সুকুমার সরকার, ঢাকা: জামাতে ইসলামি ও তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উগ্রপন্থী দলগুলোকে দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য হুমকি। এমনই আখ্যা দিয়ে তাদের নিষিদ্ধ করার জন্য মার্কিন কংগ্রেসে প্রস্তাব আনা হল। অবশ্য ভারত ইতিমধ্যে কাশ্মীরে জামাতকে নিষিদ্ধ করেছে। মার্কিন কংগ্রেসের প্রস্তাবে ধর্মভিত্তিক এই রাজনৈতিক শক্তিকে ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্য হুমকি বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। দলটির সক্ষমতার ভিত্তিমূলে আঘাত করার জন্য বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে প্রস্তাবে। ইন্ডিয়ানার রিপাবলিকান দলের কংগ্রেসম্যান জিম ব্যাংকস প্রতিনিধি পরিষদে এ প্রস্তাব আনেন। এতে বিএনপি-সহ বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের প্রতি জামাতে ইসলামি-সহ অন্য উগ্রপন্থী সংগঠনের সংস্পর্শ থেকে দ্ব্যর্থহীনভাবে দূরে থাকার আহ্বান জানানো হয়। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের জন্য প্রস্তাবটি কংগ্রেসের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবে দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ধর্মীয় দলগুলোকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আল কায়দা ও তালিবানের সঙ্গে জামাত সদস্যদের যোগাযোগ আছে। এ দল ও তাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত উগ্রপন্থী দলগুলো দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশের জন্য হুমকি। ফলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সহিংসতার গুরুতর ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
এদিকে শরিক দল জামাতকে নিয়ে একের পর এক চাপের মুখে পড়লেও নিশ্চুপ রয়েছে বিএনপি। কারণ জোট থেকে জামাতকে বিদায় করার প্রশ্নে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। যে কারণে বিএনপির তৃণমূল থেকে মধ্যম পর্যায়, এমনকি স্থায়ী কমিটির বেশির ভাগ নেতার মনোভাব জামাতের বিপক্ষে থাকলেও তা কাজে আসছে না। উপরন্তু শীর্ষ নেতৃত্বের মনোভাব স্পষ্ট না হওয়ায় বিএনপি নেতারা এ প্রশ্নে মুখ খুলতেও রাজি হচ্ছেন না। যদিও বিএনপির সর্বস্তরের আলোচনায় জামাতকে এখন আর ‘প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক মিত্র’ বলে মনে করা হচ্ছে না। বরং দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে এ দলটিকে এখন ‘বোঝা’ বলেই মনে করা হচ্ছে। কিন্তু দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এসব জেনেও কোনও সিদ্ধান্ত না দেওয়ায় বিএনপির মধ্যেই অস্বস্তি ঘনীভূত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিএনপির চালকের আসনের শীর্ষ নেতাদের সহযোগীরাই জামাতের সঙ্গ ছাড়ার বিষয়টি ঠেকিয়ে রেখেছেন। ওই সহযোগীদের কেউ কেউ ভারতবিরোধী শক্তির ছত্রচ্ছায়ায় রয়েছেন বলে বিএনপিতে আলোচনা আছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের এক প্রস্তাবে জামাতের সঙ্গ ছাড়তে বিএনপির প্রতি আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে জামাত নির্মূলেরও তাগিদ দেওয়া হয় উত্থাপিত ওই প্রস্তাবে। ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এক প্রস্তাবে বিএনপিকে জামাত থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানানো হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিম বিশ্বের দেশগুলোর এই অবস্থানের বাইরে জামাতের কারণেই প্রধান প্রতিবেশী ভারতের সমর্থন আদায়ে বিএনপি বারবার ব্যর্থ হচ্ছে বলে দলটির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে আলোচনা আছে।
[ভারতকে দেওয়া অতিরিক্ত বাণিজ্যিক সুবিধা প্রত্যাহার করছেন ট্রাম্প]
অনেকের মতে, জামাতের সঙ্গে জোটে থাকায় সর্বশেষ ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনেও বিএনপি রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নির্বাচনের পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেন প্রকাশ্যেই বলেছেন, জামাতকে ধানের শীষ মার্কায় নির্বাচন করতে দেওয়া হবে এটি জানলে তিনি ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে যেতেন না। মার্কিন কংগ্রেসের এমন প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে জামাত-সহ ইসলামি উগ্রপন্থী দল ও সংগঠনগুলোকে আশকারা দিয়ে আসছে দেশটি। দেরিতে হলেও তাদের বোধোদয় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এমন মনোভাবে জামাতকে নিষিদ্ধ করার পথ সুগম হবে। তাই দ্রুত জামাত নিষিদ্ধে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান তাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জামাত-সহ উগ্রপন্থী দলগুলোকে পোষণ করেছে। জামাতকে তারা গণতান্ত্রিক দল বলেও আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু যখন দেখছে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের পিছনে এসব উগ্রপন্থী দল জড়িত তখন সুর পালটাচ্ছে। দেরিতে তাদের অবস্থান বদলালেও এজন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, সরকার এ ব্যাপারে ধীরে চলো নীতি নিয়েছে। কারণ, আদালতের রায়ে জামাতের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু তাদের নিষিদ্ধ করা সরকারের এখতিয়ার। সরকার সেই কাজে যথেষ্ট ঢিলেমি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের এমন অবস্থানের পর জামাত নিষিদ্ধে সরকার আরও উদ্যোগী হবে বলে আমি মনে করি। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের অপর এক প্রস্তাবের বরাত দিয়ে এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে সেখানেও দ্ব্যর্থহীনভাবে জামাত থেকে বিএনপিকে দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হয়েছে।
কংগ্রেসম্যান ব্যাংকস বলেন, বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতিক ড. কামাল হোসেন প্রকাশ্যেই বিএনপিকে জামাতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছেন। রিপাবলিকান দলের কংগ্রেসম্যান ব্যাংকস জানান, জামাতে ইসলামির ভাবধারা পোষণ করে এমন অনেক সংগঠন যুক্তরাষ্ট্রেও রয়েছে। এগুলো তহবিল সংগ্রহে যুক্ত। এ ক্ষেত্রে তিনি উদাহরণ হিসেবে ইসলামিক সার্কেল অব নর্থ আমেরিকা, শেয়ার লিডারশিপের নাম উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বারবার হামলা, চরমপন্থার বিস্তার এবং জামাত-সহ সংশ্লিষ্ট মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থের জন্য হতাশাব্যঞ্জক। যুক্তরাষ্ট্রের ভিতরে ও বাইরে জামাতে ইসলামির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সব প্রতিষ্ঠানকে তহবিল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার দাবি করা হয়েছে প্রস্তাবে। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের কংগ্রেসের এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, একসময় তারা জামাতে ইসলামিকে মডারেট গণতান্ত্রিক দল বলে আখ্যা দিয়েছিল। দেরিতে হলেও তাদের বোধোদয় হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বহুদিন ধরে আমরা জামাত নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছি। এটা এখন সময়ের দাবি। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত অবস্থানে স্বাধীনতাবিরোধী এ দলটিকে নিষিদ্ধের পথ আরও সুগম হবে বলে আমি মনে করি। এদের শুধু নিষিদ্ধ করলেই হবে না। এদের আদর্শ নির্মূল করতে হবে।’ ধর্মের নামে দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করারও দাবি জানান তিনি।
[কোথায় মৌলানা মাসুদ? পরস্পর বিরোধী তথ্যে বাড়ছে বিভ্রান্তি]
The post বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে জামাতকে নিষিদ্ধ করতে প্রস্তাব মার্কিন কংগ্রেসের appeared first on Sangbad Pratidin.