কুণাল ঘোষ: অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Abhishek Banerjee) জনসংযোগ যাত্রা এখন দৃশ্যতই এক নজিরবিহীন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। মধ্য তিরিশের এক যুবনেতাকে ঘিরে এমন আলোড়নের উদাহরণ সাম্প্রতিক রাজনীতিতে নেই। জেলার পর জেলা, যে সব ছবি, ভিডিও, রিয়াল ভিউ, ড্রোন ভিউ দেখছি, তা চমকে দেওয়ার মতো। সবচেয়ে বড় কথা, তথাকথিত বড় চ্যানেল বা কাগজ যথাসম্ভব ব্ল্যাকআউট বা নেতিবাচক প্রচার করার পরেও অভিষেক যেভাবে ‘বাপি বাড়ি যা’ স্টাইলে ব্যাট করে চলেছেন, তার তাৎপর্য গভীর।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির প্রাণভোমরাই হচ্ছে জনআকর্ষণী মন্ত্র। তাঁর সঙ্গে বহুবার বহু স্থানে জনসমুদ্র দেখেছি। মমতা-ম্যাজিকের সেই সুনামি যখন নবপ্রজন্মের উত্তরসূরির তুরুপের তাস হয়ে ওঠে, তখন সার্বিকভাবে সেটা একটা বিশ্লেষণের বিষয় হয়ে ওঠে বই কী।
[আরও পড়ুন: নবান্নের একাধিক দপ্তরে সারপ্রাইজ ভিজিট মুখ্যমন্ত্রীর, জানতে চাইলেন হাজিরা কত!]
কী করছেন অভিষেক?
(১) ঘরবাড়ি ছেড়ে একটানা সফর, এর আগে কখনও হয়নি।
(২) রোড শো।
(৩) পায়ে হেঁটে জনসংযোগ, সরাসরি কথা।
(৪)নেতাদের নিয়ে অধিবেশন।
(৫) পঞ্চায়েতে যোগ্য প্রার্থীর সন্ধানে পার্টির নিজস্ব ভোট।
এই এতগুলি লক্ষণীয় কাজ চলছে অভিষেকের কর্মসূচিতে।
পরের প্রশ্ন, কী বলছেন অভিষেক?
মূলত ত্রিমুখী কথা। (১) রাজ্যের উন্নয়নের স্কিমগুলির প্রচার
(২) কেন্দ্রের বৈষম্যমূলক ও প্রতিহিংসাপরায়ণ পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধে জনমত গঠন। তার মধ্যে প্রাপ্য টাকা না দেওয়া থেকে এজেন্সির অতিব্যবহার সবই রয়েছে।
(৩) সাংগঠনিক শুদ্ধিকরণ, দলকে আরও সুসংহত, গতিশীল, জনমুখী করে তোলা।
এবার দেখা যাক, অভিষেকের কর্মসূচির ঠিক কী কী প্রভাব পড়ছে?
(১) দীর্ঘদিন পর পাহাড় থেকে সাগর, একযোগে রাস্তায় নামল তৃণমূল। অভিষেক যে জেলায় যাচ্ছেন, সেখানে তো বটেই; তার অনুরণনে সারা রাজ্যেই কর্মীরা কর্মসূচি, প্রস্তুতি, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারে ব্যস্ত।
(২) বিরোধীপক্ষ এবং মিডিয়ার একাংশ প্রতিকূল প্রচার চালালেও তাকে উপেক্ষা করে কর্মীদের সক্রিয় রাখার আত্মবিশ্বাস।
(৩) দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সূত্রে সংগঠনে যেখানে মেদ জমেছে, তার অবসানের প্রক্রিয়া শুরু
(৪) প্রবল জনজোয়ারে বিরোধী দলগুলির মনোবলে ধাক্কা দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া– মানুষ যাবতীয় চক্রান্তের জবাব দিতে তৈরি।
(৫) অভিষেকের বৈঠক, অধিবেশন, বার্তায় সিনিয়র, জুনিয়র, সব অংশের নেতা, কর্মীরা আরও ঐক্যবদ্ধ, সংহত হচ্ছেন।
(৬) প্রযুক্তি, পরিকল্পনা, পরিকাঠামোর সঠিক প্রয়োগ।
[আরও পড়ুন: তৃণমূলের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের পালটা বিজেপির নারায়ণ ভাণ্ডার! ঘোষণা সুকান্তর]
নিজে ভাঙা পা নিয়ে জেলায় বেরতে পারিনি। অভিষেকের কর্মসূচি কভার করতে যাওয়া বিভিন্ন হাউসের সাংবাদিকদের দেখলাম, রীতিমতো মুগ্ধ। এতটা শারীরিক চাপ নিয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে জেলায় জেলায় ঘুরে দিনভর কর্মসূচি, সকাল থেকে মাঝরাত, এত চাপ অভিষেক নিচ্ছেন কী করে! তার উপর মোবাইল ফোনে সক্রিয়, দলের অন্যান্য কাজে নজর, নির্দেশ।
জনসংযোগ যাত্রা যেন এক নতুন অভিষেককে তুলে ধরছে। মানুষের মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার। একদিকে, রাজ্যে সরকার পক্ষের নতুন প্রজন্ম, যেখানে সহিষ্ণুতার সঙ্গে উন্নয়নের প্রচারের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানবিরোধী ইস্যুর মোকাবিলা। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধী পক্ষের নেতা হিসাবে প্রতিবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া। আর তৃতীয়ত, এই দুইয়ের সঙ্গে এমন এক রাজনীতিবিদ হিসাবে শিকড় গভীরে নিয়ে যাওয়া, যার পা থাকবে মাটিতে, মাথা স্পর্শ করবে আকাশ।
বছরের প্রথম কালবৈশাখীর সন্ধ্যায় একটা ভিডিও দেখলাম। কালো মেঘে চারপাশ অন্ধকার। প্রবল হাওয়ায় গাছ-গাছালি দুলছে। তার মধ্যে গাড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন অভিষেক। রাস্তা জুড়ে উত্তাল জনসমুদ্র। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছিলেন, হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার জাদু। জনসংযোগ যাত্রার অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে অভিষেক যেন অভিভাবককে দিলেন নিশ্চিন্ত থাকার বার্তা, জাদুবাঁশি ছিল, আছে, থাকবে।
একাধিক শত্রুপক্ষ হাত মিলিয়েছে তৃণমূলের ক্ষতি করতে। নেতিবাচক বাতাবরণ দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা চলছে অবিরাম। এর পালটা লড়াইয়ের ডাক দিয়েছেন নেত্রী। সেনাপতি মাঠে নেমে পড়েছেন। নিজেদের ভুলত্রুটি সংশোধন করে দুর্ভেদ্য দুর্গ তৈরির চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের সঙ্গে সময়োপযোগী কাঠামো মিশিয়ে এক বৃহত্তর কর্মযজ্ঞ। সামনে পঞ্চায়েত, তার পর লোকসভা। এসবের প্রাক্কালে এই জনজোয়ার দিয়ে অভিষেক যেন বিরোধীদের জন্য দৈববাণী লিখে দিচ্ছেন, যতই চক্রান্ত করো, এই অভিমন্যু কিন্তু চক্রব্যূহ ভাঙতে শিখে গিয়েছে।