ইতিহাস ঘাঁটতে বসলে অনেকেরই মনে পড়ে পুরনো সময়ের কথা। শক্তিশালী দলকে বিদেশের মাটিতে হারানো তখন প্রায় ‘অসম্ভব’ স্বপ্ন। বহু দিন পর পর খানিক সাফল্য আসে। দেশের মাটিতে অবশ্য ছবিটা তেমন ছিল না। কিন্তু তবু মানতেই হবে, সামগ্রিক ভাবে ‘টিম ইন্ডিয়া’র যে দাপট তা শুরু হয় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নামের এক বঙ্গতনয়ের নেতৃত্বেই। তাই আজও বিশ্বক্রিকেটে ভারতের প্রতিটা সাফল্য সেই ‘শুরুয়াৎ’কে মনে করিয়ে দেয়। আজকের জয়ে অনেকেরই হয়তো মনে পড়ে যেতে পারে প্রায় বাইশ বছর আগের এক জয়। ২০০২ সালের হেডিংলে টেস্টে ভারত ইংল্যান্ডের মাটিতে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়েছিল ইনিংস ও ৪৬ রানে। পরবর্তী সময়ে অনিল কুম্বলে (Anil Kumble) দাবি করেছেন, সেই ম্যাচ তাঁর কেরিয়ার ও ভারতীয় ক্রিকেট, উভয়েরই এক ‘ডিফাইনিং মোমেন্ট’। কী হয়েছিল সেই ম্যাচে? কেন সেই ম্যাচকে এমন সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন ভারত তথা বিশ্বক্রিকেটের অন্যতম সেরা ম্যাচ উইনার?
মনে রাখতে হবে, এই সফরেই ভারত ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জিতেছিল ৩২৫ রান তাড়া করে। কিন্তু সেই ওয়ান ডে প্রতিযোগিতার পাশাপাশি সাদা পোশাকের ক্রিকেটে শচীন-সৌরভ-রাহুলের ব্যাট ও কুম্বলের বোলিং যে সাফল্য এনেছিল হেডিংলের ওই ম্যাচে (2002 Headingley Test), সেটা স্রেফ কোনও জয় নয়। ভিতরে ভিতরে বদলে দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট দলের স্পিরিটটাই।
[আরও পড়়ুন: ‘নো ভোট টু তৃণমূল’, মোদির মঞ্চ থেকে লড়াইয়ের ডাক অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের]
একথা অনেকেই বলেন, ২০০১ সালের ইডেনে স্টিভ ওয়া বাহিনীর ‘অশ্বমেধ’ যজ্ঞ পণ্ডই টিম সৌরভের প্রথম ‘নকআউট পাঞ্চ’। জয় ভারত তার আগেও বহু পেয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক জয়ও। ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের মতোই ১৯৭১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে ক্যারিবিয়ানদের হারানোর মতো অনবদ্য সাফল্য এসেছে। কিন্তু নতুন সহস্রাব্দে এসে গড়াপেটার কালো ছায়া থেকে ক্রিকেটকে মুক্ত করে টিম ইন্ডিয়াকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার যে কাহিনি, তার এক অধ্যায় যদি ২০০১ ইডেন হয়, অন্যটি নিশ্চয়ই হেডিংলে টেস্ট। এই সময়ের পর থেকেই বিশ্বক্রিকেটে বেজে ওঠে রণদুন্দুভি। জিতব, আর হারলেও শেষ বল পর্যন্ত লড়ব- এই বিশ্বাস ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল ভারত। পরবর্তী সময়ে অসংখ্য সাফল্যের শিখরে আরোহণ সম্ভব হয়েছিল এই ম্যাচে অর্জিত সাহস থেকেই।
একবার ফিরে দেখা যাক সেই ম্যাচ। সিরিজে ভারত তখন ০-১ পিছিয়ে। লর্ডস টেস্টে ১৭০ রানে জয় পেয়েছে ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় টেস্ট ড্র হওয়ার পর তৃতীয় খেলা হেডিংলেতে। ২২ আগস্ট শুরু হওয়া সেই ম্যাচে টসে জিতে ব্যাট নেন সৌরভ। কিছুটা খেলা গড়াতেই ফেরেন শেহওয়াগ। সঞ্জয় বাঙ্গারকে সঙ্গে নিয়ে ইনিংস গড়ায় মন দেন রাহুল। বাঙ্গার অর্ধশতরান করেছিলেন। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটের ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’রা সকলেই শতরান করেন। দ্রাবিড় করেন ১৪৮। সৌরভ (Sourav Ganguly) করে যান ১২৮। আর শচীন করেন ১৯৩। ভেজা পিচে প্রথমে রাহুলের সঙ্গে ১৫০ রান যোগ করেন মাস্টার ব্লাস্টার। পরে সৌরভের সঙ্গে জোড়েন ২৪৯ রান। মাত্র ১৬৭ বলের ইনিংসে সৌরভ আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলে মন জিতে নেন। তিনি আউট হয়ে গেলে রানের গতি বাড়ান শচীনও (Sachin Tendulkar)। কিন্তু শেষপর্যন্ত বিদেশের মাটিতে দ্বিশতরানের সম্ভাবনা জলে যায় ক্যাডিকের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে যাওয়ায়। সব মিলিয়ে ৮ উইকেটে ৬২৮ রান তোলে ভারত।
[আরও পডু়ন: ‘আমার শরীর নিয়ে খেলা করেছে!’, আদিল ফের বিয়ে করতেই গর্জে উঠলেন রাখি]
ইংল্যান্ডের হয়ে মাইকেল ভন ৬১ করেন। আলেক স্টুয়ার্ট করেন অপরাজিত ৭৮। কিন্তু বাকিরা সেভাবে সফল না হওয়ায় মাত্র ২৭৩ রানেই গুটিয়ে যান ব্রিটিশরা। সাড়ে তিনশোরও বেশি রানে পিছিয়ে থাকায় ফলো অন করে তারা। দ্বিতীয় ইনিংসে অধিনায়ক নাসির হোসেন ১৯৪ বলে খুঁটে খুঁটে ১১০ করে যান। কিন্তু ইংল্যান্ড ৩০৯ রানের বেশি করে উঠতে পারেনি। ফলত ভারত ইনিংস ও ৪৬ রানে জয় পায়। অনিল কুম্বলে ছিলেন (৯৩/৩ ও ৬৬/৪) সফলতম বোলার।
কিন্তু এ তো গেল নিছক পরিসংখ্যান। নেভিল কার্ডাস বলেছিলেন স্কোরবোর্ড আসলে গাধা। অর্থাৎ স্রেফ স্কোরবোর্ড দেখে সবটা বোঝা যায় না। এক্ষেত্রেও তাই। চিরকাল যে ধরনের ভিজে পিচে দু-একজনের ব্যক্তিগত নৈপুণ্য বাদে ভারতীয় ব্যাটাররা ‘স্ট্রাগল’ করে গিয়েছেন, তেমনই এক পিচে এত রান তুলে ইংল্যান্ডকে দুবার অলআউট করার মধ্যে যে বার্তা ছিল, তা মোটেই কোনও প্রচ্ছন্ন বার্তা নয়। বরং ন্যাটওয়েস্টের সাফল্যকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে এই জয় যেন এক সিংহবিক্রম। অর্থাৎ ‘শত্রুকে’ তার ঘরে ঢুকে স্রেফ মারা নয়, একেবারে নাস্তানাবুদ করে দেওয়া। সৌরভ-শচীন-রাহুল-কুম্বলে-জাহিরদের সেই সোনালি সাফল্য যে মশাল জ্বালিয়েছিল তা আজও জ্বলছে। অথচ ভারত সিরিজটা জেতেনি। ১-১ ড্র করেছিল।
কিন্তু তবু একথা বলাই যায়, ওই সাফল্যের মধ্যে দিয়ে যে ‘মস্তানি’র সূচনা সেটাই উত্তরোত্তর ঝকঝকে ধারালো হয়ে উঠেছে। কোহলির মতো চ্যাম্পিয়নকে ছাড়াই ব্রিটিশদের ৪-১ ব্যবধানে স্রেফ উড়িয়ে দেওয়া সেই ‘মস্তানির’ই উত্তরাধিকার। হয়তো দীর্ঘদিন আইসিসি ট্রফি নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজকের ক্রিকেটবিশ্বে কখনও কোনও ম্যাচেই ভারতকে হালকা ভাবে নেওয়ার কথা প্রতিপক্ষ ভাবতে পারে না। এই ভাবমূর্তি গড়ে ওঠার সময়কাল হিসেবে হেডিংলে টেস্ট হয়ে রয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সাফল্যে যে জয়কে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে চাইবেন যে কোনও ক্রিকেট রসিকই।