ডা. তুফানকান্তি দলুই: মার্টিন লুথার কিং বলেছিলেন,‘‘ইতিহাসের চাকা ঘোরাতে একা রক্তই যথেষ্ট!’’সেটাকেই একটু এদিক ওদিক করে সহজেই চালিয়ে দেওয়া যায় চিকিৎসাবিজ্ঞানে। বলাই যায়, কারও স্বাস্থ্যের চাকা ঘোরাতে রক্তই যথেষ্ট! আমাদের শরীরের সব প্রান্তে পুষ্টি পৌঁছে দেয় রক্ত। তাই তো আজও মানুষ রক্ত পরিষ্কার রাখতে সকালে খালি পেটে কাঁচা হলুদ আর আখের গুড় খান। বয়স্করা বলেন, রক্ত পরিষ্কার থাকলে অর্ধেক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
রক্ত রোগের উপশম
শরীরের প্রতিটি কোণে পুষ্টি ও অক্সিজেন সরবরাহ করে রক্ত। এই পুষ্টি আসে ভিটামিন ও মিনারেল বা খনিজ পদার্থ থেকে। আবার শরীরের আর পাঁচটা অঙ্গের মতো রক্তেরও পুষ্টি জরুরি। তাই প্রতিদিনের খাবারে যদি কিছু ভিটামিন ও মিনারেল পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকে তাহলে আমাদের রক্তের মধ্যেও অপুষ্টি দানা বাঁধে ও নানারকম অসুখ দেখা দেয়। যার মধ্যে প্রথম চেনা নামটাই অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা। এছাড়া, হতে পারে রক্ত তঞ্চন বা জমাট বাঁধার সমস্যাও।
উপায় কী?
রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যার মূল কারণ ‘ভিটামিন কে’-র অভাব। এই সমস্যার সমাধান সঠিক খাদ্য নির্বাচন। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত শাক ও সবজি, ফল, তিসি, তিল, সিয়া সিড জাতীয় তৈলবীজ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য খাদ্য তালিকায় থাকতে হবে। রক্ত তঞ্চন বা জমাট না বাঁধার থেকেও চেনা অসুখ রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া। রক্তে পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিনের অভাব অথবা অপরিণত লোহিত রক্ত কণিকার (RBC) বিচরণই হল রক্তাল্পতা। এছাড়াও রক্তের অন্যান্য কণিকার (যেমন শ্বেতকণিকা, প্লেটলেট ইত্যাদি) সংখ্যা কমে গিয়েও হতে পারে সাইটোপিনিয়া।
ভুল ধারণাতেই সমস্যা
আমাদের অধিকাংশের ধারণা, অ্যানিমিয়ার কারণ ‘আয়রনের’অভাব। সেজন্য অনেকেই আয়রনের ঘাটতি মেটাতে ট্যাবলেট ও অন্যান্য সাপ্লিমেন্টের দিকে ঝোঁকেন। কিন্তু আদৌ কী কারণে সমস্যা, তা আমরা অনেকেই জানি না। খতিয়েও দেখি না। আয়রন বা লৌহ আমাদের রেড ব্লাড সেল বা লোহিত রক্তকণিকার মধ্যে অক্সিজেন পরিবাহী হিমোগ্লোবিনের অংশ। এই আয়রন আমরা পাই অ্যানিম্যাল টিস্যু যেমন মাংস, যকৃৎ, মাছ, ডিমের কুসুম ইত্যাদি আমিষ জাতীয় খাদ্য এবং অঙ্কুরিত ছোলা, খেজুর, কচুর শাক, পুদিনা ও অন্যান্য সবুজ শাক থেকে। এর মধ্যে আমিষ জাতীয় খাদ্য থেকে পাওয়া আয়রন আমাদের শরীরে বেশি কার্যকর। অবশ্য নিরামিষ খাদ্য থেকেও পর্যাপ্ত আয়রন মেলে যদি সঙ্গে থাকে উপযুক্ত পরিমাণে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার। কারণ, আমাদের অন্ত্রে খাদ্যদ্রব্য থেকে আয়রন মেশার জন্য সাহায্য প্রয়োজন ভিটামিন সির। ভিটামিন সির মাধ্যমেই আয়রন বা লৌহকণিকা রক্তে ও অস্থিমজ্জায় দ্রবীভূত হয়ে তৈরি করে লোহিত রক্তকণিকা।
আয়রনের বন্ধু এই ভিটামিন সি প্রচুর পরিমাণে থাকে সিট্রাস জাতীয় ফল যেমন লেবু, আমলকী বা বেরিতে। বেদানা, পেয়ারা, আপেল, আম ইত্যাদি ফলেও প্রচুর ভিটামিন সি থাকে। সবুজ শাক যেমন সজনে শাক, সজনে ডাঁটা ইত্যাদি ও বেশ কিছু সবুজ সবজি কিছু পরিমাণ ভিটামিন সি প্রদান করে। আয়রন ও ভিটামিন সি ছাড়াও আরও কিছু উপাদান রয়েছে যার অভাবে রক্তল্পতা হয়। সেগুলি হল ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন বি ১২ বা কোবালামিন, ভিটামিন ই এবং কপার।
আয়রন ছাড়াও কপার হল অপর একটি মিনারেল যা অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ করতে পারে কারণ কপার রক্ত ও অন্যান্য কোষে আয়রন সংরক্ষণ ও ব্যবহারের উপযোগিতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। কপার সব থেকে বেশি পাওয়া যায় সামুদ্রিক খাবার যেমন কাঁকরা, সামুদ্রিক ঝিনুক, সামুদ্রিক লবস্টার, মাংস ইত্যাদিতে। এছাড়াও থাকে বাদামে, শিম্ব জাতীয় বীজ যেমন সয়াবিন, তৈলবীজ যেমন তিল, সূর্যমুখী বীজ ইত্যাদিতে।
এবার আসি, ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন বি১২-এর কথায়। এই দুই ভিটামিন আমাদের শরীরের কোষ বিভাজন ও কোষের পূর্ণতা প্রাপ্তিতে অত্যাবশ্যক ভূমিকা পালন করে। লোহিত রক্তকণিকা ও হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সরাসরি অংশগ্রহণ করে ফোলেট। যদিও বি ১২-এর অভাব প্রকট হতে লাগে তিনবছর, ফলিক অ্যাসিডের অভাব প্রকট হতে সময় নেয় ৪ থেকে ৫ মাস। এই পরিস্থিতি আটকানোর সহজ উপায় সঠিক খাদ্য নির্বাচন।
[আরও পড়ুন: বর্ষাকালে রোজ রোজ ভাজাভুজি খেয়ে বিপদ ডেকে আনছেন না তো! জেনে নিন বিশেষজ্ঞদের মত]
ফলিক অ্যাসিড আমরা পাই যেসব খাদ্যে তা হল, ডাল ও শিম্ব গোত্রীয় খাদ্য যেমন ছোলা, ডাল, মটর, সয়াবিন, সবুজ শাক, বিনস ও অন্যান্য সবজিতে ও তৈলবীজ যেমন তিলে, আর থাকে যকৃতে ও ডিমে। বি১২ মূলত ব্যাকটিরিয়া দ্বারা সংশ্লেষিত এবং আমিষ জাতীয় খাদ্যে বেশি পাওয়া যায়। যেমন – মাছ, যকৃৎ, মাংস, গরু ও মোষের দুধ। বেশ কিছু পরিমাণে বি ১২ পাওয়া যায় ফারমেন্টেড খাদ্যদ্রব্যে যেমন – দই, ইডলি, পান্তাভাত ইত্যাদিতে। এছাড়া আছে ভিটামিন ই যা আমাদের শরীরে ভিটামিন সি, এ এবং সেলেনিয়ামের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে। ভিটামিন ই-র অভাবে লোহিত রক্তকণিকার কোষপর্দা নষ্ট হয়ে সৃষ্টি করতে পারে হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া। প্রতিরোধক হিসাবে ডায়েটে উপযুক্ত পরিমাণে রাখুন ভেজিটেবিল অয়েল যেমন রাইসব্র্যান তেল, বিভিন্ন রকম বাদাম, হোল গ্রেন যেমন গম, আটা, ডালিয়া, ওটস, কিনওয়া, মিলেট, হোল মিলেট ইত্যাদি।
সচেতনতার জন্য
- পুষ্টিকর খাবারের সঙ্গে চা বা কফি জাতীয় পানীয় খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করুন। চা কিংবা কফি পান এবং খাবারের মধ্যে অন্তত আধঘণ্টার ফারাক জরুরি। নচেৎ আয়রনের ঘাটতি হবে।
- নিজে থেকে অ্যান্টাসিড খাওয়া থেকে বিরত হোন ও ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলুন। কারণ পাকস্থলীতে অ্যাসিডের অভাব হলে বি-১২ আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে না।
- বয়ঃসন্ধিকালীন কন্যা, গর্ভবতী মহিলা ও ল্যাকটেটিং মহিলাদের আয়রন ও ফলিক অ্যাসিডের চাহিদা বেশি হয় অন্যান্য মহিলা ও পুরুষদের তুলনায়।
সর্বোপরি সবরকম খাদ্যাভ্যাসই আমাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে। যে কোনও কিছুই কম বা বেশি হলে স্বাস্থ্যের উন্নতি ব্যাহত হয়। কাজেই পেটের শান্তি মানেই শরীর শান্ত নাও হতে পারে। তাই বুঝে খান ও ভাল থাকুন।
অধ্যাপক ডা. তুফানকান্তি দলুই
এনআরএস হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান।