সদ্য অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওতে মুক্তি পেয়েছে ‘গুলাবো সিতাবো’। তার প্রাক্কালে আগেভাগে এই ছবি দেখেই ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর জন্য রিভিউ লিখলেন অভিনেতা আবির চট্টোপাধ্যায়।
‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর সৌজন্যে সুজিত ‘গুলাবো সিতাবো’ অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওতে মুক্তি পাওয়ার আগেই দেখে ফেললাম। আমি যদিও সিনেমা রিভিউ করাতে বিশ্বাস করি নই, যেহেতু আমিও এই জগৎটার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু যেহেতু এই ছবিটার অপেক্ষায় ছিলাম তাই এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি। লখনউ শহরে শুটিং হওয়া সুজিতদার এই ছবি আমাকেও আরও একবার নস্টালজিয়ায় ফিরিয়ে নিয়ে গেল। আমি নিজে লখনউতে ১৮-১৯ দিন থেকে শুটিং করেছি। এই মানুষগুলো আমার চেনা। বড়া ইমামবাড়া, আমিনাবাগ, সাতমাথার মোড়, ছোটা ইমামবাড়া এগুলো আমার খুব চেনা এবং সুজিতদা এবং সিনেমাটোগ্রাফার অভীক মুখোপাধ্যায়কে সাধুবাদ জানাতেই হয় লখনউয়ের নবাবি মেজাজ, অলি-গলি এত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য। কলকাতার সঙ্গে লখনউয়ের মিল এতটাই যে ‘ফতিমা মহল’-এর নোনাধরা দেওয়াল যেন কলকাতার পুরনো বাড়িগুলোকেই মনে করায়। একটা কথা বলতে পারি, ‘গুলাবো সিতাবো’র ট্রেলারের থেকেও ছবিটা দেখে অনেক বেশি অভিভূত হয়েছি।
এই ছবি পিছুটানের গল্প বলে। নস্টালজিয়া উসকে দেয়। আমরা ইতিহাস ভুলে যাই, এই পৃথিবী ভুলে যায় তার শিকড়, তার ফেলে আসা দিন। ‘মির্জা’ যে পুরনো বাড়ি আঁকড়ে তার ভাড়াটে ‘বাঁকে’র সঙ্গে নিত্যদিন ঝগড়া করে, সেই ‘ফতিমা মহল’ আসলে এখানে একটা মেটাফর। মির্জা এই বাড়ির টানে ফতিমা বেগমকে বিয়ে করেছিল। যকের ধনের মতো সেই বাড়ির উঠোন কামড়ে পড়ে থাকে। এটা লোভ না কি শেষ বয়সের অসহায়তা, সেটা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। যৌবন চলে যায়, সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়, বেঁচে থাকে বাড়ির প্রতি পিছুটান। লখনউ কিংবা কলকাতাতে আমরা দেখেছি এইরকম এক একটা পুরনো বাড়ির ধ্বংসের সঙ্গে এক একটা জেনারেশন হারিয়ে গিয়েছে। ঐতিহ্য হারিয়ে গিয়েছে। এই পুরনো বাড়িগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য যে মানসিকতা বা যে অর্থ লাগে সেটা না থাকার ফলে এক একটা বাড়ির ইট ক্ষয়ে গিয়েছে।
মির্জা কিংবা তার ভাড়াটে বাঁকে– এরা কেউ খারাপ মানুষ নয়। কিন্তু আমরা দেখি ছোট ছোট লোভ, একটু সুবিধে বাগিয়ে নেওয়ার জন্য যে যা খুশি তাই করতে পারে। এদের চাওয়াগুলো যে আকাশছোঁয়া এমনটা কিন্তু নয়। কিন্তু এই ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে মানুষের নৈতিক বোধগুলো যেন একটু একটু করে ক্ষয়ে যায়। সম্পর্কগুলো বদলে যায়। সুজিত সরকার এই ক্ষয়িষ্ণু সময়ের নানা দিক ‘গুলাবো সিতাবো’ ছবির কমিক এবং স্যাটায়ারিকাল মেজাজের মাধ্যমে দারুণভাবে তুলে ধরেছেন। কিপটে বদমেজাজি মির্জা কিংবা মিথ্যুক ভাড়াটের নানা ফন্দি দেখতে দেখতে মজা পেলেও, তার ভিতরে যেন লুকিয়ে আছে এক করুণ কাহিনি। ছবির শেষে বদমেজাজি মির্জা এবং ঝগড়ুটে বাঁকের জন্য খারাপ লাগে। গল্পকার এবং চিত্রনাট্যকার জুঁহি চতুর্বেদী এই দুটো চরিত্রের নানা স্তর যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা প্রশংসাযোগ্য। আপাতভাবে মির্জা এবং বাঁকেকে এক বদমাইশ বুড়ো এবং তার কুচক্রী ভাড়াটে মনে হলেও দিনের শেষে ওদের খুব সাধারণ মানুষ বলেই মনে হবে। যাদের চাওয়া-পাওয়ার চৌহদ্দি মাথার উপর একটা ছাদ। এই ছবিটা দেখতে দেখতে বাদল সরকারের নাটক ‘বল্লভপুরের রূপকথা’র কথা খুব মনে পড়ছিল।
[আরও পড়ুন: জোর যার মুলুক তার! সমাজের নগ্ন রূপ তুলে ধরল ‘পাতাল লোক’]
এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে, আমাদের চারপাশে যা হচ্ছে তাই নিয়ে বলিউডে অনেক ছবি হচ্ছে। সুজিত সরকারও এমন ‘স্লাইস অফ লাইফ’ জঁরের ছবি করেছেন। ‘পিকু’ তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু ‘গুলাবো সিতাবো’ যেন একেবারে অন্য পৃথিবী। ‘গুলাবো সিতাবো’ এমনই এক ঘরানার ছবি যার মেজাজটা নবাবি হলেও আসলে সাধারণের কথাই বলে। আরেকটা কথা আমার সবসময় মনে হয় ছবির মূল অস্ত্র হল চিত্রনাট্য এবং কাস্টিং। জুঁহি চতুর্বেদী এবং সুজিত সরকার অনেকদিন ধরেই একসঙ্গে কাজ করছেন। কাস্টিং এই ছবিটায় একটা অন্য মাত্রা দেয়। অমিতাভ বচ্চন, যাঁর ছবি দেখে আমরা বড় হয়েছি, যাঁর ‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান’ ইমেজের আমরা ভক্ত ছিলাম। তিনি এখন এই ধরনের ভাঙাচোরা, হেরে যাওয়া চরিত্রে অভিনয় করে খুব মজা পান বলে আমার ধারণা। আয়ুষ্মান অনেকদিন আগেই নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তার ডি-গ্ল্যাম লুক এবং সংলাপ বলার সময় একটা জড়তা এনে দারুণ এফেক্ট তৈরি করেছেন। বিজয়রাজ, বিজেন্দ্রকালা দক্ষ অভিনেতা, নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে আমাকে চমকে দিয়েছে আয়ুষ্মানের বোনের চরিত্রে সৃষ্টি শ্রীবাস্তবের অভিনয়। এই ছবি বড় পর্দায় মুক্তি পেলে হয়তো বক্স অফিসে বাজিমাত করত! কিন্তু সুজিত সরকার এবং তাঁর টিমকে ধন্যবাদ জানাই, ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ছবিটি দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। কারণ, এই সময় দাঁড়িয়ে আমরা সত্যিই জানি না, কবে আবার আগের মতো মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে ছবি দেখতে পারব।
[আরও পড়ুন: ‘ভালবাসায় বাঁচুক পৃথিবী’, বলছে ‘সিজনস গ্রিটিংস’]
The post ‘গুলাবো সিতাবো’ এই ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবীর কথাই বলে appeared first on Sangbad Pratidin.