ব্রতদীপ ভট্টাচার্য, বারাকপুর: তাঁর বয়সি অন্য মহিলারা কেউ ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে সংসার সামলাতে ব্যস্ত। তো কেউ চাকরি জীবন থেকে অবসরের দিন গুনছেন। কিন্তু ৫২ বছরের প্রতিমা চক্রবর্তী (Pratima Chakraborty) পরীক্ষা দিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর এখন কলেজে ভরতি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ঘটনাটি শুনতে হয়তো গল্পকথা! কিন্তু একেবারে বাস্তব। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার জন্য গত দু’বছর পুরোদস্তুর স্কুলছাত্রীর জীবন কাটিয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার রহড়া রামকৃষ্ণপল্লির বাসিন্দা প্রতিমাদেবী। সংসারের যাবতীয় কাজ সেরে সকাল দশটা বাজতেই ইউনিফর্ম পরা স্কুলে ছুটেছেন প্রৌঢ়া। নাতনির বয়সি মেয়েদের সঙ্গে রোজ ক্লাস করেছেন। বাড়ি ফিরে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত পড়শোনা করেছেন। সুফল পেয়েছেন, বলাই বাহুল্য! উচ্চমাধ্যমিক (H.S) পরীক্ষায় ২৫৯ নম্বর নিয়ে পাশ করেছেন। ৫২ বছরের গৃহবধূর প্রবল ইচ্ছাশক্তি দেখে অবাক প্রতিবেশীদের প্রত্যেকে।
[আরও পড়ুন: সংক্রমণের আশঙ্কায় বাধা স্থানীয়দের, পুলিশের সাহায্যে বাড়িতে ঢুকলেন ‘করোনা যোদ্ধা’ বিডিও ]
দুই ছেলেই উচ্চশিক্ষিত। একজন অ্যাডভোকেট। অন্যজন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। স্বামীও একটি বড় বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। একসময়ে মাধ্যমিকে পরীক্ষা দিতে না দিতেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল প্রতিমাদেবীর। বিয়ের পর মাধ্যমিকের ফল বেরোলে দেখা যায় অকৃতকার্য হয়েছেন তিনি। সেই থেকে লেখাপড়ায় ইতি। কিন্তু, কলেজে না যেতে পারার আক্ষেপ চিরকালই যন্ত্রণা দিয়েছে প্রতিমাদেবীকে। তিনি বলছেন, “ছেলেরা যখন স্কুলে যেত, তখন মন খারপ হত বড়। ওদের বলতাম, ইশ! আমিও যদি তোদের মতো লেখাপড়া করতে পারতাম। সেসময় বড় ছেলে আমাকে বলেছিল, “মা! ভেবো না। আমি বড় হয়ে তোমায় পড়াব।”
তাঁর দেওয়া সেই কথা রেখেছেন প্রতিমাদেবীর বড় ছেলে অয়ন গঙ্গোপাধ্যায়। আইন পাস করে ওকালতি শুরু করার পর মায়ের সেই স্বপ্নপূরণ করতে নেমেছেন পুরোদমে। ২০১৭ সালে একটি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে মাকে মাধ্যমিকের কোর্সে ভরতি করিয়েছেন। মা মাধ্যমিক পাশ করার পর উচ্চমাধ্যমিকের জন্য স্কুলেও ভরতি করিয়েছেন। রবীন্দ্র মুক্ত বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক দেওয়া নির্বিঘ্নে হলেও সমস্যা হয় একাদশ শ্রেণিতে ভরতি স্কুল পেতে গিয়ে। ৫২ বছরের মহিলাকে রেগুলার ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে স্কুলে ভরতি করার কথা শুনে চমকে যায় স্কুলের কর্তৃপক্ষ। প্রবল বাধার মুখে পড়তে হয় সর্বত্র।
অয়নবাবুর কথায়, “বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে মাকে স্কুলে ভরতি করাতে গিয়ে। প্রথমে কোনও স্কুল ভরতি নিতে রাজি হয়নি। তারা জানিয়ে দেয় এটা নিয়ম বহির্ভূত।” কিন্তু হাল ছাড়েননি অয়নবাবু। তিনিও আইনের ছাত্র। পেশাদার আইনজীবী। তিনি বলেন, “স্কুল কর্তৃপক্ষের মুখে ‘নিয়ম বহির্ভূত’ শব্দটা শুনে আইনের বই ঘাঁটতে শুরু করি। এ ধরনের ভরতির ক্ষেত্রে কী আইন আছে, তা খতিয়ে দেখি। শেষপর্যন্ত রহড়া আইডিয়াল আকাডেমি ফর গার্লসের সঙ্গে যোগাযোগ করি। স্বীকার করতেই হবে, যোগাযোগ করার পর সেখানকার প্রধান শিক্ষিকা পূর্ণিমা চৌধুরি প্রচুর সাহায্য করেছেন। তাঁর জন্য আজ মায়ের এই স্বপ্নপূরণ হয়েছে।”
[আরও পড়ুন: ‘বিষক্রিয়ায় মৃত্যু’, চোপড়ার বিজেপি নেতার বোনকে ধর্ষণের তত্ত্ব ওড়াল ময়নাতদন্তের রিপোর্ট]
উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলেও প্রাপ্ত নম্বর নিয়ে সন্তুষ্ট নন প্রতিমাদেবী। তিনি জানান, পরিবেশবিদ্যা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রত্যাশার থেকে কম নম্বর এসেছে। তাই এই দু’টি বিষয় রিভিউ করতে দিচ্ছেন তিনি। পাশাপাশি কলেজে ভরতি হওয়ার তোড়জোড়ও শুরু করেছেন। প্রতিমাদেবীর জ্ঞানার্জনের অদম্য দৌড় অবশ্য এখানেই শেষ হচ্ছে না। কলেজে ভরতি হয়ে স্নাতক পাশ তো করতেই হবে! তারপর ইতিহাস অথবা এডুকেশন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও করায়ত্ত করতে চান তিনি। পঞ্চাশ পেরনো মহিলার এই যুদ্ধকে কুর্নিশ জানাচ্ছেন সবাই।
The post ২ বছর টানা স্কুলে পড়ার পর উচ্চমাধ্যমিকে বাজিমাত ৫২ বছরের প্রৌঢ়ার appeared first on Sangbad Pratidin.