নন্দিতা রায়, নয়াদিল্লি: “কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার এক বছরের বেশি টিকবে না। মানুষ যদি বিপক্ষে চলে যায় তাহলে কারও কিছু থাকে না।” এমনটাই দাবি তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা ডায়মন্ডহারবারের তিনবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Abhishek Banerjee)। বুধবার দিল্লির সাউথ অ্যাভিনিউয়ে দলীয় দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে দীর্ঘ ঘরোয়া আলাপচারিতায় জাতীয় রাজনীতি থেকে একের পর এক রেল দুর্ঘটনা, রাজ্য রাজনীতির একাধিক বিষয়ে মুখ খুলেছেন অভিষেক। পাশাপাশি বাংলাকে কেন্দ্রের বঞ্চনা ও বাংলা ভাগ নিয়ে তীব্র আক্রমণ করেছেন বিজেপিকেও।
সেখানেই জোট শরিকদের কাঁধে ভর করে কেন্দ্রে যে সরকার চলছে তা এক বছরের বেশি টিকবে না বলে দাবি করে অভিষেক বলেছেন, “আমার ধারণা এই সরকার বেশিদিন চলতে পারে না। খুব বেশি হলে একবছর টিকবে। এ বছরেই যে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড ও জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে, সবকটিতেই বিজেপি (BJP) হারবে। আবার আগামী দিনে দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলিতেও বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত। মানুষ যদি বিপক্ষে চলে যায় তাহলে কারও কিছু করার থাকে না। গণতন্ত্রে মানুষের রায়ই গুরুত্বপূর্ণ। একবার বিজেপির বিরুদ্ধে মোমেন্টাম তৈরি হয়ে গেলে যারা তাদের সঙ্গে রয়েছে তারা এমনিতেই চলে আসবে। আমাদের কিছু করতে হবে না।” এ প্রসঙ্গে যে দুই জোট শরিক চন্দ্রবাবু নায়ডু ও নীতীশ কুমারের উপর ভর করে বিজেপি সরকার চালাচ্ছে, তাঁদের অতীতও স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, চন্দ্রবাবু ও নীতীশ যে আগেও বিজেপির সঙ্গে ছেড়ে দিয়েছিল শুধু তাই নয়, চন্দ্রবাবু সারা দেশে বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধীদের একজোট করার চেষ্টা পর্যন্তও করেছিলেন।
[আরও পড়ুন: ‘সংসদে একবারও ভুমিধসের কথা বলেননি কেন?’, ওয়ানড় কাণ্ডে রাহুলকে নিশানা বিজেপির]
অভিষেক কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণকে (Nirmala Sitharaman) শ্বেতপত্র প্রকাশের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন সংসদে দাঁড়িয়ে। যা নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী তৃণমূলের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করবেন বলে মন্তব্য করেছেন। সে নিয়েও মন্ত্রীকে তুলোধোনা করে অভিষেক বলেন, “এসব বড় বড় কথা না বলে বাংলায় হারার পরে কী টাকা দিয়েছে সেই শ্বেতপত্রটা প্রকাশ করুক। আর দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে গেল তো আগে হিমন্ত বিশ্বশর্মা, অজিত পওয়ার, শুভেন্দু অধিকারী, নারায়ণ রাণেদের সামনে এনে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে বিজেপিকে।” ভোট পায়নি বলে কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না এটাই আসল কথা। অভিষেক আরও বলেছেন, “ভুয়ো জব কার্ডে তো উত্তরপ্রদেশ এক নম্বরে, তারা কী করে টাকা পাচ্ছে? আর আবাসে তো বিজেপির বিধায়কের স্ত্রীর নাম ছিল, আমরা কেটে দিয়েছি। বিজেপি কি দলগতভাবে কোনও ব্যবস্থা নিয়েছে?”
বিজেপি টাকা আটকে রেখে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করলেও তৃণমূল মাথা নত করবে না বলেও মোদির দিকেই কার্যত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন অভিষেক। বলেছেন, “আবাস যোজনার নাম আমরা বদল করব না। বাংলা আবাসই থাকবে। আমরা তো পিএম আবাসকে সিএম আবাস করছি না। মুখ্যমন্ত্রীর নামেও করা হয়নি। ৪০ শতাংশ টাকা তো রাজ্য সরকার দেয়। দরকার হলে পুরো টাকাই দেব। আবাসের ১১ লক্ষকেই দেব। পরনির্ভর সরকারে প্রধানমন্ত্রী মোদি (Narendra Modi) আত্মনির্ভর ভারতের কথা বলেন তো আমরা আত্মনির্ভর বাংলা করে দেখাচ্ছি, আগামীদিনে আরও দেখিয়ে দেব।” বিজেপির বাংলা ভাগের দাবি নিয়েও মুখ খুলেছেন অভিষেক। বলেছেন, “বিজেপি প্রতিবার ভোটের আগে এটা করে। উত্তরবঙ্গের মানুষের ভাবাবেগে সুড়সুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে। তাই দলের কিছু নেতাকে দিয়ে এসব বলায়। বিজেপির কোনও প্রথম সারির নেতা জেপি নাড্ডা (JP Nadda), অমিত শাহরা সরাসরি বলুন তাঁরা বাংলা ভাগ করতে চান। সেই ক্ষমতা আছে কি!”
বিরোধী ইন্ডিয়া (INDIA) জোটে কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের সমীকরণ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা ব্যাখ্যা দেওয়া হলেও ইন্ডিয়া জোট ঐক্যবদ্ধই রয়েছে এবং জাতীয় স্তরে তৃণমূল সেখানে যথেষ্ট সক্রিয়ভাবেই রয়েছে। এ প্রসঙ্গে অভিষেকের সাফ কথা, “ইন্ডিয়া জোটে থাকা বাকি বড় দলগুলি নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেছে। কিন্তু সেখানে তৃণমূলই হল একমাত্র দল যারা নিজের ক্ষমতায় লড়াই করে ২৯টি আসন পেয়েছে, সেটা ভুলে গেলে চলবে না। আর সমস্ত রাজনৈতিক দলেরই নিজস্ব ইস্যু থাকে। কংগ্রেসের (Congress) রয়েছে, আবার আমাদেরও তেমন রয়েছে। তার মানে এই নয় যে আমাদের মধ্যে সমন্বয় নেই। ইন্ডিয়া জোট ঐক্যবদ্ধই রয়েছে। বৃহত্তর স্বার্থে আমরাও সেখানে রয়েছি।”
[আরও পড়ুন: তিনদিনের সফরে ভারতে ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী, মোদির সঙ্গে করবেন দ্বিপাক্ষিক বৈঠক]
লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না হওয়ার জন্য কার্যত কংগ্রেসকেই ঘুরিয়ে দায়ী করেছেন তিনি। বলেছেন, “আমরা তো আসন ভাগাভাগির কথা বলেছিলাম। আমি নিজে রাহুল গান্ধীর সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু কংগ্রেসই গড়িমসি করেছে। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, তেলেঙ্গানার বিধানসভা নির্বাচনের ফলের জন্য ওরা অপেক্ষা করেছে।” জাতি গণনা কংগ্রেসের ইস্যু হলেও তৃণমূলের কাছে দেশের সাধারণ মানুষের সমস্যা-সহ আরও অনেক ইস্যু বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলেই তিনি মনে করেন, সে কথাও এই সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন অভিষেক। ইন্ডিয়া জোটের কোনও বৈঠকেই জাতি গণনার প্রসঙ্গে কিছু আলোচনায় হয়নি বলেও জানিয়েছেন তিনি। নীতি আয়োগের বৈঠকে বিরোধী অন্য মুখ্যমন্ত্রী না গেলেও বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর যাওয়ার প্রসঙ্গে অভিষেকের স্পষ্ট জবাব, “আমাদের দায়বদ্ধতা মানুষের প্রতি। তৃণমূল রাবার স্ট্যাম্প নয়। আমাদের নীতি যেখানে বলার সেখানে বলতে হবে। কাল যেমন আমি নির্মলার সামনে বলেছি। তেমনই আমরা নীতি আয়োগের বৈঠকে গিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে বয়কট করেছি।” লোকসভার ডেপুটি স্পিকারের পদ নিয়ে সমাজবাদী পার্টিকে (Samajwadi Party) তারা সবরকম সহযোগিতা করবেন বলেও উল্লেখ করেছেন অভিষেক। বাংলায় লোকসভা-সহ বিভিন্ন নির্বাচনে দলের যারা কাজ না করে বসেছিলেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যেকথা আগে বলেছিলেন সেই কাজ চলছে এবং আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই তার ফল সবাই দেখতে পাবে বলে জানিয়েছেন অভিষেক।
আগামী বাংলা বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারের ক্ষেত্রে নতুন কর্মসূচির পরিকল্পনা তাঁর মাথায় রয়েছে কারণ একই কর্মসূচি রিপিট করা যাবে না, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুই বদলাতে হয় বলেই তিনি মনে করেন বলেও জানিয়েছেন ডায়মন্ডহারবারের সাংসদ। তাঁর নিজের কেন্দ্রে আবারও খুব শীঘ্রই প্রশাসনিক বৈঠক শুরু করতে চলেছেন। আগামী ১০ আগস্ট বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে।