অর্ণব আইচ: ফুরিয়ে এসেছিল হাতে থাকা ১২ হাজার টাকা। শেষ সম্বল নিজের অ্যানড্রয়েড মোবাইলও বৃহস্পতিবার বিক্রি করে দিয়েছিল হাজার চারেক টাকায়। কিন্তু তারপরও ধার নেওয়ার স্বভাব পরিবর্তন হয়নি তার। বাগুইআটির কেষ্টপুরের দুই কিশোর ছাত্র অতনু দে ও অভিষেক নস্করকে অপহরণ ও খুন করে পালানোর পর হাতের টাকা ফুরিয়ে এসেছিল মূল অভিযুক্ত সত্যেন্দ্র চৌধুরীর। ছোট বাটন মোাবাইল থেকে এক আত্মীয়কে অনুরোধ জানাতে তিনি অনলাইনে পাঠিয়েছিলেন টাকা। সেই সূত্র ধরেই হাওড়া স্টেশনের বাইরে ট্রাভেল এজেন্টের কাছ থেকে মুম্বইগামী ট্রেনের টিকিট কাটতে গিয়েই বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশের গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ে গেল সত্যেন্দ্র।
বৃহস্পতিবার সকালে বিধাননগর কমিশনারেটের গোয়েন্দারা খবর পেয়েই হাওড়া স্টেশনের কাছে ওই ট্রাভেল এজেন্টের অফিসে যান। কর্মীদের সত্যেন্দ্রর ছবি দেখাতেই তাঁরা শনাক্ত করেন তাকে। তখন সে কী পোশাকে রয়েছে, তাও গোয়েন্দারা জানতে পারেন। সে যে হাওড়া স্টেশনেই ঢুকেছে সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গোয়েন্দারা ঘিরে ফেলেন হাওড়া স্টেশন।
একটি টিম আরপিএফের সহযোগিতায় দেখতে শুরু করেন সিসিটিভির ফুটেজ। অন্য টিম তাকে খুঁজতে শুরু করে। তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন যে, ট্রেনের জন্য স্টেশনেই অপেক্ষা করবে সে। শেষ পর্যন্ত প্ল্যাটফর্মে তাকে অবিন্যস্ত চেহারায়, একটি ছাপা সাদা শার্ট ও হাফ প্যান্ট পরে ঘুরতে দেখা যায়। এক গোয়েন্দা আধিকারিক ‘সত্যেন্দ্র’ বলে ডাকতেই সে ফিরে তাকায়। শনাক্ত করা হয় ওই খুনের অভিযুক্তকে।
[আরও পড়ুন: সপ্তাহান্তে ফের তৎপর ইডি, কলকাতার ৩ জায়গায় অভিযান আধিকারিকদের]
পুলিশ জানিয়েছে, গত ২২ আগস্ট, অপহরণ ও খুনের পরই গা ঢাকা দেয় সে। বাগুইআটি, নিউটাউন, কলকাতা, হাওড়া, বর্ধমানের পর সে পৌঁছয় হুগলিতে। প্রথম ক’দিন সস্তার হোটেলে থাকে। তখনও দুই কিশোরের দেহ শনাক্ত হয়নি বলে সে নিশ্চিত ছিল। কিন্তু ক্রমে ঘুরতে ঘুরতে হাতের ১২ হাজার টাকা শেষ হয়ে আসে। হোটেলে থাকার মতো টাকা হাতে ছিল না। তাই সে কখনও বাসস্ট্যান্ড, কখনও বা স্টেশনের ওয়েটিং রুম, এমনকী সিমেন্টের বেঞ্চে শুয়েও রাত কাটিয়েছে বলে তার দাবি। এই দাবিগুলি পুলিশ যাচাই করছে।
সত্যেন্দ্র চৌধুরী জানিয়েছে, তখন তার সম্বল বলতে শুধু হাতের অ্যানড্রয়েড মোবাইলটি। বৃহস্পতিবার হুগলির ডানকুনির একটি দোকানে সেটি বিক্রি করে দিয়ে সে হাজার চারেক টাকা পায়। সিআইডি আধিকারিকদের কাছে তার দাবি, যখনই সে জানতে পারে যে, দু’জনের দেহ উদ্ধার হয়েছে, তখন থেকেই সে কলকাতা থেকে পালানোর ছক কষে। সে যে দু’টি নম্বর থেকে অতনুর বান্ধবী, মা, বাবাকে কোটি টাকা মুক্তিপণ চেয়ে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ করছিল, সেই দু’টি সিমকার্ডের উপর নজর ছিল সিআইডি ও বিধাননগর কমিশনারেটের গোয়েন্দা বিভাগের।
বুধবার থেকে দু’টি ফোনই বন্ধ করে দেয় সত্যেন্দ্র। এরপরই দিল্লি অথবা মুম্বই যাওয়ার কথা ভাবে সে। শেষ পর্যন্ত মুম্বই বেছে নেয়। কিন্তু মুম্বইয়ে থাকত গেলে তার কাছে কিছু টাকার প্রয়োজন। সেই কারণেই সে মোবাইলটি বিক্রি করে। একই সঙ্গে ছক কষে সরাসরি মুম্বই না গিয়ে ‘কাটা রুটে’ যাওয়ার। তখনও তার হাতে ছিল ছোট বাটন মোবাইলটি। সেই মোবাইল থেকেই এক আত্মীয়কে ফোন করে বলে, সে বিপদে পড়েছে। তাই কিছু টাকা ধার চায়। সুদ দেবে বলেও জানায়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর জানিয়ে দেয়। বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের গোয়েন্দারা তার মোবাইলের উপর নজর রাখছিলেন। ছোট মোবাইলটি থেকে ওই আত্মীয়কে ফোন করার পরই গোয়ন্দারা জানতে পারেন যে, সে হুগলির ডানকুনি এলাকায় রয়েছে। কিন্তু এরপর তার মোবাইল ফের বন্ধ।
ওই আত্মীয়ের সঙ্গে পুলিশ যোগাযোগ করলে তিনি জানান যে, জরুরি কাজে মুম্বই যেতে হচ্ছে বলেই সত্যেন্দ্র টাকা চেয়েছে। তিনি অনলাইনে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছেন। এবার ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টের উপর শুরু হয় নজরদারি। এদিন সকালে জানা যায় যে, ওই অ্যাকাউন্ট থেকে কয়েক হাজার টাকার লেনদেন হয়েছে। হাওড়া স্টেশনের অদূরে এক ট্রাভেল এজেন্সির অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে ওই টাকা। সেই সূত্র ধরেই গোয়েন্দারা হাওড়ায় হানা দেন। সে কোথায় কোথায় গা ঢাকা দিয়ে ছিল, সেই সম্পর্কে আরও তথ্য জানার চেষ্টা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।