shono
Advertisement

নামে কী বা আসে যায়!

‘পশ্চিমবঙ্গ’-এর জায়গায় রাজ্যের নাম ‘বাংলা’ হলে আমাদের প্রশাসনিক কাজে কিছু সুবিধা মেলে৷ সেই সুবিধা গ্রহণ থেকে কেন পিছিয়ে আসব আমরা? The post নামে কী বা আসে যায়! appeared first on Sangbad Pratidin.
Posted: 08:19 PM Aug 30, 2016Updated: 02:49 PM Aug 30, 2016

অনেকে ভাবেন, বার্লিন প্রাচীরের মতো দুই বাংলার মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া একদিন ভেঙে পড়বে৷ কিন্তু এটা অলীক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়৷ ‘পশ্চিমবঙ্গ’-এর জায়গায় রাজ্যের নাম ‘বাংলা’ হলে আমাদের প্রশাসনিক কাজে কিছু সুবিধা মেলে৷ সেই সুবিধা গ্রহণ থেকে কেন পিছিয়ে আসব আমরা? সুতীর্থ চক্রবর্তী

Advertisement

দেশভাগের পর ‘পূর্ব পাঞ্জাব’ নামটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি৷ কারণ পাঞ্জাব বলতে আমরা বুঝি শিখ অধ্যুষিত জলন্ধর-অমৃতসর৷ কখনওই ‘পশ্চিম পাঞ্জাব’ বলে কোনও এলাকার অস্তিত্ব আমাদের মননে ছিল না৷ পাঞ্জাবের যে অংশটি পাকিস্তানে পড়েছে, সেই অংশটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও আমাদের থেকে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করত৷ তাই পাঞ্জাবকে যখন ভাঙা হল, তখন ভারতের অংশটুকুকে ‘পূর্ব পাঞ্জাব’ নাম রাখার কথা ভাবা হয়নি৷

বাংলার ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন৷ স্বতন্ত্র একটি ভৌগোলিক এলাকা হিসাবে বাংলার অস্তিত্ব বাংলাভাষার জন্মেরও আগে৷ অষ্টম শতকে মাৎস্যন্যায় রদ করে পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল যেদিন থেকে বাংলায় রাজত্ব কায়েম করেছিলেন, সেদিন শুধু ভৌগোলিক দিক থেকেই নয়, বাংলার এক ভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অস্তিত্ব তৈরি হয়েছে৷ তাই শ’য়ে শ’য়ে বছর ধরেই বাংলা বলতে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে নদনদী ভরা সবুজ শ্যামল এক বিশাল এলাকা৷ দেশভাগের পরে ১৯৪৭ সালে যখন ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামে নতুন প্রদেশ গঠিত হল, তখন তার এক রাজনৈতিক তাৎপর্য ছাড়াও নতুন এক ভৌগোলিক পরিচয় তৈরি হল৷ অর্থাত্‍ বাংলা বলতে যে বিশাল ভৌগোলিক এলাকাকে কয়েকশো বছর ধরে আমরা চিনে এসেছি, তার একটি অংশ ভারতবর্ষের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হল৷

বাংলার যে অবিভক্ত ধারণা, তা স্বাধীনতার আগেই ভাঙা হয়েছিল৷ ১৯০৫ সালের আগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে বাংলা, বিহার ও ওড়িশা নিয়ে এক বিরাট প্রদেশ ছিল৷ যা এক লেফট্যান্যাণ্ট গভর্নরের শাসনাধীন ছিল৷ তারও আগে মোগল যুগেও বাংলা, বিহার, ওড়িশা একজন সুবেদারের অধীনে ছিল৷ ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন পূর্ববঙ্গ ও অসম নিয়ে একটি পৃথক প্রদেশ তৈরি করেছিলেন৷ সেই থেকে শুরু হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন৷ ১৯১১ সালে আন্দোলনের জেরে ব্রিটিশরা বঙ্গভঙ্গ রদ করে৷ তখন পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গকে একসঙ্গে নিয়ে তৈরি হয় নতুন প্রদেশ ‘বঙ্গ’৷ যা আবার ১৯৪৭ সালে ভেঙে যায়৷

‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও রাজনৈতিক তাৎপর্য এখানেই যে, দেশভাগের জেরে বৃহত্‍ বাঙালি জাতিসত্তার একটি খণ্ডিত ভৌগোলিক অংশ নিয়ে গঠিত হল আমাদের রাজ্য৷ নিঃসন্দেহে এই পশ্চিমবঙ্গ পরিচয়ে সেই সময় দেশভাগের ইতিহাস ও যন্ত্রণা মিশে ছিল৷ নতুন ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর ‘পূর্ববঙ্গ’ নামটি অবলুপ্ত হয়েছে৷ বাংলাদেশের মানুষও আর ‘পূর্ববঙ্গ’ নামটি ব্যবহার করতে চান না৷ বাংলাদেশ আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র৷ বাংলাদেশের বাঙালিও নিজের সেই স্বাধীন ও সার্বভৌম পরিচয় দিতে গর্ব অনুভব করে৷ ফলত, পূর্ববঙ্গের অস্তিত্ব যখন থেকে রাজনৈতিকভাবে ও সাংস্কৃতিক চেতনায় আর নেই, তখন ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামটির প্রাসঙ্গিকতা কীভাবে থাকে, সেই প্রশ্ন বারবার উচ্চারিত হয়েছে৷ যাঁরা বলছেন দেশভাগের ইতিহাসের সাক্ষী হিসাবে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামটিকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি, তাঁরা কি মনে করেন ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামটি উচ্চারিত হলেই আজও দেশভাগের স্মৃতি উসকে ওঠে? ‘ভারত’ রাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ আর পাঁচটি রাজ্যের মতোই আজ বিবেচিত৷ পশ্চিমবঙ্গ মানে আজ বৃহত্‍ বাঙালি জাতিসত্তার একটি খণ্ডিত অংশও নয়৷ দেশের অন্য রাজ্যের মতোই পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দারা ভারতবাসী৷ বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের মানুষের মেলবন্ধন এখানে ঘটেছে৷

অনেকে ভাবেন, বার্লিন প্রাচীরের মতো দুই বাংলার মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া একদিন ভেঙে পড়তে পারে৷ যেদিন সেই ঘটনা ঘটবে, সেদিন হয়তো বৃহত্তর বাঙালি জাতিসত্তার অস্তিত্ব ফের জন্ম নেবে৷ সেই সময়ে এসে পশ্চিমবঙ্গের প্রাসঙ্গিকতা ফিরবে৷ কারণ পশ্চিম জার্মানি ও পূর্ব জার্মানির মতো মিলবে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ৷ কিন্তু এটা এক অলীক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়৷ সবচেয়ে বড় কথা, বাঙালি জাতিসত্তা আজ শুধু পশ্চিমবঙ্গের গণ্ডিতেও আটকে নেই৷ বাঙালি আজ ভারতবর্ষের সমস্ত প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে৷ বাঙালি আজ বিদেশেও৷ সুতরাং কোনও ভৌগোলিক এলাকা দিয়ে বাঙালিকে আজ চিহ্নিত করতে যাওয়া অত্যন্ত ভুল কাজ৷ কথায় কথায় আমরা বলি, বাঙালি আজ ‘গ্লোবাল’৷

এই জায়গায় দাঁড়িয়ে ‘পশ্চিমবঙ্গ’-এর জায়গায় রাজ্যের নাম বদল করে ‘বাংলা’ রাখার মধ্যে কোনও অন্যায় নেই৷ রাজ্যের নাম ‘বাংলা’ হলে আমাদের প্রশাসনিক কাজে কিছু সুবিধা মেলে৷ সেই সুবিধাটা গ্রহণ করার জন্য কেন আমরা রাজ্যের নামবদল থেকে পিছিয়ে আসব? যাঁরা রাজ্যের নামের মধ্য দিয়ে দেশভাগের ইতিহাসকে খুঁজতে চান, তাঁদের এটাও তো মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার আগে দীর্ঘ হাজার বছরের ইতিহাসে এই ভৌগোলিক অংশ তো ‘বঙ্গ’ বলেই পরিচিত ছিল৷ শশাঙ্কের আমলের গৌড় থেকে এই বাংলা কীভাবে পালযুগে তার শক্তির বিস্তার ঘটাল, তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করল, সেটাও তো ইতিহাস৷ তা হলে সেই ইতিহাস কেন আমরা ফের স্মরণ করব না? ঔপনিবেশিক শাসনের দাগ মোছার জন্য দেশের বহু শহর, বহু রাজ্য নিজেদের নামবদল করছে৷ আমরাও তো ভাবতে পারি দেশভাগের যন্ত্রণাকে ভুলতে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামটা মুছে দেওয়াই সমীচীন হবে৷ সর্বোপরি শেক্সপিয়রকে উদ্ধৃত করে বলতে হয়, ‘নামে কী বা এসে যায় সখা, নামে কী বা করে, গোলাপকে যে নামে ডাকো, সৌরভ ভিতরে…’

The post নামে কী বা আসে যায়! appeared first on Sangbad Pratidin.

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement