সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: আমৃত্যু রবীন্দ্রনাথ ছিল তাঁর আশ্রয়। ধর্মের ঊর্ধ্বে বাঙালি জাতিসত্ত্বার প্রতিষ্ঠাই ছিল ইহ জীবনের সাধনা। ২৫ মার্চ, মঙ্গলবার বিকেলে প্রয়াত হয়েছেন বাংলাদেশের সেই বর্ষীয়ান সঙ্গীতশিল্পী তথা ‘ছায়ানট’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সনজীদা খাতুন। পদ্মাপাড়ের টালমাটাল রাজনৈতিক আবহে এই প্রয়াণ কাকতালীয়ভাবে প্রতীকী। সকলের জানা, ঢাকা শহরে পয়লা বৈশাখের ভোরে মঙ্গল শোভযাত্রা আর ছায়ানটের সাংস্কৃতিক আয়োজন অঙ্গাঙ্গিক জড়িত। এবার সেই মঙ্গল শোভযাত্রাকে হাইজ্যাক করার অভিযোগ উঠছে মহম্মদ ইউনুস প্রশাসন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জামাতের মতো কট্টরপন্থীদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ এনেছে খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এযাবৎ তারাই বাংলা ও বাঙালির নববর্ষে বর্ণাঢ্য আয়োজন করে এসেছে। এক লিখিত বিবৃতিতে চারুকলা অনুষদের সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, "এবারের বৈশাখ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বৈশাখ।" এই কারণেই বৈশাখ ১৪৩২' -এর আয়োজনকে 'বর্জন' করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। এই নিয়ে ফেসবুকে সরব হয়েছেন বাংলাদেশি লেখিকা তসলিমা নাসরিন।

চাঁচাছোলা ভাষায় মৌলবাদীদের আক্রমণ করেছেন 'আমার মেয়েবেলা'র লেখিকা তসলিমা। বুধবার ফেসবুক পোস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের 'মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে স্পষ্ট বিবৃতি' পোস্ট করেন তিনি। ক্যাপশানে লেখেন, "মঙ্গল শোভাযাত্রা চিরকালই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা করেন। এবার তাঁরা করছেন না। তবে কারা করছে এই শোভাযাত্রা? মঙ্গল শোভাযাত্রাকে কি 'আল্লাহু আকবর' বলে জবাই করা হবে?"
'মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে স্পষ্ট বিবৃতি'তে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, "মূলত বৈশাখ প্রতিবছর আনুষ্ঠানিকভাবে নির্দিষ্ট ব্যাচের তত্ত্বাবধায়নে এবং সম্পূর্ণভাবে শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষকদের যৌথ প্রয়াসে আয়োজন হয়ে থাকে।" "কিন্তু এবারে আয়োজন একবারেই চারুকলা অনুষদের পূর্বাপর রীতির ব্যতিক্রমীভাবে কোনরকম শিক্ষার্থীদের সম্মতি ও সম্পৃক্ততা ছাড়া শুধুমাত্র শিক্ষকদের সিদ্ধান্তে করা হচ্ছে। যা আমাদের বিশ্বাস ও ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।" আরও জানানো হয়েছে, শোভাযাত্রায় "শহিদ আবু সইদের স্ট্রাকচার সম্পর্কে আমরা অবগত ছিলাম না"। বিবৃতির অন্তিম অনুচ্ছদে শোভাযাত্রা বর্জন এবং তাঁর কারণের কথা বলা হয়েছে। লেখা হয়েছে---"এবারের বৈশাখ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বৈশাখ। এ আয়োজনে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গের চাটুকারিতাপূর্ণ মনোভাবের কারণে আমরা শিক্ষকদের আয়োজন করা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতা ও শোভযাত্রা সমর্থন করছি না।" বরং তা "বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
প্রশ্ন হল, বাংলাদেশে জনপ্রিয় পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভযাত্রাকে আক্রমণ করছে কেন ইউনুসপন্থী মৌলবাদীরা? কারণ এই শোভাযাত্রা ধর্মীয় পরিচয়কে পিছনে ফেলে বাঙালি আত্মপরিচয়ের সমর্থন যোগায়। পাকিস্তানপন্থী নতুন বাংলাদেশ যেখানে বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের অবদান নস্যাৎ করা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, সেখানে মঙ্গল শোভাযাত্রার ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা বিপজ্জনক শাসকপক্ষের কাছে। উল্লেখ্য, স্বাধীনতা দিবসের দিন সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের শহিদ শ্রদ্ধা জানানো এবং বঙ্গবন্ধুর নামে স্লোগান দেওয়ার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে। অন্যদিকে পাবনায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিএনপির সদস্য সচিব, আইনজীবী মাসুদ খোন্দকার তাঁর ভাষণে বলেন, "মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবর রহমান দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন।" এরপর ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তুলে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। বাধ্য হয়ে মঞ্চ ছেড়ে পালান বিএনপি নেতা।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এই আবহাওয়ায় ওপার বঙ্গের বাঙালির একতার উৎসব বৈশাখী মঙ্গলযাত্রাকে ভণ্ডুল করাই ইউনুসপন্থীদের লক্ষ্য। এমন এক সময় ‘ছায়ানট’-এর অন্যতম অভিমুখ সনজীদার প্রয়াণ যেন অধঃপতনের সন্ধিক্ষণকেই প্রমাণ করে। কারণ বাংলাদেশে নববর্ষ বরণের উৎসবে সনজীদার ছায়ানট সংগঠনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজীবন বাঙালি জাতিসত্ত্বার পক্ষে আন্দোলন করেছিলেন তিনি। সেই আত্মপরিচয় যখন সংকটে, তখনই চলে গেলেন এই সঙ্গীতশিল্পী।