সুমিত বিশ্বাস ও অমিত সিং দেও: বেপরোয়া গাড়ি চলাচলের প্রতিবাদ করেছিলেন তৃণমূল নেতা। আর তাই তাঁকে গাড়ি থেকে নেমে চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুসি। ঝাড়খণ্ডের তিন যুবকের বেদম প্রহারের পর হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত্যু তৃণমূল নেতার। রবিবার সন্ধ্যায় পুরুলিয়ার বরাবাজার থানার বেড়াদা যাওয়ার রাস্তায় কাশবহাল গ্রামের কাছে এই ঘটনায় খুনের অভিযোগ করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে ঝাড়খণ্ডের তিন যুবককে আটক করে তাদের গাড়িটিকে বাজেয়াপ্ত করেছে বরাবাজার থানার পুলিশ। এই ঘটনার খবর পেয়ে বরাবাজারে যান পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। মৃত তৃণমূল নেতার রক্ষী বারিদ মহাপাত্র ছুটি না নিয়ে অনুপস্থিত থাকায় তাকে সাসপেন্ড করেছে পুরুলিয়া জেলা পুলিশ। পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, "তিন জন যুবককে আটক করা হয়েছে। ঘটনার তদন্ত চলছে।"
ছবি: অমিত সিং দেও।
পুলিশ জানিয়েছে, মৃত তৃণমূল নেতার নাম প্রতুল মাহাতো (৫৫)। তাঁর বাড়ি পুরুলিয়ার বরাবাজার থানার বেড়াদা গ্রামে। ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন এই এলাকায় তিনি তৃণমূলের দক্ষ সংগঠক ছিলেন। বর্তমানে তিনি পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সদস্য ও পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক পদে ছিলেন। জেলা তৃণমূলের অন্যতম সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তথা পুরুলিয়া কেন্দ্রের নির্বাচন পরিচালন কমিটির চেয়ারম্যান সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "এই ঘটনার পেছনে কোনও রাজনীতি রয়েছে কিনা সেটা তদন্ত সাপেক্ষ। প্রতুল বেপরোয়া গাড়ি চলাচলের প্রতিবাদ করেছিল। তাঁকে চড়, থাপ্পড়, কিল, ঘুষি মারা হয়। তার জেরে মৃত্যু হয়। খুনের অভিযোগ করা হয়েছে।" এই ঘটনার পর বান্দোয়ানের বিধায়ক রাজীবলোচন সরেন, পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি নিবেদিতা মাহাতো, পুরুলিয়া কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী শান্তিরাম মাহাতো ও দলের জেলা সভাপতি সৌমেন বেলথরিয়া
বরাবাজারে আসেন। ছিলেন বরাবাজারের বাসিন্দা, পুরুলিয়া জেলা মহিলা তৃণমূলের সভানেত্রী সুমিতা সিং মল্ল।
কী হয়েছিল এদিন? স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বরাবাজার থেকে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধপত্র নিয়ে নিজের গাড়িতে করে বেড়াদায় গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলেন প্রতুলবাবু। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি অসুস্থ। সম্প্রতি ভেলোর থেকে চিকিৎসা করিয়ে আসেন। কাশবহাল গ্রামের কাছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে একটি চার চাকার গাড়ি এসে তাঁর গাড়ি আটকায় বলে অভিযোগ। সেই সময় প্রতুলবাবু বেপরোয়া গাড়ি চলাচলের প্রতিবাদ করেন। তার পরই ঝাড়খণ্ডের নম্বর প্লেট লাগানো ওই গাড়ি থেকে তিন যুবক নেমে প্রতুলবাবুর সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে যান বলে অভিযোগ। প্রতুলবাবু নিজের পরিচয় দিলে, ওই যুবকরা বলেন, কত বড় নেতা দেখি? তার পরই চড়, থাপ্পড়, কিল, ঘুষি শুরু বলে অভিযোগ। সেই সময় তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে এলাকার মানুষজন তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। এদিকে ওই যুবকরা পালাতে গেলে গ্রামের মানুষজন তাদের গাড়ি আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন।
বরাবাজারের এই তৃণমূল নেতা বরাবর প্রতিবাদী মুখ হিসাবে পরিচিত। বাম আমলে বুক চিতিয়ে যেমন সিপিএমের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। তেমনই মাও হিংসার প্রতিবাদ করেন। অথচ বাম আমলে মাও যোগে তাঁর নামে ১৭ টি মামলা চলছে। যা এখনও বিচারাধীন। যাত্রার আসরে মাওবাদী হামলায় তাঁর যোগ, ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ-সহ বন্দুক লুঠের মত অভিযোগে এই মামলা। এই মামলাগুলোর মধ্যে চারটিতে ইউএপিএ ধারা দেওয়া রয়েছে। প্রতুলবাবুর পরিবার বরাবর কংগ্রেসী ঘরানার। কলেজ জীবন থেকে তিনি রাজনীতি করতেন। বলরামপুর কলেজে পড়াকালীন ছাত্র পরিষদে ব্যানারে রাজনীতি করে ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় সক্রিয় রাজনীতিতে পা দেন। ওই বছরই বেড়াদা গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূলের প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন। এই সময় বেড়াদা গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে যে ২ জন তৃণমূলের জয়ী সদস্য ছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রতুল। ২০০৭ সালে বেড়াদা হাইস্কুলের পরিচালন সমিতি নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল করায় সিপিএম তাকে বাম নেতা খুনে 'মাওবাদী' তকমা দিয়ে জেলে পুরে দেয় বলে অভিযোগ। কিন্তু তবুও প্রতুল বাবুকে দমানো যায়নি। জেলে থেকেই সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে তিনি জয়লাভ করেছিলেন। তিনি বরাবাজার পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ও সহ-সভাপতি ছিলেন। রাজনীতি ছাড়াও এলাকায় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবেও তাঁর পরিচিত ছিল। ছৌ দলে তিনি ঢোল বাদক থেকে যাত্রার মাধ্যমে সিপিএমের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করেছিলেন এই জঙ্গলমহলে। ভালো ফুটবলও খেলতেন। এমন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অকাল মৃত্যুতে শোক গ্রাস করেছে বরাবাজারে।