বিশ্বদীপ দে: ইতিহাসের শরীরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (World War II) এমন এক কালশিটের দাগ, যা আজও মিলিয়ে যায়নি। সেই গাঢ় ক্ষতস্থান থেকে এখনও পুঁজরক্তের সংকেত ত্রস্ত করে রেখেছে সভ্যতাকে। কিন্তু কেবলই কি ঘৃণা ও কদর্যতার আবাদ? না, তা নয়। বরং ঘৃণার কালো পাঁকের গভীরে জন্ম নিয়েছিল প্রেমও। এই লেখায় আমরা ফিরে দেখব এক নাৎসি (Nazi) অফিসার ও ইহুদি (Jewish) তরুণীর প্রেমকাহিনি, যা আজও কিংবদন্তি হয়ে আছে।
ইতিহাসের আড়ালে হয়তো এমন কাহিনি আরও লুকিয়ে আছে। সবটা দশকের পর দশক পেরিয়ে টিকে থাকেনি। কিন্তু ক্যাপ্টেন উইলি সুলৎজ ও তাঁর তরুণী প্রেমিকার প্রণয়কাহিনি হয়ে রয়েছে সেই সময়ের এমন এক প্রতিনিধি, যা প্রমাণ করে যুদ্ধ ও মৃত্যুর আবহেও মানুষ ভালবাসতে পারে। আর পারে বলেই বিশ্বযুদ্ধের মতো সর্বগ্রাসী সর্বনাশও সভ্যতার ভিতকে টলাতে পারে না।
এই কাহিনির পটভূমি এক ‘নরক’। সোভিয়েত (Soviet) শহর মিন্সক যা আজ বেলারুশের রাজধানী। ১৯৪১ সালের জুলাই মাস থেকে ১৯৪৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তা ছিল জার্মানির দখলে। এই সময়কালে ওই শহরের ঘেটো বা এক ধরনের বস্তি এলাকার ইহুদি শিবিরে প্রায় ১ লক্ষ নিরীহ ইহুদিকে হত্যা করেছিল হিটলারের ‘বীরপুঙ্গব’রা। সেই নরক থেকে কোনও মতে প্রাণে বেঁচে ফেরা এক ইহুদি মিখাইল ট্রেস্টারের বর্ণনায়, ‘‘আমাদের কেবল সম্মানহানিই হয়নি। বলা যায় আমরা যে শেষপর্যন্ত একজন মানুষ, সেটুকুও মনে করা হত না। অকথ্য খিদে, তীব্র শীতের মধ্যেই চলত অত্যাচার।’’ আলুর খোসা থেকে তৈরি বিস্বাদ এক ধরনের রুটি দেওয়া হত খাদ্য হিসেবে। আর কোনও বেগড়বাঁই দেখলেই সহজ শাস্তি মৃত্যু!
[আরও পড়ুন: কবে মুক্তি মিলবে করোনা অতিমারীর হাত থেকে, জানালেন WHO প্রধান]
এমনই এক অঞ্চলে নাৎসি অফিসার ক্যাপ্টেন উইলি সুলৎজের চোখ আটকে গেল এক সদ্য তরুণীর সরল, অসহায় দৃষ্টিতে। আগের দিনই ৫ হাজার ইহুদি শ্রমিককে অবলীলায় খুন করেছে নাৎসিরা। সেদিনই সুলৎজ প্রথম পা রেখেছেন ওই এলাকায়। এর আগে তিনি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে সোভিয়েতদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু আহত হওয়ার পর তাঁকে সরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে এই মৃত্যুশিবিরের দেখভালের দায়িত্বে। রক্তস্নাত পথের ধারে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো একদল হতভাগ্য নারী-পুরুষের মধ্যে থেকে সুলৎজ বেছে নিচ্ছিলেন নতুন শ্রমিকদের। আর সেই সময়ই তাঁর চোখ পড়ে গেল ইলসে স্টেইনের দিকে। দেখলেন মৃত্যুর আবহেও তরুণীর ঠোঁটে লেগে আছে হাসির ছোঁয়া। দু’চোখে জীবনের প্রতি বিস্ময়ঘন কাজল। ব্যাস। সব কিছু বদলে যেতে লাগল ক্যাপ্টেনের মনের ভিতরে। এমনিতে মানুষটা ডাকাবুকো যোদ্ধা। আদৌ ফ্যাসিজম-বিরোধী বা ওই রকম কোনও মানসিকতা ছিল না। তবে মনে মনে ইহুদিদের কাপুরুষের মতো নৃশংস ভাবে হত্যা করাটা তিনি পছন্দ করতেন না। কিন্তু তা বলে ইহুদি তরুণীর প্রেমে পড়ে যাওয়া? হয়তো সুলৎজ নিজেও ভাবতে পারেননি।
ভেবেচিন্তে কি মানুষ প্রেমে পড়ে? যে শহরে প্রতি রাতে শয়ে শয়ে অসহায় নরনারীর কান্নার শব্দ পাক খায় বাতাসে, মাঝে মাঝে তুষারপাতের মধ্যেই রুক্ষ চেহারার সেনাদের ট্রাক সারি বেঁধে চলে যায় থমথমে রাস্তা দিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে ভালবাসার কথা কেই বা ভাবতে পারে? সুলৎজ পেরেছিলেন। আর সেটা সম্ভবত প্রথম দর্শনেই। তাই রাতারাতি স্টেইনকে করে দিলেন ইহুদিদের সেই গ্রুপটির লিডার।
[আরও পড়ুন: আফগানিস্তানে রাষ্ট্রসংঘের দপ্তরে তালিবানের হামলা, নিহত এক পুলিশকর্মী]
আর স্টেইন? চোখের সামনে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর কালো পরদা নেমে আসতে দেখত যে সদ্য যৌবনে পা রাখা মেয়েটি? ১৯৯৪ সালে তৈরি ‘দ্য জিউস অ্যান্ড দ্য ক্যাপ্টেন’ তথ্যচিত্রে বৃদ্ধা স্টেইন জানিয়েছিলেন, ‘‘রাস্তার সর্বত্র রক্তে ভিজে থাকত। সে এক ভয়ংকর সময়। জানতাম আজ না হলে কাল, আমরা মারা যাব। এই ভয় থেকে বেঁচে ফেরাটাই অসম্ভব ছিল।’’ শেষ পর্যন্ত স্টেইন মারা যাননি। বলা যায়, তুলনামূলক একটা ভাল জীবনই শেষ পর্যন্ত পেয়েছিলেন তিনি। সৌজন্যে তাঁর প্রেমিক সুলৎজ।
কিন্তু সত্যিই কি সুলৎজকে ভালবাসতে পেরেছিলেন স্টেইন? ১৯৪১ সালে জার্মানি থেকে সোজা এখানে নিয়ে আসা হয় স্টেইন ও তাঁর পরিবারকে। দীর্ঘ সময় ধরে রুদ্ধ ও অবদমিত এক জীবনের মধ্যে পড়ে থাকতে থাকতে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে থাকা এক তরুণী কি ভালবাসতে পেরেছিলেন শত্রুপক্ষের একজনকে? ব্যাপারটা আজও পরিষ্কার নয়। কন্যা ল্যারিসার মতে, তাঁর মা সারা জীবন ঘৃণাই করে গিয়েছেন সুলৎজকে। কেবল নিজের ও নিজের পরিবারের জীবন বাঁচাতেই তিনি সেই প্রেম প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছিলেন। তবে মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে স্টেইনও যে ধীরে ধীরে সুলৎজের প্রতি দুর্বল হননি সেকথা হলফ করে বলা মুশকিল। অন্তত সুলৎজ তাঁদের জন্য যা করেছিলেন, তারপর তাঁকে ঘৃণা করা মুশকিল। সবটাই অভিনয়? বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না।
সুলৎজ জানতেন, জার্মানরা শেষ পর্যন্ত এই শিবিরের কাউকে বাঁচিয়ে রাখবে না। কাজেই স্টেইনকে বাঁচাতে হলে এখান থেকে সরাতে হবে। ১৯৪২ সালের জুলাই মাসের এক রাতে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে স্টেইন-সহ তাঁর সঙ্গে থাকা ২৫ জন ইহুদিকে এক গোপন কুঠুরিতে সরিয়ে দেন। প্রাণে বেঁচে যান তাঁরা। বিষয়টা নাৎসি নেতৃত্বের নজর এড়ায়নি। ক্রমেই সন্দেহভাজনদের তালিকায় চলে যাচ্ছিলেন সুলৎজ। তবুও কাজ ও প্রাণ বাঁচানোর তাগিদ তখন তাঁর অন্তর্হিত। লক্ষ্য একটাই। যে করে হোক নিজের প্রেয়সীকে এখান থেকে সরাতে হবে। তবে তিনি বুঝতে পারছিলেন। সময় আর বেশি নেই হাতে।
১৯৪৩ সালের ৩০ মার্চ। এক কাজের অছিলায় এক ট্রাকে করে ২৫ জনের ইহুদি দলকে নিয়ে চললেন সুলৎজ। বলাই বাহুল্য স্টেইন ও তাঁর পরিবার ছিল সেখানে। আসল লক্ষ্য শহর ছেড়ে বেরিয়ে লালফৌজের কাছে পৌঁছনো। আর তাই গন্তব্যের কাছে পৌঁছেই গুলি করে ট্রাকের চালককে হত্যা করে নিজেই ট্রাক চালাতে শুরু করেন সুলৎজ। সঙ্গে সঙ্গে নাৎসি সেনারা গুলি চালাতে শুরু করলেও কপাল ভাল কেউই মারা গেলেন না। ধীরে ধীরে জার্মান অধিকৃত এলাকা ছেড়ে নিরাপদ স্থানের লক্ষ্যে এগিয়ে গেল ট্রাক।
কিন্তু তবুও এই কাহিনির শেষটা সুলৎজের জন্য ভাল হয়নি। ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বরেই মেনিনজাইটিসে ভুগে তাঁর মৃত্যু হয়। তার আগে মাসছয়েকের দাম্পত্যের পরই সুলৎজকে মস্কো পাঠিয়ে দেওয়া হয়। স্টেইনের সঙ্গে আর দেখা হয়নি তাঁর। পরে সুলৎজ ও স্টেইনের সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে সেও বেশিদিন বাঁচেনি। পরবর্তী সময়ে স্টেইন ফের বিয়ে করেন। সন্তান-সন্ততি, নাতি-পুতি নিয়ে মোটামুটি সুখে ঘর করে এক দীর্ঘ জীবন কাটিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেই সুখী জীবনের এক ফাঁকে নিশ্চয়ই তাঁর মনে পড়ত, ট্রাকচালক এক মত্ত প্রেমিককে! মুখে ঘৃণার কথা বললেও মৃত্যুর লাভাস্রোত থেকে জীবনের দিকে তাঁকে পৌঁছে দেওয়া মানুষটিকে কি সত্যিই ভালবাসতে পারেননি তিনি? এ এমন এক প্রশ্ন যার উত্তর আর কখনও জানা যাবে না। কেবল ইতিহাসের পাতায় থেকে যাবে আগুনঝরা দিনের আশ্চর্য প্রেমের আখ্যান। ‘স্তালিনগ্রাদ’-এর মতো ছবি কিংবা ‘নো উওম্যানস ল্যান্ড’-এর মতো উপন্যাসে বারবার যা ফিরে ফিরে আসে।