প্রসূন বিশ্বাস: একজনের বাড়ি অক্রুর দত্ত লেনের সরু গলির ভিতর। পুরনো দোতালা বাড়ি। তার ভিতরে দশ ফুট বাই দশ ফুট পলেস্তরা খসা ছোট্ট একটা ঘর। কড়ি-বরগা জানান দিচ্ছে এ বাড়ির বয়স নেহাত কম নয়। আর স্বল্পপরিসর ঘরের মহিলা বাসিন্দার বয়সও বিরাশি ছুঁই ছুঁই। আর বছর ছিয়াল্লিশের অন্যজন, থাকেন বাগুইআটির হেলা বটতলা অঞ্চলে। অলিগলি তস্য গলি পেরিয়ে তাঁর বাড়ি যেতে হয়। প্রথম জন বছর বিরাশির শান্তি চক্রবর্তী। দ্বিতীয়জন কমলেশ উপাধ্যায়। এই দু’জনকেই এবার মোহনবাগান ক্লাব উমাকান্ত পালধির (Umakanta Paladhi) নামাঙ্কিত সেরা সমর্থকের পুরস্কার দিতে চলেছে মোহনবাগান দিবসের (Mohun Bagan Day) অনুষ্ঠানে।
কমলেশ উপাধ্যায়ের দুটো পায়েই জন্মগতভাবে সমস্যা। কিন্তু মোহনবাগান অন্তঃপ্রাণ এই অবাঙালি মানুষটি আজ খাঁটি মোহনবাগানী হয়ে গিয়েছেন সবুজ-মেরুনের টানে। নিজেই বলছেন, “সেই নয়ের দশক থেকে বন্ধুদের সঙ্গে ছুটে যাওয়া মোহনবাগান মাঠে। কী করে যে এই সবুজ-মেরুন রঙটার সঙ্গে মিশে গেলাম নিজেও জানিনা। ” আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দল ফিরলেও, ছুটে গিয়েছেন এয়ারপোর্টেও। অথচ তাঁকে চলতে হয় বসে বসেই। আমরা যে চটি পায়ে পরি, কমলেশ সেই চটি পরেন দুই হাতে। কিন্তু তাতে তাঁর মোহন-আবেগে ভাঁটা পড়ে না। তাঁর দাদা অখিলেশ উপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘আগে ভয় পেতাম। বারণ করতাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা? ভাই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেত মোহনবাগানের খেলা থাকলে। আজ আর কিছু বলি না।” নিজের জামা কাপড়ের থেকেও কমলেশ বেশি যত্ন করেন মোহনবাগানের জার্সিকে।
[আরও পড়ুন: ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় টেস্টের আগে আবেগপ্রবণ রোহিত, ঈশানের থেকে চান সেঞ্চুরি]
আর শান্তি দেবী? নানা গলিঘুঁজি পেরিয়ে তাঁর ছোট ঘরে পা রাখতেই একমুখ হেসে বললেন, “পুরস্কার না দিলেও কিন্তু এই ভালোবাসা চলে যাবে না।” বিরাশি বছর বয়স। তাঁর সমবয়সী অন্যরা যখন বয়সজনিত কারণে গৃহবন্দী, সেখানে সদ্য মেয়েকে হারিয়েও নাতনির হাত ধরে শান্তি চক্রবর্তী ছুটে যান মোহনবাগান মাঠে, সল্টলেক স্টেডিয়ামে। একবার গিয়েছিলেন কটকেও। বলছিলেন, “খুব বাইরে খেলা দেখতে যেতে ইচ্ছে করে, জানেন?”
ফুটবলাররাও তাঁকে ভালোবাসেন। সোনি নর্ডি নিজের সোশাল সাইটে শান্তি চক্রবর্তীর ছবি পোস্ট করেছিলেন কিছুদিন আগে। প্রবীর দাস মোহনবাগানে থাকার সময় প্রণাম করে কিছু টাকা হাতে গুঁজে দিয়েছিলেন। যে টাকা পেয়ে তিনি বলেছিলেন, “টাকা কেন?” প্রবীর বলেছিলেন, “প্রণামী দিলাম দিদা।”
শান্তি চক্রবর্তীকে ময়দান ডাকে “মোহনবাগান দিদা” বলে। অনেক না পাওয়া আর না মেলার অঙ্কেও মোহনবাগানীদের এই দিদার মুখে অনাবিল হাসি লেগে থাকে। যৌবনে শ্যাম থাপার খেলা রেডিওতে শুনেছেন। আর এখন মাঠে গিয়ে দেখেন বর্তমান ফুটবলারদের খেলা। তাঁর ওই ছোট্ট ঘরে পরম যত্নে থাকে সবুজ-মেরুন উত্তরীয়। কমলেশের হাজার কষ্ট আবার মুহূর্তে আনন্দে রূপান্তরিত হয়, মোহনবাগান জিতলে। আর এঁরা আছেন বলেই তো ময়দান এত সুন্দর, এত নির্মল।