এবারের ভোট ৪৭ দিন ব্যাপী। পশ্চিমবঙ্গে তা সাত দফায়। কমিশনের নির্দেশমতো ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগের ৪৮ ঘণ্টা ‘সাইলেন্স পিরিয়ড’। ওই সময় কোনওরকম প্রচার নিষেধ। জনগণকে ওই সময়টুকু বরাদ্দ করা হয়– কে কোন দল, কোন প্রার্থীকে ভোট দেবে তা নির্ধারণ করার জন্য। সেই সময়, সেই নীরবতা মানুষ পাবে কি? লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভোটের দফা নিয়ে বিস্তর কথা চলছে। কারও মতে, দফায় দফায় ভোট হলে সবাই নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে। মানুষের মনের ভয় দূর হয়। কেউ-বা মনে করছেন, এটা করা শাসক দলের সুবিধার জন্য। যাদের টাকার থলির কোনও তল নেই, পোয়াবারো শুধু তাদের। এই বিতর্কে ঢুকে কোনও লাভ নেই যেহেতু শাসক ও বিরোধী– কেউই কারও যুক্তি মানতে প্রস্তুত নয়।
দেশে একটা সময় এক দফাতেই ভোট হয়েছে। ধীরে ধীরে দফা বেড়েছে। এখন তো সুর সপ্তমে! এতে ভোট চুরি ঠেকানো গিয়েছে কি না, গণতন্ত্রের লাভ হয়েছে কি না, সে-কথাও ভিন্ন। আমি অন্য কথা ভাবছি। সেই ভাবনা নির্বাচন কমিশন (ইসিআই) কোনও দিন ভাববে কি না জানি না। সিবিআই-ইডির মতো তারাও আজ ‘খাঁচার তোতা’।
এবারের রাজসূয় যজ্ঞ ৪৭ দিনের। উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে সাত দফায়। অন্যত্র কোথাও পঁাচ, কোথাও চার, কোথাও তিন, কোথাও দুই, কোথাও বা এক দফায়। এবার জম্মু-কাশ্মীরে খুব ইন্টারেস্টিং ভোট হতে চলেছে। নতুন এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের পঁাচ আসনে (একটি আসন লাদাখে) ভোট হবে পঁাচ দফায়। ইসিআই ২০টিরও বেশি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভোট করছে একদিনে। তার মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাট, কেরল, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু ও তেলেঙ্গানার মতো বড় রাজ্য রয়েছে। ইসিআই মনে করে, ওসব রাজ্য নিরুপদ্রব। তাই একদিনেই ভোট। ওই যুক্তিতে জম্মু-কাশ্মীর সবচেয়ে বিপজ্জনক। না হলে এক-একটা কেন্দ্রের ভোট এক-একদিনে কেন? কেন্দ্রীয় সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে ভূস্বর্গকে যতই ‘স্বর্গরাজ্য’-র তকমা দিক, ইসিআইয়ের লজিকে তা কিন্তু ‘সবচেয়ে ভয়ংকর এলাকা’।
[আরও পড়ুন: গার্ডেনরিচ কাণ্ডে গ্রেপ্তার আরও ১, এবার পুলিশের জালে জমির মালিক]
অন্য একটি বিষয়ও এই প্রসঙ্গে এসে যাচ্ছে। যে-সরকার আদাজল খেয়ে নেমেছে ‘এক দেশ, এক ভোট’ নীতি চালু করতে, লোকসভার সঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, অরুণাচল প্রদেশ ও সিকিম বিধানসভায় ভোট করাচ্ছে, তারা অনায়াসে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভার ভোটও করিয়ে ফেলতে পারত। কিন্তু কেন তা করাচ্ছে না? কেনই বা শুধু লোকসভার ভোট? কোন যুক্তিতে? উত্তরটা আপনাদের খুঁজতে হবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘অব কি বার চারশো পার’ স্লোগানের মধ্যে। বুঝে নিন যা বোঝার।
এটা অবশ্য আমার মূল ভাবনা নয়। মূল ভাবনা আদর্শ নির্বাচনবিধি ঘিরে।
কমিশনের নির্দেশমতো ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগের ৪৮ ঘণ্টা ‘সাইলেন্স পিরিয়ড’। ওই সময়ে কোনওরকমের প্রচার চলবে না। মানুষকে ভাবার জন্য ওই সময়টুকু বরাদ্দ করা হয়। কে কোন দলকে ভোট দেবে, কোন প্রার্থীকে বেছে নেবে, ওই সময়টা দেওয়া হয় তা ঠিক করতে। সেই সময়টুকু, সেই কাঙ্ক্ষিত নীরবতাটুকু দেশবাসী আদতে পাচ্ছে কি?
প্রচারের ক্যাকোফোনি সত্যিই কি বন্ধ করা যাচ্ছে? প্রশ্নটা সেখানেই। প্রশ্নটা আরও বেশি বেশি জাগছে দফায় দফায় ভোট গ্রহণের কারণে। এবার ১৯ এপ্রিল ভোট কোচবিহার, জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারে। তার মানে ওই এলাকায় ‘সাইলেন্স পিরিয়ড’ ১৭ তারিখ থেকে শুরু। সেদিন থেকে ওসব জায়গায় প্রচার না চললেও পাশের জেলা দার্জিলিং, বালুরঘাট ও রায়গঞ্জে বাধা নেই। অন্য এলাকার প্রচারের ঢেউ সাইলেন্ট এলাকায় না ঢোকার উপায়ের খোঁজ কিন্তু কমিশন করেনি। ফলে ‘সাইলেন্স পিরিয়ড’ বাধাহীনভাবে খানখান হয়। কারও কিছু বলার নেই। কেননা, যুক্তি হল, ওখানে তো প্রচার হচ্ছে না। হচ্ছে অন্যত্র, যেখানে ভোট পরে।
এই নিয়মের ফলে মানুষ কি নীরবে ভাবার সময় সত্যিই পায়? এই প্রযুক্তি-নির্ভর যুগে ‘সাইলেন্ট জোন’-এ প্রচারের অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে কি?
সহজ উত্তর ‘না’।
ওই এলাকায় টিভি, রেডিও সম্প্রচার বন্ধ হচ্ছে না। সামাজিক মাধ্যমকে ঠেকানো যাচ্ছে না। খবরের কাগজের বিলি-বণ্টন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ফলে রায়গঞ্জ কি রায়পুর কিংবা রায়লসীমায় দেওয়া নেতাদের ভাষণ কোচবিহার, বালুরঘাট-সহ সারা দেশেই গাঁক গাঁক করে প্রচারিত হচ্ছে। মোট কথা, আচরণবিধিতে ‘সাইলেন্স পিরিয়ড’ রাখা হলেও মানুষকে নীরবে প্রচারের আলো থেকে বাইরে রাখার কোনও উপায়ের খোঁজ কখনও করা হয়নি। পুরনো দিনের জ্ঞানী মানুষজন যখন এই ‘নিষেধাজ্ঞা’ জারি করেছিলেন, তখন দফায় দফায় ভোটের চলন ছিল না। ‘সাইলেন্স পিরিয়ড’ তখন ছিল অকৃত্রিম। মানুষ সত্যি সত্যিই ভাবার সময় ও ফুরসত পেত। এখন তা হাস্যকর হয়ে উঠেছে। যত বেশি দফা, নীরবতার তত দফা রফা। এ নিয়ে কোনও ভাবনা কমিশনের মনে আদৌ উঁকি মেরেছে বলে মনে হয় না।
যদিও ভাবনা সত্ত্বেও তারা এখনও পর্যন্ত খোলামকুচির মতো টাকা ওড়া বন্ধ করতে পারেনি। বরং নিয়ম করে মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধি হিসাব কষে কেন্দ্রপিছু প্রার্থীদের খরচের সীমা বাড়ানো হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গের মতো বড় রাজ্যের লোকসভা কেন্দ্রওয়াড়ি গতবার প্রার্থীপিছু খরচ ধার্য ছিল ৭০ লাখ টাকা, ছোট রাজ্যের জন্য ৫৪ লাখ। এবার বড় রাজ্যে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯৫ লাখ, ছোট রাজ্যে ৭৫। বিধানসভা কেন্দ্রের জন্য সেই হিসাব ছিল ২৮ ও ২০ লাখ। তা বেড়ে হয়েছে যথাক্রমে ৪০ ও ২৮ লাখ। খাতায়-কলমে হিসাব যা-ই থাকুক, লোকসভা কেন্দ্রে বড় দলের প্রার্থীরা এক কোটির বেশি খরচ করে না দাবি করলে ঢাকাই কুট্টির ভাষায় বলতে হবে তা শুনে ঘোড়াও হাসবে। ‘কালো টাকা’-র রমরমা কমাতে নির্বাচনী বন্ড চালুর দাবি যতটা অবিশ্বাস্য ও হাস্যকর, ততটাই অবাস্তব নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া খরচের এই গণ্ডি। সত্যি এই যে, নিয়ম ও আচরণবিধি মানতে বাধ্য করার ইচ্ছে বা তাগিদ আজ বহুকাল গায়েব।
[আরও পড়ুন: একা বিজেপিই ৭,০০০ কোটি! সব বিরোধী মিলিয়ে ৬২০০ কোটি, প্রকাশ্যে নির্বাচনী বন্ডের আয়]
অবশ্য অতশত ভেবে কোনও লাভ নেই। ভোট হতে চলেছে তার নিজস্ব গতিতে। প্রচারের অন্তহীন ঢেউয়ে চেপে ‘মোদি কি গ্যারান্টি’-র যে লহর ক্রমাগত আছড়ে পড়ছে, হ্যাটট্রিকের আগাম ঘোষণা জারি হয়েছে, ‘চারশো পার’ এর ভেঁপু বাজছে, তাতে কারও চোখে অন্য কোনও স্বপ্নের ঝিলিক খেলছে বলে মনে হচ্ছে
না। এই অবস্থায় বরং ‘কনফুসিয়াস পরামর্শ’ শিরোধার্য করে অবধারিত ও অনিবার্যর অপেক্ষা করা যাক।
আগামী পাঁচ বছরে ‘বিকশিত ভারত’-এর সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দ দু’টির বিলোপ দেখতে প্রস্তুত থাকুন। তৈরি থাকুন অযোধ্যার মতো কাশী ও মথুরার শৃঙ্খলমোচনে। আইন তো তৈরিই হয় আইন পাল্টানোর জন্য। নতুন আইন বদলে দেবে ১৯৯১ সালে তৈরি ধর্মস্থান আইন। ‘এক দেশ, এক ভোট’ ও অভিন্ন দেওয়ানি বিধির সম্ভাব্য অভিঘাত এখন থেকেই ভেবে রাখুন। ‘সিএএ’ কার্যকর হওয়ার পর ‘এনআরসি’ ও ‘জননিয়ন্ত্রণ আইন’ কীভাবে আপনাকে বেঁধে ফেলবে সেই ভাবনায় ডুব দিন। গুটিকয় রাজ্যে গোমাংস এখনও লভ্য। সারা দেশেই তা বন্ধ হওয়া সময়ের অপেক্ষা। আশ্চর্য হবেন না– যদি রাজ্যে রাজ্যের হিমন্ত বিশ্বশর্মারা কেউ ৬০০, কেউ ৮০০, কেউ বা ১০০০ মাদ্রাসা বন্ধের কৃতিত্ব ঘোষণা করেন!
‘ব্রিটিশ মডেল’ না কি ‘যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি-প্রধান গণতন্ত্র’, ভারতের পক্ষে কোনটা উপযুক্ত সেই বিতর্কে না ঢুকে বরং আমেরিকার ‘পিউ রিসার্চ’-এর সর্বশেষ সমীক্ষায় চোখ মেলুন। তারা বলেছে, ভারতের ৬৭ শতাংশ মানুষ এখন একনায়কতান্ত্রিক শাসন পছন্দ করছে। ৭২ শতাংশ চায় সেনাবাহিনী দেশ শাসন করুক। মজার বিষয়, সমীক্ষা দেখিয়েছে, যাদের আয় যৎসামান্য, একনায়কতন্ত্রের পক্ষে তারা-ই বেশি ঝুঁকছে। এই আবহে স্মরণে আসছেন কাজী নজরুল, ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়…./ ….বজ্রশিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ংকর/ ওরে ওই হাসছে ভয়ংকর/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর!’