‘রেপ ক্যাপিটাল’ দিল্লিকে জোর টক্কর দিচ্ছে ‘আইটি হাব’ বেঙ্গালুরু৷ এতদিনের ‘সুরক্ষিত’ এই শহরের সৌজন্যেই ভাইরাল দু’টি শব্দ, গণ শ্লীলতাহানি৷ বর্ষবরণের উচ্ছ্বাস অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছে শহরের রাস্তায়৷ তুলেছে প্রশ্ন৷ পাশবিক লালসার সামনে মনুষত্বকে বিকিয়ে দেওয়া উচিত? নারীর নারীত্বকে সম্মান জানাতে অক্ষম এই সমাজেরই কি থাকা উচিত? সুপর্ণা মজুমদার৷
রাস্তা, রাত, ঘটনা, উন্মত্ততা, নিরাপত্তা, নারী ও নিগ্রহ৷ এই শব্দগুলি আজকাল প্রায়ই ঘুরে ফিরে আসে সংবাদের শিরোনামে৷ স্থান পাল্টায়৷ কালও অতিবাহিত হয়৷ মানুষও পাল্টে যায়৷ কিন্তু শব্দগুলি একই থেকে যায়৷ রাজধানী দিল্লি, হরিয়ানা, বিহার, উত্তরপ্রদেশের নামগুলি লেখা অভ্যেসের পর্যায় পড়ে গিয়েছে৷ কিন্তু বেঙ্গালুরু? বছরশেষের রাতে হঠাৎ বেনোজলের মতো ঢুকে পড়ল বিপজ্জনক তালিকায়৷ না কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, এই বিপর্যয় কিছু বিকৃত মানুষের সৃষ্টি৷ শিকার অসংখ্য যুবতী৷
কী অপরাধ ছিল তাঁদের? ‘অপরাধ’ গুরুতর৷ নতুন বছরের আনন্দে গা ভাসিয়েছিল তাঁরা৷ যেখানে প্রায় দেড় হাজার পুলিশ নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন রয়েছে৷ সেই স্থানকে নিরাপদ ভেবে ষোলো চলা পূর্ণ করে সতেরোর উচ্ছ্বাসে মেতে ছিল৷ পুরনো বছরের রাগ-দুঃখ, হাসি-কান্না, দেনা-পাওনা সব ভুলে ডানা মেলতে চেয়েছিল নতুন বছরের মুক্ত আকাশে৷ তাও আবার এমন একটা শহরে৷ যা ভারতের গর্বের ‘আইটি হাব’ বলে পরিচিত৷ বেঙ্গালুরু৷ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নারীরাও যেখানে আসেন পেশাগত সুযোগের আশায়৷ কাজ শেষে রাত-বিরেতে বাড়ি ফিরতেও যেখানে কোনওদিন দ্বিধাবোধ হয়নি এতদিন৷
যেই স্থানের সাম্প্রতিক স্বাক্ষরতার হার ৮৮.৭১ শতাংশ৷ সেই ভরসাতেই বর্ষবরণের জন্য এমজি রোডে ও ব্রিগেড রোডে বেশি রাত পর্যন্তই থেকে গিয়েছিল মেয়েগুলি৷ কিন্তু ‘নিরাপদ’ শহরের রাস্তা তখন বিষাক্ত৷ স্বার্থপর, লোলুপ দৃষ্টিগুলো এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল৷ প্রকাশ্য রাস্তায় শুরু হল জোর-জবরদস্তি৷ পুলিশের চোখের সামনেই জান্তব লালসার শিকার হচ্ছিলেন যুবতীরা৷
কেউ উৎসবের উন্মাদনার দোষ দেবেন, কেউ মহিলাদের ছোট পোশাকের, কেউ বা বলবেন গভীর রাতে রাস্তায় আনন্দে গা ভাসানোর কী আছে? আছে৷ স্বাধীন দেশে মৌলিক অধিকার আছে, নারী কিংবা পুরুষ হওয়ার আগে মানুষ হওয়ার অধিকার আছে, কারও মেয়ে হওয়ার অধিকার আছে, কারও বোন হওয়ার অধিকার আছে, কারও প্রেমিকা হওয়ারও অধিকার আছে৷ নারীর নারী হওয়ার অধিকার আছে৷
এই অধিকার নিয়েই একই রাতে বাড়ি ফিরছিল বেঙ্গালুরুর আরও এক যুবতী৷ বছর শেষের রাতেরই ঘটনা৷ না, কোনও উৎসবে সামিল হননি তিনি৷ অফিস থেকে ফিরছিলেন৷ আচমকা সামনে এসে থামল বাইকটা৷ দু’জন যুবক ছিল তাতে৷ একজন নেমে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল যুবতীর উপর৷ সিসিটিভি ক্যামেরার সেই ছবি ধরা পড়তেই ছড়াল চাঞ্চল্য৷ টনক নড়ল পুলিশের৷ গ্রেফতারও হল জনা চারেক৷ কিন্তু সমাজের নীতি পুলিশদের উপদেশের পালা শুরু হয়েছে৷ এঁরা আবার বেশ হেভিওয়েট মানুষ৷ যেমন কর্নাটকের এক মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এ ধরনের ঘটনা ঘটেই থাকে। আবার আরও একধাপ এগিয়ে সপা নেতা আবু আজমির বক্তব্য, মহিলাদের পোশাকই এ ঘটনার জন্য দায়ী। পশ্চিমী সংস্কৃতির অনুকরণে মহিলারা ছোট ছোট পোশাক পরছেন, আর তাই শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটছে। দিনকাল যখন খারাপ, তখন কোনও মহিলার একা বেরনো উচিত নয়।
উচিত? মহিলা দেখামাত্র ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত? তাঁকে জোর করে শারীরিক নিগ্রহ করা উচিত? তাঁকে পণ্য হিসেবে পাচার করা উচিত? তাঁর কাপড়ের মাপ নেওয়া উচিত? তাহলে শনিবারই সেই বেঙ্গালুরুতেও আবার মুসলিম সম্প্রদায়ের মহিলার শ্লীলতাহানির খবর এল কেন? তাহলে অখ্যাত গ্রাম থেকে আধুনিক শহরে শিশুদের যৌন নিগ্রহের খবর আসে কেন? তাঁদেরও কী শরীরের কাপড়ের মাপ ছোট ছিল? নাকি কোনও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রচ্ছন্ন উৎসাহ দিচ্ছিল?
আচ্ছা, উচিতের প্রশ্নটা যদি একটু ঘুরে যায়? বিকৃত কামুক মনকে কী প্রশ্রয় দেওয়া উচিত? মাদকাসক্ত হয়ে পশুর চেয়েও অধম ব্যবহার করা উচিত? জান্তব লালসার সামনে মনুষত্বকে বিকিয়ে দেওয়া উচিত? নারীর নারীত্বকে সম্মান জানাতে অক্ষম এই সমাজেরই কি অস্তিত্ব থাকা উচিত?
আরও পড়ুন –
(পুলিশের সামনেই শ্লীলতাহানি অসংখ্য মহিলার)
(বেঙ্গালুরুর রাস্তায় শ্লীলতাহানি তরুণীর, সিসিটিভি ফুটেজে চাঞ্চল্য)
(বেঙ্গালুরুতে এবার শ্লীলতাহানির শিকার বোরখা পরিহিতা যুবতী)
The post পাশবিক লালসার সামনে মনুষত্বকে বিকিয়ে দেওয়া উচিত? appeared first on Sangbad Pratidin.