বিশ্বদীপ দে: হিংসার বাংলাদেশে গুঁড়িয়ে গিয়েছে একটি বাড়ি। বিপ্লবী ছাত্র’রা ভাঙচুর চালিয়ে আগুন লাগায় স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটিতে। যেটি পরে জাদুঘরে পরিণত করা হয়েছিল। কেননা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর এই বাড়িটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক ভয়ংকর ইতিহাস। অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের (Sheikh Mujibur Rahman) হত্যাকাণ্ডের দগদগে স্মৃতি বহন করা সেই বাড়ি এখন 'অদৃশ্য।' কিন্তু ইতিহাসের আসল শক্তি হল তাকে বায়ুভূত করে দিলেও সে থেকে যায়। তাকে মোছা যায় না। বরং মুজিবের বাড়িটি ভাঙা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে উচ্চারিত হতে শুরু করেছে সেই ইতিহাস। এই লেখায় আমরা ফিরে দেখব সেই লজ্জার ইতিহাস।
দেখতে দেখতে পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় পাঁচ দশক। অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টকে ভোলা যায় না। অথচ এরই বছর চারেক আগে জন্ম হয়েছিল এক নতুন দেশের। যে দেশের নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন 'বঙ্গবন্ধু'। যে জয় সম্ভবই ছিল না ভারতীয় সেনার অংশগ্রহণ ব্যাতিরেকে। এই জয় তাই এই দেশ, এপার বাংলাকেও সমানভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। 'জয় বাংলা' স্লোগান বাঙালির জাতিসত্তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গিয়েছিল। বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেই আন্দোলনে যোগদান থেকেই মুজিবের রাজনৈতিক কেরিয়ারের সূচনা। এরপর প্রায় আড়াই দশকের সংগ্রাম শেষে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে ওঠা। কিন্তু স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকেই মুজিব সরকারকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। এমনই নানা অসন্তোষের মধ্যে দিয়েই হয়তো তৈরি হয়েছিল মুজিব হত্যার প্রেক্ষাপট। এই স্বল্পায়তন লেখায় সেই প্রসঙ্গে আমরা যাব না। কেবল ফিরে দেখব অধুনালুপ্ত ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কেমন ভয়ংকর হত্যালীলার কালো ছায়ায় দগ্ধ হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু ভবনে তাণ্ডব, যা মনে করিয়ে দিচ্ছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোর
সরকারি সেই বাসভবনকে সেদিন ঘিরে ফেলেছিল বাংলাদেশ সেনার একটি দল। তাদের সঙ্গে ছিল ট্যাঙ্কও। সময় তখন ভোররাত। অথচ সেদিন সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা মুজিবের। ছিল অন্য কর্মসূচি। আগের দিনটা, ১৪ আগস্টও কেটেছিল কর্মব্যস্ততায়। সন্ধ্যা ৮টা নাগাদ তিনি গণভবন থেকে বেরনোর আগে পর্যন্ত নানা বিষয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তখন কে জানত ঘাতকের করাল ছায়া ঘনীভূত হচ্ছে ধীরে ধীরে!
ভোররাতে আচমকাই বাড়ির দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ শুরু হয়। প্রথমে মুজিব বারান্দায় বেরিয়ে এলেও অচিরেই গুলির ঝড় ছুটে আসে! জানলার কাচ ভেঙে দেওয়ালে এসে লাগে অসংখ্য বুলেট। অবস্থা বেগতিক দেখে টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন। সেই সময় তাঁর পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি। পরে দ্রুত পোশাক বদলে উপরে উঠে যান তিনি। তার আগে ভবনের পাহারায় থাকা সেনা ও পুলিশ অফিসারদের কাছে অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলেন, কেন এমন হামলার তাঁরা কোনও 'জবাব' দিচ্ছেন না!
এরপরই বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল মারা যান বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তা বজলুল হুদার গুলিতে। প্রথমে গুলি লেগেছিল পায়ে। কিন্তু শেখ কামাল প্রাণে বাঁচতে যখন অসহায়তার সঙ্গে বলেন, তিনি মুজিবের ছেলে, তখনই গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যান। বঙ্গবন্ধু অবশ্য তা জানতেন না। কিন্তু গুলির মুহুর্মুহু শব্দে বুঝতে পারছিলেন চূড়ান্ত অনভিপ্রেত কিছু ঘটে যাচ্ছে। তিনি বিভিন্ন নম্বরে ফোন করে সাহায্য চান। এমনকি সামরিক সচিবের সঙ্গেও তাঁর কথা হয়। কিন্তু লাভ হয়নি। বরং ঘাতকরা নিচ থেকে উঠে আসে উপরে। ঘিরে ফেলে বঙ্গবন্ধুর ঘর। এরপর সেখান থেকে তিনি বাইরে আসতেই তাঁকে ঘিরে ফেলে নিচে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব শেষ। মুজিবের শরীরে ১৮টি বুলেটের চিহ্ন মিলেছিল।
তিনি একা নন, তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা, অন্য দুই ছেলে শেখ জামাল, ১০ বছরের শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামালকেও হত্যা করে বাংলাদেশ সেনা। অর্থাৎ রাতারাতি প্রায় পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন! শোনা যায় গোটা বাড়িটা 'শবাগারে' পরিণত করার পর এক হাবিলদার নাকি মেজর আজিজ পাশাকে গিয়ে বলেছিলেন, ''স্যার, সব শেষ।''
শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধ
গোটা বিশ্ব শিউরে উঠেছিল এমন নারকীয় হত্যালীলার কথা জেনে। মুজিবের দুই কন্যা, হাসিনা এবং রেহানা বিদেশে (পশ্চিম জার্মানি) না থাকলে সেদিন তাঁদেরও মৃত্যু হত। ২১ বছর পরে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন। তিনিই ১৯৮১ সালে হাল ধরেছিলেন আওয়ামি লিগের। আজ হাসিনাও দেশছাড়া। আর সেই অভিশপ্ত ৩২ নম্বর বাড়িটিকে গুঁড়িয়ে দিল 'বিপ্লবী'র দল। যে দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছিলেন মুজিব, সেই দেশে তাঁকে হত্যা করার পঞ্চাশ বছর পর আরেক অস্থিরতার সাক্ষী হচ্ছে বাংলাদেশ।
হাসিনা দেশ ছাড়ার পর থেকেই দেখা যায়, বাংলাদেশ জুড়ে ভাঙা হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবর রহমানের মূর্তি। কোথাও হাতুড়ি মেরে আবার কোথাও ক্রেন দিয়ে একের পর এক মূর্তি ভেঙে একেবারে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কালি লেপে দেওয়া হচ্ছে মুজিবের ছবিতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকে এভাবে মোছা সম্ভব নয়। কবি অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, 'যতকাল রবে পদ্মা যমুনা/ গৌরী মেঘনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান'... তাঁকে বাঙালি ভুলবে না। হাতুড়ি মেরে ইতিহাস ভোলানো যায় না।
