দেব গোস্বামী, বোলপুর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর বোলপুর দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে দু’টি নামই যেন সমার্থক। দূরদূরান্তের পর্যটকদের ডেস্টিনেশন বোলপুর (Bolpur)। রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত এই জায়গা বাঙালির কাছেও বরাবরের প্রিয়। বোলপুরের যাবতীয় খ্যাতি রবীন্দ্রনাথকে ঘিরেই। সেই ১২ বছর বয়সে বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে এই মাটিতে পা দিয়েছিল বালক রবি। তার পর তাঁর হাত ধরেই ক্রমেই এই জায়গা ঐতিহাসিক খ্যাতি অর্জন করে। ধীরে ধীরে বঙ্গের রাজনৈতিক মানচিত্রেও ঢুকে পড়ে লালমাটির বোলপুর। পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা কেন্দ্রগুলির মধ্যে অন্যতম এই কেন্দ্র। পঞ্চায়েত হোক বা বিধানসভা, নির্বাচনী আবহ এখানে বরাবরই তপ্ত। চব্বিশের লোকসভা ভোটেও (2024 Lok Sabha Polls) তার ব্যতিক্রম ঘটছে না। এই কেন্দ্রে বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টর কাজ করছে বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রে। আসুন দেখে নেওয়া যাক, কেমন হতে চলেছে বোলপুরের লড়াই।
জনবিন্যাস
এই নির্বাচনী এলাকার বেশিরভাগই গ্রামীণ। সাক্ষরতার হার প্রায় ৭৩.৭৭ শতাংশ। মহিলা ভোটারের চেয়ে পুরুষ ভোটারের হার বেশি। পুরুষ ৫১ শতাংশ ও মহিলা ৪৯ শতাংশ। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটারের সংখ্যা শতাধিক। তফসিলি জাতি জনসংখ্যা প্রায় ৩৩ শতাংশ। তফসিলি উপজাতি এখানে ৯ শতাংশ।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
১৯৬২ সালে তৈরি হয় বোলপুর লোকসভা কেন্দ্র (Bolpur Lok Sabha Constituency)। এই কেন্দ্রটি বর্তমানে তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত। শুধু শান্তিনিকেতন নয়, ৫১ সতীপীঠের অন্যতম কঙ্কালীতলা ও লাভপুরের মা ফুল্লরা এই কেন্দ্রের অন্যতম আকর্ষণ। এছাড়াও গীতগোবিন্দের রচয়িতা কবি জয়দেব পদ্মাবতীর জয়দেব-কেন্দুলি অন্যতম। সারা বছরই পর্যটকরা ভিড় জমান। বীরভূম জেলার দুটি লোকসভা কেন্দ্র - বীরভূম ও বোলপুরের মধ্যে বোলপুর লোকসভা কেন্দ্র ৪১ তম সংসদীয় ক্ষেত্র হিসেবেই চিহ্নিত। বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের চারটি বিধানসভা কেন্দ্র বীরভূম জেলার, তিনটি পূর্ব বর্ধমান জেলার। তফসিলি জাতির (SC) জন্য সংরক্ষিত।
ইতিহাস
১৯৬৭ সাল থেকে কংগ্রেসের দখলে ছিল বোলপুর লোকসভা কেন্দ্র। বিপুল ভোটে জয় পেয়ে প্রথম সাংসদ হোন এ কে চন্দা। ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৮৫ সিপিএম (CPM) সাংসদ ছিলেন সরদীশ রায়। তাঁর মৃত্যুর পরই ১৯৮৫ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত সিপিএমের জনপ্রিয় সাংসদ ছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। ২০১৪ সাল থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের সংগঠন চাঙ্গা হওয়ায় এই লোকসভা কেন্দ্রটি বর্তমানে তৃণমূলের (TMC) দখলে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের অসিত কুমার মাল ৬,৯৮,৪৪১ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। রানার আপ হয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের (Vishva Bharati) অধ্যাপক রামপ্রসাদ দাস। জয়ের ব্যবধান ছিল ১,০৬,৯৯৬ ভোট। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী অনুপম হাজরা ৬,৩০,০৮৫ ভোট পেয়ে জয়ী হন। রানার আপ হয়েছেন সিপিএম প্রার্থী রামচন্দ্র ডোম। জয়ের ব্যবধান ছিল ২,৩৫,৮৩৯ টি ভোট।
[আরও পড়ুন: ‘সিরিয়াল ছেড়েছি তৃণমূলের জন্য’, ভোটের মুখে বড় কথা লাভলির!]
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি
কৃষি নির্ভর লোকসভা কেন্দ্র চাষাবাদ, একাধিক পর্যটনকেন্দ্র, হোটেল রিসর্ট ব্যবসা, হস্তশিল্পীদের থেকেই মূল আয়। রবীন্দ্রনাথ, তারাশংকর, বৈষ্ণব কবি জয়দেব-পদ্মাবতী, রামী চণ্ডীদাসের স্মৃতিকে আঁকড়েই গবেষণা করছেন চর্চা করছেন একাংশ পড়ুয়া। তবে বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল (Anubrata Mondal) বর্তমানে গরু পাচার মামলায় দীর্ঘদিন তিহার জেলবন্দি। তবে এবার লোকসভা নির্বাচনে 'চড়াম চড়াম', 'নকুল দানা-গুড় বাতাসা', 'রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে উন্নয়ন'-এর মত শব্দবন্ধ আর প্রয়োগ করা যাবে না। বীরভূমে অনুব্রত মডেলেই ভোট, সশরীরে না থাকলেও 'কেষ্ট আদর্শ'ই সম্বল তৃণমূলের। তবে অনুব্রতর ভোকাল টনিক না পেয়ে রীতিমত চনমনে থাকতেন দলের নেতা-কর্মীরা। বিজেপি, তৃণমূল প্রার্থী ঘোষণা করেছে ইতিমধ্যেই। কংগ্রেস ও বাম জোট জটে এখনও প্রার্থী ঘোষণা করতে পারেনি।
অনুব্রত মণ্ডল। ফাইল ছবি।
বিধানসভা কেন্দ্র
এই লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে রয়েছে সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র। বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রটি বীরভূম এবং পূর্ব বর্ধমান দুই জেলাতেই ছড়িয়ে রয়েছে। অধীনস্ত বিধানসভা কেন্দ্রগুলি হল বোলপুর, নানুর, লাভপুর, ময়ূরেশ্বর, কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট এবং আউসগ্রাম। এর মধ্যে বোলপুর, নানুর, লাভপুর, ময়ূরেশ্বর কেন্দ্রগুলি বীরভূম জেলায় অবস্থিত। কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট এবং আউসগ্রাম- এই তিনটি বিধানসভা পূর্ব বর্ধমানে অবস্থিত।
গত এক দশকে রাজনৈতিক চিত্র
লোকসভা ভোটের দামামা বাজলেই এখানকার মানুষ স্মরণ করেন প্রয়াত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে। চায়ের দোকানে, স্টেশন চত্বরে প্রবীণদের আড্ডায় তিনি আজও প্রাসঙ্গিক। ভোটাররা অনেকেই মনে করেন, তাঁর মতো বিচক্ষণ সাংসদ আর হয়তো পাওয়া যাবে না। সেখানে বিদায়ী সাংসদ তথা অনুব্রত ঘনিষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত অসিত কুমার মাল এবারেও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী। দল এবারেও অসিতের উপরেই ভরসা করেছে। অনুব্রতহীন বীরভূমে এবারের ভোটচিত্র ২০১৯-এর তুলনায় কিছুটা হলেও আলাদা।
বোলপুরের বিদায়ী সাংসদ তথা তৃণমূল প্রার্থী অসিত মাল। নিজস্ব ছবি।
২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের ফল
সিপিএমের প্রাপ্ত ভোট ৬.২৯ শতাংশ
একসময়ের বাম দুর্গ এখন ২০১১ পালা বদলের পর ২০১৪ সাল থেকেই উত্থান হয় শাসকদল তৃণমূলের। প্রায় ১০ বছর ধরে বিরোধী শক্তি আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। একের পর এক নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে বিরোধীদল গুলির। গত কয়েক বছরে বিজেপি জনসমর্থন বাড়ালেও ভোট বাক্সে তেমন কোনও প্রভাব পড়েনি। 'কেষ্ট গড়’ নামে পরিচিত বোলপুরের হাওয়া এখন অনেকটা বদলেছে বলে মত বিজেপির। অনুব্রতর জেলযাত্রার সঙ্গেই এখানে জোড়াফুলের দাপট কমেছে বলে দাবি অনেকের। তবে তৃণমূলের বিশ্বাস, এবারও বোলপুরের প্রার্থী জয়ী হবেন। অন্যদিকে, কেষ্টর অনুপস্থিতিতে এই আসন থেকে বিজেপি প্রার্থী গৃহবধু পিয়া সাহার পারফরম্যান্স দেখার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন সকলে। তবে বোলপুর আসনের প্রার্থী হিসেবে পিয়ার নাম ঘোষণার পর থেকেই তাঁকে নিয়ে চর্চা শুরু হয়। নাম না করেই তাঁকে ‘দুর্বল’ তকমা দিয়েছিলেন বিজেপিরই নেতা অনুপম হাজরা-সহ অনুগামীরা। দুর্বল প্রার্থী দেওয়ার পিছনে তৃণমূল-বিজেপির আঁতাত থাকতে পারে বলেও দাবি করেছিলেন তিনি। দু'বছরের অধিক সময় ধরে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই ও ইডি নিজেদের কাজের গতি বাড়াতেই জোড়াফুলের দাপট কিছুটা কমেছে বলে দাবি অনেকের।
বোলপুরের বিজেপি প্রার্থী পিয়া সাহা। ছবি: সুশান্ত পাল।
সাম্প্রতিক হালহকিকত
লোকসভা ভোটে জয়লাভের পর সংসদে প্রবেশের পর থেকেই ধারাবাহিকভাবে এলাকার পরিকাঠামো উন্নয়ন, বোলপুরে উন্নত রাস্তা, সেচ সুবিধা এবং স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সাংসদ। উপরন্তু, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের উপর জোর দিয়েছেন। বোলপুরের প্রান্তিকে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়কে দশম শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণিতে উন্নত ও নতুন বিদ্যালয় কক্ষ, বিড়ি শ্রমিকদের সমস্যা, শান্তিনিকেতন দূরদর্শন কেন্দ্র পুনরুদ্ধার-সহ একাধিক বিষয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন লোকসভার প্রশ্নোত্তর পর্বে। যদিও একাংশের দাবি, "পাঁচ বছরে আন্তর্জাতিক শহর বোলপুরকে কেন্দ্র করে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য কাজ দেখা যায়নি। লোকসভায় সাংসদের জ্বালাময় বক্তৃতা অথবা বোলপুর কেন্দ্রের জন্য তেমন কিছু উন্নয়ন চোখে পড়েনি।"
[আরও পড়ুন: রাজের জন্য মাছ বাজারে দরদাম মিঠুন চক্রবর্তীর, ভাইরাল ‘মহাগুরু’র কীর্তি]
বিজেপি প্রার্থী পিয়া সাহা সাঁইথিয়া মহাবিদ্যালয় থেকে সংস্কৃততে স্নাতক হওয়ার পর থেকেই রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ ছিল। ২০১৫ সালে সাঁইথিয়ার ৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে বিজেপির পুর-প্রতিনিধি হন তিনি। এর পর ২০১৬ এবং ২০২১ সালে সাঁইথিয়া বিধানসভা থেকে ভোটে দাঁড়িয়ে ছিলেন পিয়া। যদিও কোনওবারই জয়লাভ করতে পারেননি। তবু আত্মবিশ্বাসে ভর করে লড়াকু মহিলার নেত্রীকেই এবারও প্রার্থী করেছে দল। তাই গৃহবধূর লড়াইয়ে প্রস্তুত বিজেপির কর্মী-সমর্থকরা। তবে মূলত ভোটযুদ্ধ হবে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যেই। এখনও বাম অথবা কংগ্রেস জোট জটে এখনও ঘোষণা করতে পারেনি প্রার্থী তালিকা। তবুও ইভিএম ভোট বাড়াতে তৎপর বাম সংগঠন সিপিএম। বুথ কমিটি, পাড়ায় বৈঠক কোনও কিছুরই খামতি নেই।
বোলপুরের লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী
সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস ইতিমধ্যে প্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছে। প্রার্থী হয়েছেন গতবারের বিদায়ী সাংসদ অসিত কুমার মাল। বিজেপি প্রার্থী করেছে গৃহবধূ পিয়া সাহাকে। তবে প্রার্থী ঘোষণা করলেও দলীয় অন্দরের অন্তর্দ্বন্দ্বে জেরবার বিজেপি। তবে কি এবার নির্দল হয়েই ভোটে লড়ার ভাবনা বিজেপির 'বিদ্রোহী' নেতা তথা বোলপুরের প্রাক্তন সাংসদ অনুপম হাজরার? দল টিকিট না দিলেও বোলপুর লোকসভা থেকেই লড়ব,নাম না করে বিজেপি নেতৃত্বকে আক্রমণ করে পদ-হারা অনুপম হাজরা কি স্ট্র্যাটিজি নেন সেই দিকেই তাকিয়ে অনুগামীরা। বাম ও কংগ্রেস আসন সমঝোতার কারণে এখনও প্রার্থী ঘোষণা করেনি। তবে বাম শিবিরের সিপিএমের একাধিক নাম ঘোরাফেরা করছে। প্রার্থী হতে পারেন সিপিএমের বর্ষীয়ান নেতা রামচন্দ্র ডোম। যদিও তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ। সেক্ষেত্রে প্রার্থী হতে পারেন নানুরের প্রাক্তন বিধায়ক শ্যামলী প্রধান।
সম্ভাবনা
কেষ্টর ‘টনিক’ নেই! ফলে এবার তৃণমূলের লড়াই একটু 'টাফ'। তবে ভোট পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন পাঁচজনের কোর কমিটি সদস্যরা। কেষ্ট বিনে এবারের লোকসভা ভোটের লড়াই যে কঠিন, তা মানছেন দলের প্রার্থী থেকে কর্মীরা। ২০১৯ সালের তুলনায় এবার বেশি ভোট ব্যবধান অন্তত দু লক্ষের অঙ্ক কষেছেন শাসকদল। তবে বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা। তৃণমূল, বাম-কংগ্রেস জোট ও বিজেপি। ভোট কাটাকাটির খেলায় বাজিমাত কে করবে? তবে নানুর, লাভপুর, কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোটে ভালো লড়াই দেবে তৃণমূল।