অর্ণব দাস, বারাসত: চাঁপাডালি মোড় থেকে টাকি রোড ধরে কিছুটা এগোলেই বারাসত (Barasat) পুরসভার ২২ নম্বর ওয়ার্ড। এরই অন্তর্গত মধুমুরালি মুরশেদ হাটি রোড। এই মুরশেদহাটি রোড লাগোয়া পুকুরের ধারে দেড় কাঠা জমির উপর সুন্দর দোতলা বাড়ি। বাড়ির বাইরে একটি বোর্ড লাগানো। তাতে লেখা – সেন এন্টারপ্রাইজ, ইমপোর্ট, এক্সপোর্ট, টুর অ্যান্ড ট্রাভেলস। নিচে লেখা মালিকের নাম – লালু সেন। বৃহস্পতিবার এই বাড়ির চারপাশে স্থানীয়দের ভিড় থাকলেও পরিবেশ ছিল একেবারে থমথমে। প্রত্যেকের চোখেমুখে আতঙ্ক স্পষ্ট। এদিনই ভোর চারটে নাগাদ এসটিএফের (STF) বিশাল বাহিনী এই বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করেছে জেএমবি’র জঙ্গি সন্দেহে লিংকম্যান এই বাড়িরই মেজো ছেলে লালু সেন ওরফে রাহুলকে।
প্রায় ১৫ বছর ধরে এই বাড়িতেই লালুর সঙ্গে থাকেন বাবা লক্ষ্মণ সেন, মা সন্ধ্যা সেন ও ছোট ভাই গোপাল সেন। বড় ভাই ভোলা সেন থাকেন ইটালি। লালুর বাবা লক্ষ্মণ সেন দমদমের এক বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করতেন, মা গৃহবধূ। বারাসতের আগে দমদমের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন তাঁরা। সেই বাড়িতেই জন্ম লালুর। তাদের আদি বাড়ি অবশ্য বসিরহাটে। বারাসতের বিবেকানন্দ স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে লালু। মধ্যমেধার ছাত্র ছিল সে।
[আরও পড়ুন: চোখ নয়, মনের আলোয় পরস্পরের দেখা, সাত পাকে বাঁধা পড়লেন দৃষ্টিহীন যুগল]
এরপর বাংলাদেশের (Bangladesh) সঙ্গে তার যোগাযোগ শুরু হয় সরষের খোল বিক্রির মাধ্যমে। বছর সাতেক আগে বাংলাদেশের ঢাকার বাসিন্দা সাথী সেনের সঙ্গে বাংলাদেশেই বিয়ে করেন লালু। স্ত্রী পেশায় বাংলাদেশের আইনজীবী। এরপরে লালুর যাতায়াত আরও বেড়ে যায় বাংলাদেশে। স্ত্রী সাথী খুব কম আসতেন লালুর বারাসতের বাড়িতে। এ বিষয়ে লালুর মা সন্ধ্যা সেন জানান, “ভালোবাসা করে বাংলাদেশেই বিয়ে করেছিল লালু। সাথী চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে শেষবার এই বাড়িতে এসেছিল। বেশ কয়েকদিন থেকে ছিল। সে এখন অন্তঃসত্ত্বা।” তিনি আরও জানান,”পুলিশ যখন বাড়িতে আসে লালু তখন আমার পাশেই ঘুমোচ্ছিল। গ্রেপ্তারের পাশাপাশি ঘরও তল্লাশি চালায় পুলিশ। আমি আমার ছেলেকে খুব ভাল চিনি। আমার ছেলে নির্দোষ। ব্যবসার কারণে এবং বউয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য তার বাংলাদেশে যাতায়াত করতে হত ঠিকই। কিন্তু আমার ছেলে এই রকম কাজ করতে পারে না।”
[আরও পড়ুন: COVID-19: গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে সামান্য বাড়ল সংক্রমণ, করোনার বলি ১২ জন]
বাড়ির বাইরে এক্সপোর্ট ইমপোর্টের বোর্ড লাগানো থাকলেও প্রতিবেশীদের বেশিরভাগই জানেন না, লালু ঠিক কী কাজ করেন। প্রতিবেশীর কাকলি দে’র কথায়, “লালু ঠিক কী কাজ করে, সেটা জানি না। এলাকাবাসীর সঙ্গে ওর মেলামেশা খুব কম। কিন্তু বছর তিনেক হল লালুর চলাফেরায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করে। টাকাপয়সা হলে যা হয় আর কী। তবে জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ! এ কথা ভাবতেই পারছিনা।” এদিনের এসটিএফের অভিযানের আগে ঘুণাক্ষরে কেউ টের পায়নি লালুর এই কার্যকলাপ সম্পর্কে। এদিন ২২ নম্বর ওয়ার্ড কো-অর্ডিনেটর কৃষ্ণা সাহার স্বামী সুখরঞ্জন সাহা বলেন, “ছোট বেলা থেকেই লালুকে চিনি। এলাকায় মেলামেশা কম করত। ইদানিং তার আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল সে অনেক টাকার মালিক। শুনেছিলাম লালু তার বাবাকে বলেছিল রেশনের চাল ভিখারিরা খায়। এই কথা থেকেই তার আচরণ পরিষ্কার বোঝা গেছিল। লালু যে বাংলাদেশের মেয়েকে বিয়ে করেছিল সেকথাও আমরা অনেক পরে জেনেছি। কি কাজ করত সেটা জানতাম না। বাইরে তার বেশি যাতায়াত ছিল এই টুকুই জানতাম। তবে এই রকম কাজের সঙ্গে লালু যুক্ত তা ভাবতে পারিনি।”
লালু বাদে তার পরিবারের কারও সঙ্গেই বাংলাদেশের কোনওরকম যোগাযোগ ছিল না। সম্প্রতি হরিদেবপুরে জেএমবি জঙ্গি সন্দেহে ধৃত তিনজনের মধ্যে নাজিউরকে জিজ্ঞাসাবাদের পর এদিন ভোরে এসটিএফের টিম বারাসতের মধুমুরালির বাড়ি থেকে লালুকে গ্রেপ্তার করে। বাজেয়াপ্ত করে দুটি ল্যাপটপ, একটি আইপ্যাড, দুটি মোবাইল ও বেশ কিছু নথি।