লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে নানা কিসসা-কাহিনি পর্বে পর্বে সংবাদ প্রতিদিন ডট ইনে। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর ‘মৃত্যুরহস্য’ থেকে ইন্দিরা গান্ধীর ‘জেলযাত্রা’, জ্যোতি বসুর ‘ঐতিহাসিক ভুল’ থেকে মোদির ‘রাজধর্ম পালন’- ফিরে দেখা হারানো সময়। লিখছেন বিশ্বদীপ দে।
এদেশের প্রধানমন্ত্রীর কুরসিতে যাঁরা বসেছেন, তাঁদের সকলকেই আজও মনে রেখেছে আসমুদ্র হিমাচল। মোদি-নেহরু-ইন্দিরা-রাজীবের মতো হেভিওয়েট তো বটেই, ইন্দ্রকুমার গুজরাল কিংবা দেবেগৌড়ার মতো নেতাদেরও মানুষ ভোলেনি। কিন্তু এই তালিকায় একটা নাম রয়েছে, যিনি আমজনতার মাঝে আজ একরকম বিস্মৃতই। আমাদের 'কুরসির কিসসা' অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তাঁকে নিয়ে আলোচনা ছাড়া। একবার নয়, দুবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন গুলজারিলাল নন্দ। তবু কেন যেন বিস্মৃতির আড়ালে চলে গিয়েছেন মানুষটা! অথচ কী আশ্চর্য অনমনীয় চরিত্র তাঁর। গান্ধীর এই প্রিয় শিষ্যের জীবনগাথা সত্য়িই বিস্ময়কর।
দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পরে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছিল গুলজারিলালকে (Gulzarilal Nanda)। ১৩ দিন কুরসিতে ছিলেন তিনি। এর পর প্রধানমন্ত্রী হন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে তাঁর রহস্যময় মৃত্যুর পর ফের কুরসিতে সাময়িক ভাবে বসানো হয় গুলজারিলালকেই। কিন্তু সেবারও ১৩ দিন ছিল তাঁর মেয়াদ। দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী (Indira Gandhi)। পরবর্তী সময়ে গুলজারিলালের কন্যা পুষ্পাবেন বাবার দুবার প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ''উভয় ক্ষেত্রেই উনি বিষয়টাকে দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বারে তো মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন চাইছিলেন উনিই প্রধানমন্ত্রী থাকুন। কিন্তু বাবা নিজেই চাননি। ক্ষমতার খেলার অংশ হতে ওঁর আপত্তি ছিল।''
[আরও পড়ুন: বামেরা ক্ষমতায় এলে দ্বিগুণ হবে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার! ভোটপ্রচারে সৃজনের মন্তব্য নিয়ে শোরগোল]
১৮৯৮ সালে অবিভক্ত ভারতের শিয়ালকোটে (আজ যা পাকিস্তানের অংশ) জন্ম গুলজারিলালের। কেরিয়ার শুরু করেছিলেন আইনজীবী হিসেবে। প্র্যাকটিস করতেন এলাহাবাদে। ১৯২১ সালে বছর তেইশের যুবকটির জীবন বদলে যায় অকস্মাৎ। মুম্বইয়ে (তখনকার বোম্বে) ন্যাশনাল কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। সেই সময়ই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় মহাত্মা গান্ধীর (Mahatma Gandhi)। শোনা যায়, 'জাতির জনক' তাঁকে আহ্বান জানিয়েছিলেন স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য। বস্ত্র শ্রমিকদের এককাট্টা করার দায়ভার তাঁকেই দিতে চান তিনি। গুলজারিলাল রাজিও হয়ে যান। যদিও গান্ধী তাঁকে বলেন, একবার পরিবারকে জানিয়ে তবেই এই পথে আসতে। জীবনের সেই মোড় ঘোরানো মুহূর্তকে বর্ণনা করতে গিয়ে পরে গুলজারিলাল বলেন, ''সারা রাত ঘুমোতে পারিনি মানসিক অস্থিরতায়। অবশেষে আমি ঠিক করি পরিবারকে না জানিয়েই দায়িত্ব নেব।''
সেই শুরু। জীবনটাই বদলে গেল গুলজারিলালের। দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়তে গিয়ে দুবার যেতে হয়েছিল জেলেও। আসলে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়ার সময়ই সোশালিজমের বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলেন তিনি। গান্ধীর সাক্ষাৎ সেই বিশ্বাসকেই আরও পোক্ত করেছিল। দিশা তৈরি করে দিয়েছিল তাঁর রাজনৈতিক মার্গের। বাণিজ্যনগরী ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে তিনি বসবাস শুরু করেন গুজরাটে।
[আরও পড়ুন: পুরুলিয়াকে টেক্কা বারাকপুরের! মে মাসে আরও চড়বে পারদ, ৭ জেলায় লাল সতর্কতা]
১৯১৬ সালে গান্ধীজি স্থাপন করেন মজদুর মহাজন সংঘ। দেশের বস্ত্রশিল্পীদের সবচেয়ে পুরনো ইউনিয়ন। অনসূয়াবেন সারাভাই ছিলেন সভাপতি। এই ইউনিয়নের দায়িত্ব পেয়ে সংগঠনকে মজবুত করেছিলেন গুলজারিলাল। 'টেক্সটাইল লেবার অ্যাসোসিয়েশন'-এর সভাপতিত্ব করেছিলেন ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত। দেশে শ্রমিকদের এককাট্টা করতে তাঁর অবদান ঐতিহাসিক হয়ে রয়েছে। এদিকে ১৯২২ সালে যোগ দিয়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলনে। ততদিনে তিনি জড়িয়ে পড়েছেন সংসারেও। কিন্তু স্ত্রী লক্ষ্মীকে জানিয়েই বেছে নিয়েছিলেন সংগ্রামী জীবন।
তাঁর বাৎসল্যের একটি গল্প এখানে করা যেতে পারে। ১৯৩২ সালে ধুলিয়া জেলে যেতে হয় গুলজারিলালকে। জেলে যাওয়ার আগে তিনি দশ বছরের পুষ্পাবেনকে কথা দিয়েছিলেন পরীক্ষায় প্রথম হলে মেয়েকে ঘড়ি উপহার দেবেন। ফলাফল প্রকাশিত হলে দেখা যায় মেয়ে প্রথমই হয়েছে। এর পর জেলে বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে উপহার চেয়ে বসে মেয়ে। পরে সেই বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পুষ্পাবেন বলেন, ''আমি যখনও ওঁর কাছে উপহার চাইলাম, ওঁর জেলসঙ্গী জমনলাল বাজাজ একটা ঘড়া নিয়ে এল ঘড়ির পরিবর্তে।''
দেশ স্বাধীন হওয়ার বছরে জেনেভায় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন গুলজারিলাল। সুযোগ পেয়েছিলেন ইউরোপীয় দেশগুলোয় ঘুরে ঘুরে সোশালিজমকে বোঝার। স্বপ্ন ছিল, সদ্য স্বাধীন দেশে সেই সোশালিজমেরই চর্চা করার। দেশের প্রশানের সঙ্গে নানা ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে গুজরাটের সবরকণ্ঠয় জয়লাভ করে সাংসদ হন। হয়েছিলেন শ্রমমন্ত্রী।
১৯৬৪ সালে নেহরুর প্রয়াণের পরে দেশের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হলেন। গোটা বিশ্ব সেই সময় আগ্রহভরে তাকিয়ে ভারতের দিকে। সদ্য চিনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। নেহরুর মৃত্যুর পরে দেশে গণতন্ত্র বিপণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা ক্রমেই গাঢ় হচ্ছিল। এই সময় গুলজারিলালের সাময়িক নেতৃত্বই প্রশাসনিক পরিকাঠামোকে মজবুত করার পথ প্রশস্ত করেছিল।
লালবাহাদুরের মৃত্যুর পরও তাঁকে বসানো হয়েছিল কুরসিতে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রিত্বের চেয়ারকে নিজের রাজনৈতিক কেরিয়ারের শীর্ষবিন্দু হিসেবে দেখতে নারাজ ছিলেন গুলজারিলাল। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ছিল তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত। শ্রমিক ঐক্য থেকে প্রশাসন, সর্বত্রই কাজপাগল হিসেবে পরিচিত মানুষটি নিজেকে বরাবরই রেখেছিলেন দুর্নীতির একেবারে বিপরীত মেরুতে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সামলেছেন নানা মন্ত্রক। কিন্তু ১৯৭৫ সালে পাকাপাকি ভাবে অবসর নেন রাজনীতি থেকে। আসলে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা ঘোষণার সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি মন থেকে।
সব মিলিয়ে আজকের ভারতে দাঁড়িয়ে তাঁকে কার্যতই 'এলিয়েন' বলে মনে হয়। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কয়েক হাজার টাকার বেশি কোনওদিনও থাকেনি। বরাবরই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার মানুষটা গত শতকের ছয়ের দশকের গোড়ায় একটি স্পেশাল সেল তৈরি করিয়েছিলেন। তখন তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যেখানে সরকারি কর্মী কিংবা রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জমা করা যেত। স্বাভাবিক ভাবেই কংগ্রেসের বহু নেতার 'চক্ষুশূল' হয়ে পড়তে হয় তাঁকে। অনেকেই নাকি 'টার্গেট' করতে থাকেন গুলজারিলালকে। দিল্লিতে সংসদের কাছাকাছি অঞ্চলে দাঙ্গা লাগার পর তিনি জানতে পারেন, পুরো বিষয়টাই চক্রান্ত। অভিমানী নেতা ইস্তফা দেন সঙ্গে সঙ্গে।
দুর্নীতিকে কতটা ঘৃণা করতেন, এর সবচেয়ে বড় উদাহরণটা অবশ্য তাঁর বাড়িতেই মেলে। নাতি একটি ছবি এঁকে দাদুকে দেখিয়েছিল। দাদু সেটির প্রশংসাও করেন। কিন্তু অচিরেই রেগে ওঠেন। কেননা নাতি ছবি আঁকতে যে কাগজ ব্যবহার করেছিল তা ছিল 'সরকারি'। তাই সব প্রশংসা বদলে গিয়েছিল ভর্ৎসনায়। আজও সেই দিনটার কথা বলতে গিয়ে নাতি তেজস বলে ওঠেন, ''এমন সততার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারবেন না আজ।'' সঙ্গে সঙ্গে নাকি বাইরে বেরিয়ে নাতির জন্য দোকান থেকে কাগজ কিনে এনে দিয়ে গুলজারিলাল বলেছিলেন, ''এবার যত খুশি ছবি আঁকো।''
১৯৯৭ সালে ভারতরত্নে ভূষিত হয়েছিলেন। পরের বছর শতবর্ষে পা রাখার আগেই প্রয়াত হন গুলজারিলাল। ব্যক্তিগত জীবনকে সব সময় সহজ, সরল রাখতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুর সময় তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে কিছুই ছিল না। বলতেন, ''গান্ধীবাদের নীতি থেকে দূরে থাকাই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণ। অনাড়ম্বর জীবনযাপন স্বাভাবিক ভাবেই দুর্নীতিকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। প্রয়োজন যত কম, অর্থের প্রয়োজন তত কম।'' মৃত্যুর আড়াই দশক পরও গুলজারিলালের এই কথাগুলো রয়ে গিয়েছে ভারতীয় রাজনীতির আনাচে কানাচে। যত সময় যাচ্ছে ততই প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে এই দর্শন। আর বিস্মৃতির ওপার থেকে নতুন করে আলোচনায় উঠে আসছেন গুলজারিলাল নন্দ।