অরিজিৎ গুপ্ত, হাওড়া: “ওর এই পরিণতির জন্য আমিই দায়ী। আমিই ওকে হাত ধরে ট্রেকিং শিখিয়েছি। আমার জীবনে এটাই সবচেয়ে বড় ভুল হয়ে গেল।” ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে এভাবেই শোকজ্ঞাপন করলেন হাওড়ার পর্বতারোহী কুন্তল কাঁড়ারের বাবা চণ্ডীচরণ কাঁড়ার। ব্যাঁটরার ১৩ নম্বর কাঁড়ার পুকুর লেনের বাড়িতে বসে শোকাহত বাবা জানালেন, ছোট থেকেই অ্যাডভেঞ্চারের নেশা ছিল কুন্তলের। অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় প্রচণ্ড ঘুরতে ভালবাসত তাঁর ছোট ছেলে। গত ৪ এপ্রিল কাঞ্চনজঙ্ঘা জয় করবে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন কুন্তল। যাওয়ার আগে বাবার সঙ্গে ঝগড়াও করেছিলেন তিনি। ছেলে পর্বতারোহণে গিয়ে বাড়ি না ফেরায় এখন সেই স্মৃতিচারণই করছেন কুন্তলের পরিবারের লোকেরা।
কুন্তলের বয়স যখন ১৩ বছর ছিল তখনই তাঁর বাবা চণ্ডীচরণের হাত ধরে রাঁচিতে গিয়েছিলেন কুন্তলকে। বৃহস্পতিবার শোকস্তব্ধ বাবা চণ্ডীচরণ জানালেন, রাঁচির হুড্রু ফলস দেখতে গিয়েছিলেন তাঁরা। অন্যরা যখন জলপ্রপাতে দড়ি দিয়ে ওঠানামা করছিল তখন কুন্তল সেখানে পিচ্ছিল সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করে। সেদিনই রাঁচির কয়েকজন পর্বতারোহী কুন্তলের বাবা চণ্ডীচরণকে বলেছিলেন তাঁর ছেলে পর্বতারোহণ করবে। প্রচুর সম্ভাবনা আছে তাঁর ছেলের। তার পর আর দেরি করেননি বাবা। ছোট ছেলের মধ্যে পাহাড়ে চড়ার নেশা ধরিয়ে দিয়েছেন।
আসলে কুন্তলের বাবা অবসরপ্রাপ্ত রাজ্য সরকারি কর্মী চণ্ডীচরণ কাঁড়ার নিজেও কয়েকবার অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় পর্বত অভিযান করেছেন। নিজের সেই নেশা তাঁর ছোট ছেলের মধ্যে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর ছোট ছেলে কুন্তল যাতে পর্বতারোহণ করতে পারে তার জন্য হিমাচল প্রদেশের একটি পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ সংস্থার অধীনে তাঁকে ভরতিও করে দেন চণ্ডীচরণ। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরই পাহাড়ে চড়া শুরু কুন্তলের। তার পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি কুন্তলকে। একের পর এক পর্বত অভিযান করেছেন তিনি। প্রায় ২০ বার বিভিন্ন পর্বতে অভিযান করেন ৪৭ বছরের কুন্তল। এর পর গত ৪ এপ্রিল পাঁচ জনের একটি দলের সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে যান কুন্তল। ফণী ঝড়ের জন্য আবহাওয়া খারাপ থাকায় কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে গিয়ে অনেক প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে পড়তে হয় কুন্তলদের।
[ আরও পড়ুন: শেষবেলার প্রচারে ঝড় তুললেন নুসরত, সঙ্গী দেব ]
রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাঁচ জনের একটি দল এই কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে যান। পাঁচ জনের এই দলেই ছিলেন কুন্তল। কুন্তলের দাদা কাঞ্চন কাঁড়ার জানান, গত ১৪ মে কুন্তলের সঙ্গে তাঁদের পরিবারের শেষবার এসএমএসে কথা হয়। গত মঙ্গলবার কাঞ্চনজঙ্ঘা ছুঁতে ২০ মিটার বাকি ছিল কুন্তলের। তাঁর বাবা বৃহস্পতিবার বাড়িতে বসে জানান, শেষ সেই ২০ মিটার হামাগুড়ি দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল তাঁর ছেলে। কুন্তলের সঙ্গে থাকা স্লিপিং ব্যাগে বরফ জমে গিয়েছিল। তবু স্লিপিং ব্যাগটি ছাড়েনি কুন্তল। বাবা চণ্ডীচরণের কথায়, ওই ভুলটাই করেছিল তাঁর ছেলে। বরফ জমা স্লিপিং ব্যাগটি নিয়ে জোর করেই উঠতে যায় কুন্তল। অবশেষে আর উঠতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ক্যাম্প ৪-এ তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয়।
কুন্তলের মৃত্যুর খবর পেয়ে শোকস্তব্ধ তাঁর মা নমিতা কাঁড়ারও। পর্বত অভিযানের নেশা ছাড়াও কুন্তলের আরও একটি গুণ ছিল। তিনি তিনটি অনাথ আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অনাথ ছেলে-মেয়েদের নানাভাবে সাহায্য করে গিয়েছেন। খবর পেয়ে এদিন সকালে ছাদে যে ঘরে কুন্তল থাকতেন সেখানে গিয়ে তাঁর স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান কুন্তলের বাবা চণ্ডীচরণ।
এদিকে কুন্তল না ফেরার খবর শুনেই বৃহস্পতিবার সকালেই পঞ্চাননতলায় তাঁর বাড়িতে ছুটে যান রাজ্যের সমবায় মন্ত্রী অরূপ রায়। শোকস্তব্ধ পরিবারের পাশে দাঁড়ান তিনি। রাজ্যের সমবায় মন্ত্রী তথা হাওড়া জেলা মাউন্টেনিয়ার অ্যান্ড ট্রেকারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অরূপ রায় এদিন জানান, আজ শুক্রবার কুন্তলকে নিয়ে আসতে কাঞ্চনজঙ্ঘার উদ্দেশে রওনা দেবে একটি প্রতিনিধিদল। এই দলে থাকবেন পর্বতারোহী মলয় মুখোপাধ্যায়, কুন্তলের পরিবারের লোক ও যুবকল্যাণ দপ্তরের আধিকারিকরা। হেলিকপ্টারে করে তাঁরা আজ কুন্তলকে উদ্ধার করতে পৌঁছবে।
[ আরও পড়ুন: ভোটের মাঝে ফের উদ্ধার নগদ, দুর্গাপুরে ৭০ লক্ষ টাকা-সহ গ্রেপ্তার এক ব্যক্তি ]
কুন্তলের পরিবারের পাশাপাশি তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে ভেঙে পড়েন স্থানীয় ক্লাবের সদস্যরাও। বাড়ির কাছেই অন্নপূর্ণা ব্যায়াম সমিতি ক্লাবের আজীবন সদস্য ছিলেন কুন্তল। হাওড়ার বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশনে পড়ার সময় থেকেই অন্নপূর্ণা ব্যায়াম সমিতিতে যাতায়াত ছিল কুন্তলের। ক্লাবে গিয়ে শরীরচর্চার পাশাপাশি খেলাধুলোর নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন কুন্তল। এমনকী ক্লাবে স্কাউট করতেন তিনি। ওই ক্লাবের সদস্যরা জানিয়েছেন, কুন্তল অজাতশত্রু ছিলেন। নরসিংহ দত্ত কলেজে স্নাতক কুন্তল প্রত্যেকদিনই ক্লাবে শরীরচর্চা করতে যেতেন। পর্বতপ্রেমী কুন্তলের এই পরিণতিতে শোকস্তব্ধ হাওড়ার বাসিন্দারা। শোকস্তব্ধ কাঞ্চনজঙ্ঘায় হারিয়ে যাওয়া আর এক পর্বতারোহী ছন্দা গায়েনের পরিবারও।
এদিন কুন্তলের খবর পেয়ে ছন্দা গায়েনের দাদা জোতির্ময় গায়েন বলেন, “পর্বত অভিযানে গিয়ে বিপদ হলে কীভাবে পর্বতারোহীদের ফিরিয়ে আনা হবে তা নিয়েই ভাবা উচিত রাজ্য সরকারের। না হলে এরকম বার বারই পর্বত অভিযানে গিয়ে তরতাজা প্রাণ চলে যাবে।”
The post ‘এই পরিণতির জন্য আমিই দায়ী’, শোকস্তব্ধ মৃত পর্বতারোহী কুন্তল কাঁড়ারের বাবা appeared first on Sangbad Pratidin.