সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: বঙ্গে বিজেপির ভোটঅঙ্ক যেন কেশবচন্দ্র নাগের অঙ্কের প্রশ্ন। চৌবাচ্চায় একদিক থেকে জল ঢুকছে তো অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। চব্বিশের লোকসভায় রাজ্যে বিজেপির অবস্থাও কিছুটা সেরকম। রাজ্যের কিছু প্রান্তে গেরুয়া শিবির ঝড় তুলছে তো অন্য প্রান্তে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে তাদের জয়ের আশা। ফলে লোকসভায় বাংলায় কখনও তাদের টার্গেট হচ্ছে ৩০ তো কখনও আবার কমে দাঁড়াচ্ছে ২৩-২৪। কেউ কেউ বলছে আরও কম। এ রাজ্যে পদ্মে ফোটার পথে সবচেয়ে বড় কাঁটার নাম জঙ্গলমহল। অথচ উনিশে এই লালমাটির দেশই আশীর্বাদের ঝুলি উপুড় করে দিয়েছিল মোদি ব্রিগেডকে। সেই কাঁটা উপড়ে ফেলতেই দক্ষিণবঙ্গের একাধিক আসনকে টার্গেট করছে গেরুয়া শিবির। সেখানে জয় পেতে তাদের হাতিয়ার সেই আদ্যিকালের হাতিয়ার- বিভাজনের রাজনীতি। বারাকপুরের সভা থেকে নরেন্দ্র মোদি যে 'খেলা' শুরু করে দিয়েছেন বলেই দাবি রাজনৈতিক মহলের।
উনিশের লোকসভায় বাংলায় বিজেপির উত্থান ছিল রকেটের গতিতে। লোকসভা আসন ২ থেকে একলাফে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৯। আর এর নেপথ্যে ছিল বাংলার দুই অঞ্চল। উত্তরবঙ্গ এবং জঙ্গলমহল নিজেদের ঝাঁপি উপুড় করে দিয়েছিল বিজেপির কাছে। উত্তরের ৮টি আসনের মধ্যে সাতটি জিতেছিল তারা। জঙ্গলমহলে চারে চার করেছিল তারা। এবার উত্তরেও সামান্য কম-বেশি হতে পারে কিন্তু জঙ্গলমহলের 'চক্রব্যুহ' মোদি-শাহদের কাছে কার্যত 'দুর্ভেদ্য' হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জঙ্গলমহল জয়ের পথে সবচেয়ে বড় কাঁটার নাম কুড়মি আন্দোলন। উনিশে যাদের ভোট ঢেলে পড়েছিল জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো-সুভাষ সরকার-কুনার হেমব্রম-দিলীপ ঘোষদের পক্ষে তাঁরাই এবার এদের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ। 'বঞ্চনা'র অভিযোগ তুলে চার কেন্দ্রেই প্রার্থী দিয়েছে কুড়মি সম্প্রদায়। আর সেটাই বিজেপির ভোট অঙ্ক সম্পূর্ণ ঘেঁটে দিয়েছে বলেই শোনা যাচ্ছে কানাঘুষো। উপরন্তু রয়েছে রাজ্যের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রীর মতো একাধিক প্রকল্প। যা জঙ্গলমহলের পিঁপড়ের ডিম খাওয়া মানুষগুলোর ঘরে গরম ভাতের গন্ধ এনে দিয়েছে। উনিশে হেরেও চার কেন্দ্রেই মাটি কামড়ে পরে থেকেছে তৃণমূল। বার বার এসেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। তাদের সেই 'ইনভেস্টমেন্ট' ভরপুর 'রিটার্ন' দিয়েছে একুশের বিধানসভায়। চব্বিশেও জঙ্গলমহল তৃণমূলকে খালি হাতে ফেরাবে না বলেই প্রত্যয়ী ঘাসফুল শিবির। উলটোদিকে রাঢ়বঙ্গে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ হয়েছে বিজেপি। ক্ষোভ বেড়েছে সাংসদদের বিরুদ্ধে। আর তাতেই জঙ্গলমহলে টলমল করছে বিজেপির গদি।
[আরও পড়ুন: লালদুর্গে ফুটেছে জোড়াফুল, প্রার্থী বদল করে আরামবাগের গেরুয়া ঢেউ রুখতে পারবে তৃণমূল?]
শাল-পিয়ালের জঙ্গলের হাওয়াতেই 'বিরোধিতা'র গন্ধ এসে পৌঁছছে মোদি-শাহের নাকেও। তাঁদের মতো পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদরা সেই গন্ধ চিনতে ভুল করেননি। তাই ঘাটতি পোষাতে দক্ষিণবঙ্গ জয়ে ঝাঁপিয়েছে বিজেপি ব্রিগেড। মতুয়াগড় ছাড়াও তাদের টার্গেট কলকাতা উত্তর, দমদম, বারাসত, হাওড়া সদর, আরামবাগের মতো আসন। সেই পরিকল্পনা মতো প্রচারের কার্পেট বম্বিং শুরু করেছে। উত্তর কলকাতার মতো তৃণমূলের শক্তঘাঁটিতে প্রচারে নামছেন মোদি, শাহ, হিমন্ত, যোগী, স্মৃতি ইরানি, মিঠুনের মতো তাবড় তাবড় নেতারা। হাতিয়ার বিভাজনের রাজনীতি। ইতিমধ্যে বারাকপুরে সভা সেরে গিয়েছেন মোদি। সেখান থেকে মেরুকরণের তাস খেলেছেন তিনি। তাঁর জনসভা থেকে প্রচারের সুর সপ্তমে চড়ান। যার আগাগোড়া হিন্দুত্বের বার্তায় ভরা। ৫ গ্যারান্টিও ছিল হিন্দুত্বের মাখনে ভরা। বলেছিলেন, ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ নয়। তফসিলি জনজাতির সংরক্ষণ হবেই যতদিন মোদি ক্ষমতায় থাকবে, ততদিন এদেশে রামনবমী পালন করতে, রামের পুজোয় কেউ বাধা দিতে পারবে না। রামমন্দিরে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত কেউ বদলাতে পারবে না। CAA কার্যকর করা আটকানো যাবে না। উল্লেখ্য, বারাকপুর লোকসভা এলাকায় প্রচুর অবাঙালির বাস। সেখানে অনেকদিন ধরেই রামনবমী, হনুমান জয়ন্তীর মতো উৎসব উদযাপন হয় মহা সমারোহে। সেই জায়গা দাঁড়িয়ে মোদির রামমন্দির (Ram Mandir) ইস্যুতে সুর চড়ানো এবং স্লোগান যথাযথ।
উদ্দেশ্য একটাই, জঙ্গলমহলের ক্ষতয় প্রলেপ দেওয়া। ভোট-চৌবাচ্চা থেকে ৪ আসন বেরিয়ে গেলেও যেন দক্ষিণ থেকে অন্তত ৫ আসন নিজেদের ঝোলায় আসে। কিন্তু এভাবে কি চৌবাচ্চা থুড়ি বিজেপির ভোটের ঝুলিতে ৩০ আসন ভরা যাবে, সে উত্তর পেতে ৪ জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।