গৌতম ভট্টাচার্য: বিরাট কোহলির ঘনিষ্ঠরা নিয়মিত বলে থাকেন যে তাঁর হাতে যখন ব্যাট নেই বা ফিল্ডিংয়ের জন্য মাঠে নেই, তখনও তাঁকে কেন্দ্র করে একটা সোপ অপেরা ক্রমাগত চলতে থাকে। শনিবার সেই সোপের একটা মহাগুরুত্বপূর্ণ এপিসোড দূর কেপটাউন থেকে ভারতীয় ক্রিকেট উপকূলে আছড়ে পড়ল। যখন গোটা ক্রিকেটবিশ্বকে স্তম্ভিত করে আচমকা কোহলি ছেড়ে দিলেন টেস্ট অধিনায়কত্ব। টি টোয়েন্টি ছেড়ে দিয়েছিলেন স্বেচ্ছায়। ওয়ান ডে নেতৃত্ব থেকে বোর্ড হটিয়েছিল। ইনস্টাগ্রামে বিবৃতি দিয়ে এবার টেস্ট ক্যাপ্টেন্সি ছেড়ে দেওয়ার পরিণতি খুব পরিষ্কার। তিনি গত সাত বছর ধরে স্বয়ং ভারতীয় ক্রিকেট, কিনা তিন ফরম্যাটেই হয়ে গেলেন টিমের সাধারণ ক্রিকেটার। নেতার রাজসিংহাসন আর অধিকারে নেই। কর্তৃত্বের ঝাড়লণ্ঠনের আলোও সেই তাঁর মুখে আর ঝলসাবে না বরাবরের মতো। আচম্বিতে বিরাটরাজের বানপ্রস্থ নেওয়ার খবর শুনে হতচকিত ক্রিকেটবিশ্ব।
অথচ আচম্বিত খবর নয়। বরং গত কুড়ি ঘণ্টা ধরে ঘুরপাক খেয়েছে ভারতীয় ক্রিকেটের প্রভাবশালী সব অংশে। শুক্রবার রাত থেকে অন্তত কুড়িজন খবরটা জানতেন। প্রথম নিউজটা ব্রেক করেন অবশ্য কোহলি নিজেই। ড্রেসিং রুমের মধ্যে। কোচ রাহুল দ্রাবিড়কে (Rahul Dravid) প্রথম জানিয়েছিলেন। কেপটাউনে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ দেখতে হাজির ছিলেন দুই জাতীয় নির্বাচক দেবাশিস মোহান্তি আর আবে কুরুভিল্লা। বিরাটের সিদ্ধান্ত জানতে পেরে এঁরা বোর্ডকর্তাদের ফোন করেন, এমতাবস্থায় তাঁদের কী করণীয়? বোর্ড (BCCI) বলে, বিরাটের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানাতে। এঁরা কথাও বলেন। কিন্তু বিরাট রাজি হননি। বলেন, সকালে উঠে ইদানীং দেখছি আর নিজেকে উদ্দীপ্ত করতে পারছি না। বাহিনীকে চাগানোর সেই জোশটা নিজের মধ্যে পাচ্ছি না। তিনি অনড় দেখে নির্বাচকরা জানিয়ে দেন যে আলোচনা ব্যর্থ। তখন, মানে শুক্রবার বেশি রাতেই বোর্ডকর্তারা বুঝে গিয়েছেন বিরাটের সিদ্ধান্তের ভিত্তি অভিমান হোক কী ধূর্ত হিসাব এখনকার মতো তাঁকে বোঝানো সম্ভব নয়। ক্যাপ্টেনের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হবে তখনই বোর্ডের অন্দরমহলে সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। মোটামুটি কথা হয়ে যায় এবার থেকে তিন ফরম্যাটেই অধিনায়কত্ব করবেন রোহিত শর্মা (Rohit Sharma)।
[আরও পড়ুন: কোহলি অধিনায়কত্ব ছাড়তেই নেটিজেনদের নিশানায় সৌরভরা, নতুন অধিনায়ক নিয়ে শুরু জল্পনা]
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের (Sourav Ganguly) ‘দাদাগিরি’র শুটিং শুরু হওয়ার খানিক আগে। যখন গত একমাস ভারতীয় ক্রিকেট মহাবিতর্কের দু’প্রান্তে থাকা দুই ব্যক্তি পরস্পরের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। বিরাট বোর্ড প্রধানকে ফোন করেছিলেন তাঁর সিদ্ধান্ত সরকারিভাবে জানাতে। বোর্ড সচিব জয় শাহকেও তিনি ফোনে ধরেছিলেন। দুটো কল-ই করতে হয় বলে করা। সত্যি যদি পদমর্যাদা অনুযায়ী করতেন তাহলে টিমকে জানানোর আগেই বোর্ডকে জানাতেন। গত চল্লিশ বছরে যে চার অধিনায়ক স্বেচ্ছায় গদি ছেড়েছেন, প্রত্যেকে হয় বোর্ড নতুবা নির্বাচকদের আগাম জানিয়েছেন। সে গাভাসকর হোন কী তেণ্ডুলকর, কী দ্রাবিড়। কোহলির বিলম্বিত বার্তা থেকে আরও পরিষ্কার, বোর্ডের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর অভিমান জারি রেখে তিনি ছাড়ছেন। নিজের বিবৃতিতেও কোথাও সৌরভের নাম করেননি। বরঞ্চ ধন্যবাদ জানিয়েছেন এমন দুই ব্যক্তিকে যারা বোর্ড প্রেসিডেন্টের সেরা মিত্র হিসাবে খ্যাত নন। ধোনি ও শাস্ত্রী। বোঝা যাচ্ছে এটা তাঁর কৌশলী সুইচ হিট। এখন বোর্ড যে তাঁকে টেস্ট সিরিজ শেষ হলেই শো-কজ করবে ভেবেছিল, সেই পরিকল্পনা বিশ বাঁও জলে। যে লোকটা পদেই নেই তাকে আর চিঠি ধরিয়ে কী লাভ? প্রেক্ষিতটাই তো পুরো বদলে গেল। বরং এক সিদ্ধান্তে কোহলি তো গোটা ক্রিকেট ভারতের সহানুভূতি অনেকটাই নিজের দিকে এনে ফেললেন। টুইটারে ট্রেন্ডিং হচ্ছে গাঙ্গুলি ও শাহ বিরোধী সব পোস্ট।
[আরও পড়ুন: দেশের অন্যতম সেরা টেস্ট অধিনায়ক ছিলেন কোহলি, বলছে পরিসংখ্যান]
রাতে যোগাযোগ করা হলে সৌরভ বললেন, “আমরা তো ওকে যেতে বলিনি। কিন্তু ফোনেও এত অনমনীয় শোনাল যে আর অনুরোধ করেও লাভ হত না।” অধিনায়ক বিরাটের সাত বছর নিয়ে বোর্ড প্রেসিডেন্ট কিন্তু উচ্ছ্বসিত। বললেন, “বিরাট দুর্ধর্ষ ব্যাট শুধু নয়, সাত বছর ধরে দুরন্ত অধিনায়কত্ব করেছে। ওর যে গুণটা বরাবর আমায় সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে, তা হল ওর বন্য প্যাশন। সব সময় জিততে চাওয়া।” শুনে মনে পড়ল ২০১৪-র বিরাট বলতেন এই প্যাশন-নির্ভর ঘরানার অধিনায়কত্ব এবং নতুন প্লেয়ার তুলে আনতে চাওয়ার দুঃসাহসী মনোভাবের জন্য তাঁর পছন্দের অধিনায়ক হলেন গাঙ্গুলি। না ধোনি নন। ১৫ জানুয়ারি ২০২২ আবার দেখাল আগের সেই পর্যবেক্ষণে চূড়ান্ত টুইস্ট। নাহ, এটা সোপ অপেরারও বেশি।