বিশ্বদীপ দে: বাঙালির কখনও আড্ডার বিষয়ের অভাব হয় না। আইপিএল থেকে রাজনীতি, শাহরুখ খানের নতুন সিনেমা থেকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং। কিন্তু বিশেষ বিশেষ সময়ে সেই আড্ডা যেন আরও বেশি করে সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে। এখন যেমন লোকসভা নির্বাচন (Lok Sabha Election 2024)। সোশাল মিডিয়া থেকে পাড়ার চায়ের দোকান- সর্বত্রই যেন তর্ক-বিতর্কের ঝড় উঠেছে। তাতে সাম্প্রতিক বিষয়, বিতর্কের পাশাপাশি ফিরে আসছে চিরকালীন কিছু তর্ক। তেমনই এক বিষয় ভোটের ময়দানে গুন্ডারাজ! এই বঙ্গে একেবারে গোড়া থেকে সমাজবিরোধীদের সঙ্গে ভোট তথা রাজনীতির দুনিয়ার এক আশ্চর্য সংশ্রব। একথা অস্বীকারের বোধহয় উপায় নেই। আজ অবশ্য গুন্ডাদের আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় না। রাজনীতির কর্পোরেটায়নে ছবিটা অনেক বদলেছে। কিন্তু মানুষের স্মৃতিতে এখনও জীবন্ত ভানু বোস, গোপাল পাঁঠা, রাম চ্যাটার্জিরা!
এদেশে স্বাধীনতার গৌরব আর দেশভাগের যন্ত্রণা এসেছিল হাত ধরাধরি করে। তারই পাশাপাশি ছিল দাঙ্গার বীভৎস ছবিটাও। বউবাজারের গোপাল মুখোপাধ্যায় নামের এক যুবক সেদিন এলাকাকে দাঙ্গাবাজদের হাত থেকে বাঁচাতে কীভাবে পালটা দল গড়েছিলেন তা সকলেরই জানা। সেই সময় থেকেই লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল ক্রিক রো-র ভানু বোস কিংবা চন্দননগরের রাম চ্যাটার্জির কথাও। ওঁরা ছিলেন গোপালের দলের সবচেয়ে পরিচিত মুখ! দেশের স্বাধীনতার পরে তাঁরা ভিড়ে গেলেন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। না, এই সব গুন্ডাদের কেউই সরাসরি কোনও দলে নাম লেখাননি। কিন্তু ভোট ময়দানে বাহুবলী হয়ে উঠে এঁরা রাতারাতি বনে যান ‘এক্স ফ্যাক্টর’। বীজগণিতের মতো এখানেও একই ভাবে ‘অজানা’ তথা নতুন সমীকরণের দিক বদলে দিতে জানতেন তাঁরা।
[আরও পড়ুন: বেনজিরভাবে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনই গ্রেপ্তার, দিল্লির সরকার চালাতে পারবেন ‘বন্দি’ কেজরি?]
এই বঙ্গভূমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় (Bidhan Chandra Roy) সম্পর্কে একটা ‘গল্প’ রয়েছে। তিনি নাকি একবার বিধানসভা নির্বাচনে বামপন্থী প্রার্থী মহম্মদ ইসমাইলের কাছে হেরে যাচ্ছিলেন। গোপাল-ভানু জুটির ‘হাতযশে’ই নাকি ভোটের ফলাফল ঘুরে যায়! রাজনীতির এই দুর্বৃত্তায়ন এভাবেই শুরু থেকে বাংলার রাজনীতির চৌখপ্পিতে সেঁটে বসে যায়। গত শতকের চারের দশকের একেবারে শেষ লগ্ন থেকে পাঁচ ও ছয় দশকের মাঝামাঝি গোপাল-ভানুদের দাপট ছিল দেখবার মতো। কিন্তু সাতের দশকের শুরুতে ছবিটা বদলে যায়। ১৯৭২ সালে রাজ্যের শাসনক্ষমতা বর্তায় কংগ্রেসের হাতে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন সিদ্ধার্থশংকর রায়। সেই সময় থেকেই আগের জমানার ঢাক ঢাক গুড় গুড় ছেড়ে সরাসরিই রাজনীতির আঙিনায় ঢুকে পড়েন তাবড় গুন্ডা ‘নেতা’রা।
অথচ তার আগের কয়েক বছর ছবিটা ছিল আলাদা। ১৯৬৭ থেকে শুরু করে মোটামুটি ১৯৭২- এই সময়কাল নকশাল আন্দোলনের বছর হিসেবে চিহ্নিত। আর শুরু থেকেই গোপাল-ভানুদের মতো গুন্ডাদের সঙ্গে এই নকশালদের সংঘাতে কেঁপে উঠেছিল কলকাতা। এতদিন কেবল সোডার বোতল, রিভলবার, চাকু, চেনের সঙ্গে সকলের পরিচয় ছিল। এই সময় থেকে পেটো কিংবা মলোটেভ ককটেলের মতো মারাত্মক সব বোমার আগমন ঘটে। আর এই লড়াইয়ে গুন্ডাবাহিনী কিছুটা কোণঠাসা হয়েই যায়। কিন্তু নকশাল আন্দোলন ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করলে নতুন করে ফিরতে শুরু করে মস্তানরা। ১৯৭২ সালে চারু মজুমদারের (Charu Majumdar) গ্রেপ্তারি ও সিদ্ধার্থশংকর রায়ের সরকার ক্ষমতায় আসার পর গুন্ডাবাহিনীর লোকজন ঢুকে পড়তে থাকে রাজনীতিতে। তারা কীভাবে নকশাল দমন বাহিনী তৈরি করেছিল, সেই গল্প আলাদা।
[আরও পড়ুন: কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারি নিয়ে মুখ খুললেন ‘গুরু’ আন্না হাজারে, কাকে বিঁধলেন?]
তবে নকশালদের আগে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের কাছে ধরাশায়ী হতে হয়েছিল ভানু-গোপালদের বাহিনীকে। যাদবপুরের এক কলোনি উৎখাত করতে গিয়ে অবিশ্বাস্য প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল সেই দলকে। আপাত ভাবে রাজনীতির সঙ্গে ভানুদের সংশ্রব যতই থাকুক, একটা দূরত্ব কিন্তু ছিলই। বাঙালদের হাতে মার খেয়েই সেই তথাকথিত কংগ্রেসি গুন্ডাদের প্রথমবার ধাক্কা খাওয়া। যা নকশাল আমলে কার্যতই আরও বড় আকার ধারণ করে। কিন্তু বাংলায় সিদ্ধার্থশংকর সরকারের আমলে ছবিটা বদলে যায়। স্বাধীনতার প্রথম দুই-আড়াই দশকের নামগুলো সেই সময় থেকেই ফিকে হয়ে যেতে থাকে।
এপ্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের বিধানসভা নির্বাচনের কথা এসেই পড়ে। সেবারের ভোটে নাকি কংগ্রেসি গুন্ডাদের বাড়বাড়ন্ত ছিল দেখার মতো! ‘রিগিং’ ব্যাপারটা সেবারই প্রথম মাথা তুলল। ইচ্ছেমতো ছাপ্পা ভোট, অল্পবিস্তর মারামারি এসব করে সেই গুন্ডারা রীতিমতো দাপিয়ে বেড়িয়েছিল। ফলপ্রকাশের পরে দেখা যায় বাংলায় বিরোধী দলই প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। আর এই সময় থেকেই যে ‘মূল্যবোধ’টুকু গুন্ডাদের ভিতরে দেখা যেত, তা অদৃশ্য হয়ে যায়। ফাটা কেষ্ট, হাতকাটা দেবারা ছিলেন অন্য গোত্রের। মহিলাদের নিরাপত্তা বাংলায় এর আগে কখনও বিপন্ন হয়নি। বরং ছবিটা ছিল একেবারে উলটো। কলকাতায় তো বটেই, মফসসলেও। একটা ‘গল্প’ বলা যেতে পারে এই প্রসঙ্গে। রাম চ্যাটার্জির নাম শুরুতেই করা হয়েছে। ‘চন্দননগরের রবিনহুড’ হয়ে ওঠা রাম হুগলির বুকে ‘রাজত্ব’ চালিয়েছিলেন। সত্যিই রীতিমতো দরবার বসিয়ে লোকের অভাব-অনুযোগ নাকি শুনতেন তিনি। আদিসপ্তগ্রামের এক দরিদ্র দম্পতির ষোড়শী কন্যা ধর্ষিতা হয়। এলাকার এক উঠতি মস্তানই তাকে অপহরণ করে তুলে নিয়ে যায় নির্জন স্থানে। আর সেখানে তাকে ধর্ষণ করে। কথাটা কানে যায় রাম চ্যাটার্জির। ‘শাস্তি’ দেওয়া হয় সেই ধর্ষককে। একেবারে ‘মৃত্যুদণ্ড’। তা বলে গোলাগুলি, ছোরা-বোমা নয়। জ্যান্ত কই মুখে পুরে দিয়ে! হ্যাঁ, একে বলে ‘কই করা’। বন্ধ মুখের ভিতরে কইয়ের দাপাদাপির ধাক্কায় দগ্ধে দগ্ধে মারা যায় সে! এমনই এক ‘গল্প’ আজও হুগলি, স্রেফ হুগলি কেন, এ বঙ্গভূমের সর্বত্রই কান পাতলে শোনা যেতে পারে। সত্য়ি-মিথ্যে যাই থাক, এমন মিথই কিন্তু রামের মতো চরিত্রদের ইমেজকে সুপারহিরোর মতো করে তুলেছিল।
যাই হোক, কংগ্রেস আমলের শেষে ১৯৭৭ সালে বাংলায় বাম শাসন শুরু হলে কংগ্রেস জমানার মস্তানরা ধীরে ধীরে ক্ষমতা হারাতে থাকে। শুরু হয় নয়া জমানা। ততদিনে কলকাতাও বদলাতে শুরু করেছে। আটের দশকে শহরজুড়ে মাথা তুলতে থাকে হাইরাইজগুলো। আর তা নির্মাণ করতে প্রয়োজন যত সিমেন্ট, রড, বালি তা ক্রেতাদের কিনতে বাধ্য করা হত তৎকালীন শাসকদলের মদতপুষ্টদের থেকে। যাদের বলা হত সিন্ডিকেট। এই সময় থেকেই গুন্ডা-মস্তানের যে পরিষ্কার চেহারাটা এতদিন ছিল, তা কেমন গুলিয়ে যেতে থাকে। নয়ের দশক ও তার পরেও ছবিটা ক্রমশ বদলেছে। কিন্তু সেই সব গুন্ডামির গল্প বড় বেশি হিংস্রতায় ভরা। এমন নয়, গোপালপাঁঠা-ভানু বোসদের গল্পে রক্তারক্তি নেই। কিন্তু পাশাপাশি ছিল তাঁদের নিজেদেরই তৈরি করা কিছু ‘নীতি’। রাজনীতিবিদরাও সেই গুন্ডাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতেন। কিন্তু সমাজ যত বদলেছে, রাজনীতিও নিজেকে বদলে নিয়েছে একটু একটু করে। আর ততই বদলেছে এবঙ্গের গুন্ডাতন্ত্রও। হয়তো এটাই যুগের নিয়ম। গুন্ডা-মস্তানদের ছবিটাও তাই বদলে গিয়েছে সময়ের দাবি মেনে নিয়েই। আর সেই বদল এতই আলাদা, তা নিয়ে রোমহর্ষক গল্প হতেই পারে। কিন্তু সেই গল্প তার আগের সময়ের সঙ্গে খাপ খায় না। একেবারেই না।
(তথ্যঋণ: পাতালপুরাণ/ সুপ্রিয় চৌধুরী)