প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে বাংলা চিরকালই বঞ্চিত। বিধি আরও বাম হয়ে ওঠে ১৯১১ সালে দেশের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরকরণের সময়। ’৮৪ সালে সাংবাদিকতায় এসে দেখি কেন্দ্র রাজ্যকে প্রাপ্য অর্থ দিচ্ছে না। সেই ট্র্যাডিশন এখনও অব্যাহত। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।
রাজধানী দিল্লিতে একনাগাড়ে চার দশক থাকলেও বাংলাতেই শিকড়ের টান। দিল্লিবাসীরা আমাকে বলেন ‘নন-রেসিডেন্ট বং’। বাংলা ও বাঙালির দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা নিয়ত অনুভব করি। বাংলার ইতিহাসকে জড়িয়ে রয়েছে চূড়ান্ত অর্থনৈতিক সংকট। ’৭৬-এর মন্বন্তরের শিকার বাংলা। বাংলায় সেটা ছিল ১১৭৬ সন, ইংরেজি ১৭৭০ সাল। অতিবৃষ্টি আর বন্যায় বিধ্বস্ত বাংলার কৃষক সমাজ। বঙ্কিমচন্দ্রও তঁাদের দুর্গতির কথা তুলে ধরেন।
১৯৪৩ সালে আবার বাংলায় দুর্ভিক্ষ হয়। অমর্ত্য সেনের তখন মাত্র ন’-বছর বয়স। যুদ্ধ, বিভিন্ন দেশের রপ্তানি বন্ধ, খাদ্য সরবরাহ বণ্টনের ভয়াবহ অসাম্য। অমর্ত্য সেন লিখেছেন সেই সংকটের ইতিবৃত্ত।
এক ব্রিটিশ জেলাশাসক রবার্ট কারস্টেয়ারস সমুদ্রপথে কলকাতা পৌঁছলেন। ২৪ পরগনার জেলাশাসক ছিলেন। ২৯ বছর এ-দেশে কাজ করলেন। রোজ ডায়েরি লিখতেন। ১৯০৩ সালে অবসর নিয়ে বই লিখলেন, ‘দ্য লিট্ল ওয়ার্ল্ড অফ অ্যান ইন্ডিয়ান’। বইটিতে তিনি তুলে ধরলেন বাংলার আর্থিক সংকটের কথা। এমনকী, আর্থ-সামাজিক কারণে কীভাবে ২৪ পরগনায় তখন হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষ হয়েছে তা-ও তিনি লেখেন। সেই যুবক অফিসারটি লন্ডনে তঁার বস-কে বলেন– মানুষের উন্নতি হলে তবেই উপনিবেশের শ্রীবৃদ্ধি হবে। রাজশক্তিও স্থায়ী হবে। বস ব্যঙ্গ করে বলেন– তুমি এখন লন্ডনের বৃহৎ দুনিয়া থেকে সরে গিয়ে বাংলার একটা ‘লিট্ল ওয়ার্ল্ড’-কেই ভুবন ভাবছ। তিনি হয়তো বলতে চান– তুমি রাজকর্মচারী, এত ভাবা প্র্যাকটিস করছ কেন? তাই তিনি বসের প্রতি কিঞ্চিৎ ব্যঙ্গের প্রকাশ ঘটিয়ে বইয়ের নাম পরিবর্তন করে দেন, ‘দ্য লিট্ল ওয়ার্ল্ড অফ অ্যান ইন্ডিয়ান ডিসট্রিক্ট অফিসার’। ভূমিকায় লেখেন: এ বই হল বাংলা সম্পর্কে তঁার ‘স্টোরি অফ থট’।প্রয়াত ভাস্কর সোমনাথ হোড় বলেছিলেন– আমি যখনই মূর্তি গড়ি তখন বাংলার দুঃখ-যন্ত্রণাই আমার আঙুলগুলো দিয়ে বেরয়। বাংলার দুর্ভিক্ষ, হতাশ-দরিদ্র কৃষক– সব মিলিয়ে এক বিধ্বস্ত ও ত্রস্ত সময় আমি দেখেছি। ছয়ের দশকেও খাদ্য সংকট হয়। ১৯৫৯ ও ১৯৬৬-র খাদ্য আন্দোলন তো সেই সংকটের প্রতিবাদেই আন্দোলন।
[আরও পড়ুন: ৭ দিনের ইডি হেফাজতে কেজরিওয়াল, আরও চাপে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী]
১৯৪৭-এ স্বাধীনতার পর যখন পুঁজিবাদের বিকাশ পর্ব শুরু হল, তখন মহারাষ্ট্র-গুজরাট যেভাবে এগিয়ে গিয়েছিল, বাংলা তা পারেনি। বাংলা থেকে পুঁজি চলে যেত পশ্চিম ও উত্তর ভারতে। পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম বিধানসভায় বিরোধী নেতা জে্যাতি বসু কলকাতা থেকে ‘ফ্লাইট অফ ক্যাপিটাল’ (১৯১১ সালের সেই বিখ্যাত রাজধানীর দিল্লিতে স্থানান্তরকরণের ঘটনা) নিয়ে গর্জে উঠেছিলেন। অনেক ঐতিহাসিকের মত, বাঙালি মানেই সাব্ভারসিভ বিপ্লবী, যাকে রাজশক্তি বলত ‘সন্ত্রাসবাদী’, তাদের ভয়েই নাকি দিল্লি চলে যাওয়া। কার্যকারণ যাই হোক, ২০২৪ সালের চৌকাঠে দঁাড়িয়ে এ-কথা স্বীকার করতেই হয় যে, বাংলা চিরকাল বঞ্চিত। বাংলা ও বাঙালিকে নিয়ে চিরকাল দিল্লির উদ্বেগ। তথাকথিত মূলস্রোতে থেকেও তাই বাঙালি যেন বরাবর বিচ্ছিন্ন। কেন্দ্র ও রাজে্যর বিরোধও নতুন ঘটনা নয়। ভারত ভাগ হয়েছে একবার।
[আরও পড়ুন: জঙ্গি দমনে বিরাট সাফল্য, অসম থেকে ধৃত ভারতের আইসিস প্রধান]
বাংলা ভাগ দু’বার। ’৪৭-এর আগে ১৯০৫-এর ভাঙন চেষ্টাই বা ভুলব কী করে? বামপন্থীরা এ রাজে্য ১৯৭৭-এ ক্ষমতায় আসার পরও কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আচরণ নিয়ে কম চিৎকার করেনি। ’৮৪ সালে সাংবাদিকতায় এসেই দেখলাম মাসুল সমীকরণ নীতি নিয়ে চলছে আন্দোলন। কেন্দ্র প্রাপ্য টাকা দিচ্ছে না। সেই ট্র্যাডিশন অব্যাহত। ২০২৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালেও তাই রাজে্যর সবচেয়ে বড় ইসু্য: বাংলার প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনা। এই জনগর্জনের প্রধান কারিগর রাজে্যর নবীনতম কান্ডারি অভিষেক বন্দে্যাপাধ্যায়। ১০০ দিনের কাজ ও আবাস যোজনায় কেন্দ্রীয় বরাদ্দ নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি তুলেছেন তিনি। একদা কেন্দ্রের বঞ্চনা নিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় আর রাজে্যর অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্রর প্রকাশ্য বিতর্ক হত। প্রণববাবু একবার আমাকে বলেছিলেন– সমস্যাটা হয়েছিল আমি কেন্দ্রের অংশ বলে নয়, আমি বাঙালি বলে।
অশোকবাবু এত প্রচার চালান যে বাঙালির মনে বদ্ধমূল ঢুকে যায় আমি রাজ্যকে বঞ্চিত করেছি। আর তাই পরবর্তীকালে নরসিংহ রাওয়ের সময় থেকেই তিনি রাজে্যর জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধির চেষ্টা শুরু করেন। যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হয়ে তিস্তা নদীর প্রকল্প বিপুল অর্থ বরাদ্দ করে বলেন– এটা বাংলা কাগজে একটু ভাল করে প্রচার করো। না হলে বাঙালির মনে ঢুকে আছে বাঙালি হয়ে আমি রাজ্যকে বঞ্চনা করেছি।
এখন অভিষেক যুক্তি ও তথ্য দিয়ে দেখাচ্ছেন যে, ২০২১ সালে হেরে যাওয়ার পর কেন্দ্র এক পয়সাও সাহায্য করেনি। যে-টাকা দেওয়া হয়েছে বলে বিজেপি দাবি করছে, অভিষেক কাগজপত্র দেখিয়ে বলেছেন– এই টাকাগুলো ’২১ সালের অনেক আগের আর্থিক বছরের বরাদ্দ; তা-ও যৎসামান্য।
বিজেপি এখন বলছে ক্ষমতায় এলে মহিলাদের ৩,০০০ টাকা করে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প দেবে। অভিষেক প্রকাশ্য আলোচনায় অংশগ্রহণে বিজেপি নেতাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। রাজ্যকে কবে কত টাকা দেওয়া হয়েছে তার তথ্য দিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন। বিজেপি নেতারা অভিষেকের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তঁার মুখোমুখি হবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। কাজেই আপাতত ২০২৪-এর ভোটে ‘সিএএ’ থেকে শুরু করে ‘জয় শ্রীরাম’, হিন্দুত্ব, এবং সর্বোপরি সন্দেশখালি নিয়ে বিজেপি নির্বাচনী ইসু্য করতে চাইলেও ব্রিগেড সমাবেশে মমতা বন্দে্যাপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দে্যাপাধ্যায় বুঝিয়ে দিয়েছেন– তঁাদের প্রচারের প্রধান অভিমুখ– বিজেপি হল বাংলা ও বাঙালি-বিরুদ্ধ দল। বাংলা জয় করার লোভে বিজেপি বাঙালিকেই নানাভাবে ভাগ করতে উদ্যত। বিগত বিধানসভা ভোটের আগেই ১০০ দিনের কাজ, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্পের টাকা আটকে দেয় কেন্দ্র। ’২১ সালেও ভোটের সময় তারা বলতে চেয়েছিল ‘ডাব্ল ইঞ্জিন’ সরকার হলে তবেই রাজ্য টাকা পাবে, না হলে রাজ্যকে বঞ্চিত থাকতে হবে। ভোটের ফলে দেখা যায় বিজেপি বিপর্যস্ত। পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরেও কেন্দ্রের বঞ্চনার প্রতিবাদে তৃণমূল কংগ্রেসের জনজোয়ার আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করে অভিষেকের নেতৃত্বে কর্মী-সমর্থকরা। দু’-মাস ধরে কোচবিচার থেকে কাকদ্বীপ জনজোয়ার দেখা যায় এই কর্মসূচি ঘিরে।
বিগত পঁাচ বছরে কেন্দ্রীয় সরকারকে রাজ্য দিয়েছে ৬,৮০,০০০ কোটি টাকা। এদিকে নানা প্রকল্পে রাজে্যর বকেয়া অর্থের পরিমাণ দঁাড়িয়েছে ১,৭৪,০০২ কোটি টাকা। গ্রামীণ আবাস প্রকল্পে ৩৯ লাখ বাড়ির তালিকা। দু’-বছর আগে ১১ লাখ ৩৬ হাজার মাটির বাড়ি তৈরির তালিকা দিল্লি অনুমোদন করে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত একটি বাড়ির টাকাও দেয়নি কেন্দ্র। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ১০০ দিনের প্রকল্পের। দু’-বছরের উপর বন্ধ এই প্রকল্পের টাকা আসা। ১১ হাজার কোটি টাকা বকেয়া ১০০ দিনের কাজে। কাজ করেও পারিশ্রমিক পায়নি খেটে খাওয়া মানুষ। বিজেপির অভিযোগ: দুর্নীতি হয়েছে বলেই টাকা বন্ধ। কিন্তু ‘ক্যাগ’-এর (দ্য কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর অফ ইন্ডিয়া) যে রিপোর্ট দেখানো হচ্ছে, তা বাম আমলের। অভিষেক তো এমন কথাও বলেছেন, কোনও ক্ষেত্রে দুর্নীতি থাকলে সেখানে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এভাবে
রাজ্যকে পুরো বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়া অসাংবিধানিক। ঠিক এই কথাটাই সেদিন সাংবিধানিক আইনের বিশেষজ্ঞ ড. অর্ঘ্য সেনগুপ্ত সুপ্রশাসন সম্পর্কিত এক আলোচনাসভায় বলছিলেন। তঁার বক্তব্য, দুর্নীতি একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাধি। সব রাজে্য, সব শাসনেই তা সাধারণ সমস্যা। তা’বলে দুর্নীতি-রোধের নামে রাজে্যর বরাদ্দ টাকা বন্ধ করে দেওয়া অসাংবিধানিক। গান্ধীর ভিলেজ রিপাবলিকের গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনকে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে এই ভাতে মারার রাজনীতি করা গর্হিত অপরাধ। যেখান থেকে এ-লেখা শুরু করেছিলাম সেখানেই ফিরে আসি। বাংলার ইতিহাস বড় দুঃখের। এক দীর্ঘ অন্যায়-অবিচার ও বঞ্চনার ইতিহাস। যে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে রাজে্যর উন্নয়ন সাধন, দারিদ্র মোচন খুব সহজ কাজ নয়। এ অবস্থায় ভাতে মারার রাজনীতি বাংলা ও বাঙালির জন্য আরও কঠিন লড়াই।