কার্তিক বড় আশ্চর্য মাস। একদিকে সে ছাড় দেয় উৎসবের, অন্যদিকে সংযত থাকার বার্তাটিও দিয়ে যায় প্রতি পদে। কী ভাবে, প্রতিপদ তিথিতে দাঁড়িয়ে তার সন্ধান করলেন অনির্বাণ চৌধুরী
সকল প্রতাপ হল প্রায় অবসিত।
উৎসবের রেশ ফুরিয়ে গেলে তেমনটাই হয়। চার দিক স্তিমিত হয়ে আসে ধীরে ধীরে। আজকেও নিয়ম মেনে তেমনটাই কি হচ্ছে না? কালীপুজো আর তার পরের দিন দীপাবলীতে জ্বলে উঠল অজস্র আলো, পুড়ল বাজি, আনন্দের শোরগোলে একপাশে সরে গেল মনকেমনেরা। এবার সংযত হওয়ার পালা। সুতো গুটিয়ে নেওয়া। প্রতিপদ তিথিতে সত্যযুগে যে বার্তাটি দিয়ে গিয়েছিলেন দধিবামন। আর দ্বাপরযুগে কৃষ্ণ। সত্যযুগে একজনের অনুরোধে অন্যের গর্ব খর্ব করছেন বিষ্ণুর অবতার। আর দ্বাপরে চূর্ণ করছেন সেই অনুরোধকারীরই গর্ব। দুইয়ে মিলেই এই বলিপ্রতিপদ তিথি।
প্রতিপদ মানে পক্ষের প্রথম দিন। সদ্য শেষ হয়েছে অমাবস্যা। কৃষ্ণপক্ষ মুখ লুকিয়েছে নিজেরই অন্ধকারে। আলো ক্রমে আসছে। বুদ্ধির আলো, জ্ঞানের আলো, চাঁদের আলো। সেই আলোয় পৌঁছনোর প্রথম দিনটিতেই জুড়ে গেল রাজা বলির নাম। অতি দর্পে হতা লঙ্কা, অতি মানেশ্চ কৌরবাঃ, অতি দানে বলি বদ্ধা, অতি সর্বত্র গর্হিতম! রাবণরাজার অতি দর্পের জন্য হতাহতের সংখ্যা গুনেছিল লঙ্কাপুরী। অতিরিক্ত অভিমান থেকে সর্বনাশের পথে এগিয়েছিল কৌরবরা। এবং, অতিরিক্ত দানশীলতার জন্যই পাতালসীমায় আবদ্ধ হয়েছেন রাজা বলি। আমরাও বুঝতে শিখেছি- কোনও কিছুরই বাড়াবাড়ি ভাল নয়।
যদিও উৎসব এখন মধ্যপথে। পাঁচ দিনের দীপাবলি সবে আজ পা দিল চতুর্থ দিনে। যাকে বলছি বলিপ্রতিপদ। পুরাণ বলছে, সত্যযুগে এই সময় সৃষ্টি শাসন করতেন দৈত্যবংশোদ্ভূত রাজা বলি। দৈত্য হলেও তিনি অত্যাচারী আদপেই নন। তাঁর রক্তে রয়েছে বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের জিন। প্রহ্লাদের পুত্র বিরোচন, তিনিও ছিলেন ধার্মিক রাজা। সেই বিরোচনেরই পুত্র বলি। ফলে, দান-ধ্যান-পুণ্যকাজের জন্য ত্রিলোকে তাঁর কথা সবার মুখে মুখে। এই দানশীলতা এবং সৎ আচরণের জন্যই একসময় বলির ক্ষমতা হয়ে উঠল সুদূরপ্রসারী। ইন্দ্রের থেকেও মহৎ হয়ে উঠল তাঁর ব্যক্তিত্ব। পরিণতিতে স্বর্গের সিংহাসন হারালেন ইন্দ্র। কেউ আর তাঁর কথা মনেই রাখল না।
বিপদ দেখে ইন্দ্র শরণাপন্ন হলেন বিষ্ণুর। বিষ্ণু তখন আবার ধারণ করলেন অবতার-শরীর। প্রথম মনুষ্য অবতার। জন্ম নিলেন ঋষি কশ্যপ এবং তাঁর স্ত্রী অদিতির বংশে। কিন্তু, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে সেই শিশুটিকে দেখে যত আনন্দ পেয়েছিলেন সবাই, তা দিনে দিনে হোঁচট খেল। শিশুটির স্বাভাবিক বাড় নেই। সে বামন! ওই নামেই সে বিখ্যাত হল জগতে। দধি তার অতীব প্রিয়, অতএব নাম হল দধিবামন।
রাজা বলির দানশীলতা তখন মাত্রা ছাড়াচ্ছে। প্রবাদ রটেছে, কেউ খালি হাতে ফেরে না তাঁর কাছ থেকে। বলিরও এটাই অহং- তিনি সবার ইচ্ছা পূর্ণ করতে সক্ষম। এই অহংকেই কাজে লাগালেন বামনদেব। ইন্দ্রের অনুরোধ রক্ষা করতে একদিন তিনি রওনা দিলেন বলির সঙ্গে দেখা করতে।
বলি তখন স্ত্রী বিন্ধ্যাবলীর সঙ্গে এক মহাযজ্ঞে ব্যস্ত। সেই যজ্ঞে ভাগ নিলেন বামন। এবং, যজ্ঞ অন্তে সব ব্রাহ্মণ যখন দান গ্রহণ করছে বলির কাছ থেকে, হৃষ্টচিত্তে ফিরছে গৃহের দিকে, তখন ভিক্ষা নিতে অগ্রসর হলেন বামনদেব। কিন্তু, এই দানগ্রহণ ব্যাপারটা খুব একটা সোজা পথে এগোল না। কেন না, বামনের একটাই শর্ত- তিনি নিজের মনোমতো দান গ্রহণ করবেন। বলিরও তাতে আপত্তি নেই! যিনি ত্রিলোকের অধীশ্বর, তাঁর অদেয় আর কী বা থাকতে পারে! ফলে, বামনের কথায় রাজি হলেন বলি। জানতে চাইলেন- তাঁর কী চাই!
বামনের প্রার্থিত ভিক্ষা ছিল সামান্যই- মাত্র তিন পা জমি! শোনা মাত্রই হাসতে হাসতে বলি হাত বাড়ালেন কমণ্ডলুর দিকে। হাতে জল নিয়ে, তা ভূমিতে নিক্ষেপ করেই দান করা শাস্ত্রসম্মত প্রথা। যদিও বেঁকে বসলেন দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য। তিনি জানেন, এই বামন যতই ছোটখাটো হোক, আদতে সে বিষ্ণু-অবতার। অতএব, তাঁর এই প্রার্থনাতেও লুকিয়ে রয়েছে ছল! কিন্তু, সে কথা দানের অহঙ্কারে মত্ত বলি কানে তুললে তো! উপায় না দেখে শুক্রাচার্য সূক্ষ্ম শরীরে প্রবেশ করলেন কমণ্ডলুতে। বন্ধ করতে চাইলেন জলনিঃসরণের পথ।
বলি যখন দেখলেন, কমণ্ডলু থেকে জল পড়ছে না, তখন তিনি মরিয়া হয়ে একটি কুশঘাস দিয়ে নিজেই পরিষ্কার করতে চাইলেন পাত্রটি। তার আঘাতে নষ্ট হল শুক্রাচার্যের একটি চোখ। অন্ধ শুক্রাচার্য ফিরে এলেন স্বরূপে। বুঝতে পারলেন, রাজাকে সংযত করার ক্ষমতা তাঁর নেই। বলিও কিছুটা অহঙ্কার নিয়েই ভূমিতে নিক্ষেপ করলেন জল। বললেন, তিন পা জমি মেপে নিক দধিবামন!
দেখতে দেখতে অতঃপর সেই ক্ষুদ্রকায় বামন ধারণ করলেন বিশ্বকে আচ্ছন্ন করা ত্রিবিক্রম রূপ। সেই ত্রিবিক্রম একটি পায়ে তিনি মেপে নিলেন স্বর্গ। অন্য পায়ে মর্ত্য। এবং, তাঁর নাভি থেকেও নির্গত হল একটি পা। জানতে চাইলেন ত্রিবিক্রম- এই পদটি তিনি স্থাপন করবেন কোথায়! বলির অহঙ্কার তখনও চূর্ণ হয়নি। তিনি ত্রিবিক্রমের সেই পদটি ধারণ করলেন নিজের মাথায়। এবং, পায়ের ভারে পৌঁছলেন সুতলে। পাতালের অন্তিম সীমায়। এই প্রতিপদ তিথিতেই।
তবে, ত্রিবিক্রম বলিকে পূর্ণ রূপে বঞ্চনা করেননি। তিনি জানিয়ে দেন, এই প্রতিপদ তিথি স্মরণীয় হবে বলির নামে। তার খ্যাতি হবে বলিপ্রতিপদ নামে। পাশাপাশি, এই দিনে পাতাল থেকে পৃথিবীতে একটি দিনের জন্য স্ত্রী-সহ ফিরে আসবেন বলি। জগতকে তিনি মনে করিয়ে দেবেন, সংযত না হলে অধিকার কোনও কিছুর উপরেই থাকে না।
কিন্তু বলি শাস্তি পেলেও উচ্ছৃঙ্খলতা সীমানা অতিক্রম করল। দ্বাপর যুগে। যখন কংসমর্দনের জন্য বিষ্ণু পৃথিবীতে ফিরেছেন কৃষ্ণ হয়ে। সেই সময় তিনি দেখলেন, ইন্দ্রের দর্প বাধা মানছে না। অতএব, তিনি বন্ধ করলেন ইন্দ্রপূজা। আত্মবিস্মৃত হয়ে ইন্দ্র প্রবল বৃষ্টির তোড়ে ভাসিয়ে দিতে চাইলেন গোকুল। কৃষ্ণ তখন সাতদিনব্যাপী সেই বৃষ্টি থেকে গোকুলবাসীকে রক্ষা করেছিলেন গিরি গোবর্ধন উত্তোলন করে। চূর্ণ করেছিলেন ইন্দ্রেরও অহং। সেও এই প্রতিপদ তিথি। যা স্মরণে রাখতে এই তিথিতে আজও রাজা বলি এবং গোবর্ধন পর্বতকে পুজো করে ভারত। আদতে, রূপকে নিজেকেই রাখতে চায় সংযমের সীমায়।
আমাদেরও তাই সংযত হওয়ার সময় এল! এই উৎসবে অকাতরে ব্যয় হয়েছে অর্থ। আলোর জৌলুসে, শব্দের তীব্রতায় কেঁপে উঠেছে রাতের নিঃস্তব্ধতা। সেই সবে রাশটানার সময় এল। মূঢ়তার অপনোদনের শাস্তি নিয়েই সময় এল কিছু মায়া ধরে রাখার। কেন না, অপচয়ের এই জীবনযাপনে যত ক্লান্তিই থাক, বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু! সেই কথাই মনে করিয়ে দেয় বলিপ্রতিপদ তিথি।
তার পরেও কি আমরা সংযত হব না?
The post ফিরছেন তিনি, আসুন আমরা সংযত হই! appeared first on Sangbad Pratidin.